ফুটপাতে শ্রমিকের ঈদ, সরকার নির্লিপ্ত!


বেতনের দাবিতে সোয়ান গার্মেন্টের শ্রমিকদের ঈদ করতে হলো রাজপথে

খুশির ঈদ বলে বাংলাদেশে আর কিছু নেই। ঈদের খুশি তাদেরই হয় যারা ঈদের সময় প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন, ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরতে পারেন এবং সেমাই, ফিরনি, পোলাও ইত্যাদি খেতে পারেন। এসব একেবারে সাধারণভাবে ঈদের নূ্যনতম প্রয়োজন। এগুলো ছাড়া ঈদ শুধু কোলাকুলিতে শেষ হতে পারে না। নতুন কাপড় ছাড়া কোলাকুলিও মধুর হয় না। যারা সচ্ছল তাদের জন্য ঈদ আরও অনেক বেশি কিছু, তাদের বিদেশ যাওয়া, দিনে চারবার কাপড় পাল্টানো, পার্কে যাওয়াসহ আনন্দ করার সব মাধ্যম তাদের হাতে। ঈদে যত ইচ্ছা খরচ করার সামর্থ্য তাদের আছে। বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে কোটিপতি ও নিঃস্ব মানুষ কাছাকাছি বাস করে। তারা একই দেশে এবং একই শহরে বাস করলেও তাদের মধ্যে ফারাক লাখো যোজন। তার একটি উদাহরণ হচ্ছে গার্মেন্ট শ্রমিক ও মালিকের ঈদ।

প্রতিবারের ঈদের আগে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন ও বোনাসের দাবিতে মিছিল, বিক্ষোভ ইত্যাদি হতে দেখা যায়। এবার সে রকম সমস্যা বড় করে দেখা দেয়নি। কিন্তু এবারের ঈদে যখন দেখি ঈদের দিনে গার্মেন্ট শ্রমিক প্রেসক্লাবের সামনে ফুটপাতে বসে প্রতিবাদ করছে, কারণ তারা বেতন-ভাতা পায়নি, কোনো কোনো কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তখন খুব কষ্ট হয় এবং মনে ক্ষোভ জাগে। এই গার্মেন্ট শ্রমিকরা যখন রাস্তায় বসে কাঁদছে, তখন পাশাপাশি দেখি টেলিভিশনে চকচকে ঈদের অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে, তারকারা খোশগল্প করছে, প্রধানমন্ত্রী সবার সঙ্গে দেখা করছেন, খালেদা জিয়াও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন, তখন মনে হয়, গার্মেন্ট শ্রমিকের আর্তনাদ, ঈদ করতে না পারার বেদনা তাদের স্পর্শ করেনি। বড় দুইটি রাজনৈতিক দল জনগণের বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে বলে আমরা জানি। তাহলে গার্মেন্ট শ্রমিকরা বাদ পড়ে যায় কেমন করে? বাম দলের নেতারা ছাড়া অন্য কোনো বড় রাজনৈতিক দল বা তাদের নেতারা তাদের পাশে এসে কেউ সংহতি প্রকাশ করেননি। এটা বড় দুঃখজনক।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ জানাতে বসেছিলেন সোয়ান গার্মেন্টের ১ হাজার ৩০০ শ্রমিক। তাদের দাবি, তিন মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ করা ও বেআইনিভাবে বন্ধ কারখানা খুলে দেয়া। টানা ৯ দিন ফুটপাতে থেকে আন্দোলনকালে ঈদের দিন তারা স্লোগান দিয়েছে, 'সোয়ানের শ্রমিক না খেয়ে মরে, প্রধানমন্ত্রী ও মালিকেরা ঈদ করে।' এই স্লোগান কি মালিক ও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গেছে?

কিন্তু এমন হওয়ার তো কথা ছিল না। ২ জুলাই সঙ্কট ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত মূল কমিটির সভায় বস্ত্র ও পোশাক খাতের তিন সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমএ'র প্রতিনিধিরা কথা দিয়েছিলেন ১০ জুলাই বেতন এবং ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে বোনাস দিয়ে দেয়া হবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বিষয়টি গণমাধ্যমকে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছিলেন। যদিও এ সময় দেয়া মালিকপক্ষের তথ্য ও শ্রমিক সংগঠনের তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের ফারাক দেখা যায়। যেমন- মালিকপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিজিএমইএ'র সাড়ে ৩ হাজার সদস্যের মধ্যে ৯৫ শতাংশ কারখানার শ্রমিক বেতন পেয়েছে এবং ৯৮ শতাংশ কারখানার শ্রমিক বোনাসও পেয়েছে; কিন্তু তারা হিসাব দিচ্ছে মাত্র ৯৯৬টি গার্মেন্ট কারখানার। শিল্প পুলিশের হিসাবে ৬০ শতাংশ পোশাক কারখানার মালিক শ্রমিকদের বেতন দিয়েছেন এবং ১০ থেকে ৩০ শতাংশ কারখানা বোনাস দিয়েছে। শ্রমিক সংগঠনের হিসাবে ৫০ শতাংশ কারখানা বেতন-বোনাস দিয়েছে, যার অধিকাংশকেই বলা হয় কমপ্লায়েন্ট কারখানা, ৪০ শতাংশ কারখানা ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে দেবে বলেছিল, ১০ শতাংশ কারখানা কোনো প্রতিশ্রুতিই দেয়নি। (প্রথম আলো, ১২ জুলাই, ২০১৫)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, জুলাই মাসের বাকি দিনগুলোতে ঈদের আগে সব গার্মেন্ট কারখানা বেতন-বোনাস দিয়েছে কিনা তা সঠিকভাবে তদারক করা হয়নি। কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলো দিয়েছে সরকারের ভয়ে নয়, কিংবা শ্রমিকের প্রতি তাদের ভালোবাসার জন্য নয়, তারা দিয়েছে বায়ারদের মন রক্ষার জন্য। বিদেশে ক্রেতাদের খুশি করার জন্য। যারা ১৬ জুলাই বেতন দেবেন বলেছেন তাদের ভাবা উচিত ছিল এ শ্রমিকরা বাড়ি যাবেন কেমন করে? ঈদ হয়েছে ১৮ তারিখ, ১৬ তারিখ পর্যন্ত ব্যাংক খোলা ছিল, ১৭ তারিখে তাদের প্রাণ হাতে নিয়ে বাড়ি যেতে হতো। কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয়নি সোয়ানসহ আরও অনেক গার্মেন্ট শ্রমিকের। সরকারের দেয়া সময়সীমার মধ্যে বেতন ও বোনাস পরিশোধ করা না হলেও সেটা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কোনো উদ্যোগ নিতে দেখিনি। তাহলে এসব ঘোষণার অর্থ কী? সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এক্ষেত্রে আরও বেশি উদ্বেগজনক। প্রধানমন্ত্রী অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন; কিন্তু পোশাক শ্রমিকদের বেতনের দাবিতে তিনি ছিলেন একেবারে নিশ্চুপ। এ একই সময়ে ক্রিকেট খেলায় জেতার জন্য অভিনন্দন ঠিকই দিয়েছেন। কিন্তু শ্রমিক না খেয়ে থাকলে সরকারপ্রধানের মাথাব্যথা নেই! সরকার এবার আগ বাড়িয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিরাপদে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করার পরিকল্পনাও ঘোষণা করেছিল। ১৬ জুলাই বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে তাদের সদস্যদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ বেতন ও ৯৫ শতাংশ বোনাস দিয়েছে বলে জানায়। অবশ্য বেশকিছু কারখানায় বেতন ও বোনাস দেয়া হয়নি বলে তারা স্বীকারও করেন। এজন্য বিজিএমইএ ও সরকারের ঢিলেঢালা তদারকি ও মালিকের গাফিলতিকে কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন। (প্রথম আলো, ১৭ জুলাই, ২০১৫)। অর্থাৎ বেতন ও বোনাস না দেয়ার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, তারা দিতে চান না, তাই দেননি।

শুধু সোয়ান গার্মেন্টের শ্রমিকরাই নয়, বেতন ও বোনাসের দাবিতে আরও অনেক জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছে। শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে রূপগঞ্জে ৬ শতাধিক শ্রমিক তাদের দুই মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করে। শ্রমিকরা দুঃখ করে জানায়, বেতন-বোনাস না দেয়ার কারণে তারা ঈদে বাড়ি যেতে পারছেন না। শ্রমিকরা নিজের খুশি বিসর্জন দিয়ে ঈদে বাড়ি না গেলেও সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। কারণ বাড়িওয়ালা তাদের চাপ প্রয়োগ করছে বাড়ি ভাড়া দেয়ার জন্য। (যুগান্তর, ১৭ জুলাই, ২০১৫)।

বাংলাদেশ ক্রোনিকল পত্রিকার খবর অনুযায়ী, কমপক্ষে ৫০টি কারখানায় শ্রমিকরা জুন মাসের বেতন পায়নি, আর ২৫০টি কারখানায় ১৬ তারিখ পর্যন্ত কোনো বোনাস দেয়া হয়নি। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে শত শত কারখানায় ঈদের আগে শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে। ঢাকায় সোয়ান গার্মেন্টের শ্রমিকরা লাগাতার আন্দোলন করেছেন, আর চট্টগ্রামে আনোয়ারা গার্মেন্টের শ্রমিকরা বায়েজিদ-খুলশীর রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছেন।

সরকার বা বিজিএমইএ সোয়ান গার্মেন্টের শ্রমিকদের জন্য কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না, কারণ এ কারখানার মালিক মারা যাওয়ার পর মালিকানা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। কিন্তু ঘুরে-ফিরে দায়িত্বটা এসে পড়ছে শ্রমিকদের ওপর। তাদেরই খেসারত দিতে হচ্ছে মালিকের মৃত্যুর এবং খোলা আকাশের নিচে, বৃষ্টিতে ভিজে প্রতিবাদ জানাতে হচ্ছে। ঈদের দিনে তাদের কাটাতে হয়েছে খোলা রাস্তায়। তবুও ভালো যে, বাম দলের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সংহতি জানানো হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে তারা সময় দিয়েছেন।

কমপ্লায়েন্স কারখানায় বেতন ও বোনাস দেয়া হয়, অথচ অন্য কারখানায় দেয়া হয় না- এ অবস্থা কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানার ভবিষ্যৎ ও শ্রমিকদের জন্য খুব সুখবর নয়। গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন বহু দিনের এবং এই আন্দোলন তাদের ন্যায্য মজুরি আদায়ের জন্য এবং কারখানার কাজের পরিবেশ রক্ষার জন্য। কিন্তু দুইটি বড় দুর্ঘটনা, তাজরীনের আগুন ও রানা প্লাজা ধসে পড়ার কারণে শত শত শ্রমিকের মৃত্যু যারা এদেশ থেকে সস্তায় তৈরি পোশাক নেয় তাদের একটু নাড়িয়ে দিয়েছে। বিদেশের প্রচার মাধ্যমে এ দৃশ্য দেখে ক্রেতারা অাঁতকে উঠেছেন। তারা প্রথমে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখান থেকে আর কাপড় কিনবেন না; কিন্তু এক পর্যায়ে তারা বুঝলেন যে, এত সস্তায় আর কাপড় পাওয়া যাবে না। তাই তারা নিজেরাই এখন দায়িত্ব নিতে চান শ্রমিকদের কাজের পরিবেশের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। খুব ভালো কথা। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, তারা সব গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো কাজ করছেন না। তারা শুধু তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডে যেন আগুনে পোড়া গন্ধ এবং ধসে যাওয়া ভবনের তলায় পড়ে থাকা লাশের কোনো দৃশ্য যেন না থাকে তারই চেষ্টা করছেন। এর ফল হয়েছে, বেশকিছু কারখানার পরিবেশ ভালো হলেও অনেক কারখানায় কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণ করতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হচ্ছে সেই শ্রমিকের। কারখানা নিরাপদ না হলে তাকে পুড়ে মরতে হয়, নয়তো ভবনের নিচে পড়ে যেতে হয়। এসব থেকে মুক্তি মিললেও তাকে যদি চাকরি খোয়াতে হয় এবং না খেয়ে থাকতে হয়, তাহলে শ্রমিকরা বুঝতে পারে না আসলে তার জন্য কোনটা ভালো!

সোয়ান গার্মেন্টসহ সব বঞ্চিত পোশাক শ্রমিকের দাবির প্রতি সংহতি জানাচ্ছি। শেষ করছি, এক গার্মেন্ট শ্রমিকের বক্তব্য (নয়া দিগন্ত, ২১ জুলাই, ২০১৫) দিয়ে- 'যে গার্মেন্টকে আমরা এত দূর নিয়ে এসেছি, ঘাম ফেলেছি, তার প্রতিদানে পেয়েছি টানা ৯ দিন ধরে রাস্তায় থেকে। কিন্তু কেউ খোঁজ নিল না আমাদের।' এর উত্তর গার্মেন্ট মালিক, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে দিতে হবে।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।