সোনাতনী নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের মিশ্র ফসলের চাষ


ইতিহাসের মানচিত্রে সোনাতনী ইউনিয়নের মোট ২০টি গ্রামের অবস্থান থাকলেও বর্তমানে ৮টি গ্রামের বেশীরভাগ অংশ নদীগর্ভে। ফলে ১২ টি গ্রামের বাস্তবতা নিয়ে সোনাতনীবাসীদের বর্তমান অবস্থান। সোনাতনী ইউনিয়নে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার লোকের বসবাস এবং মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার একর।

নয়াকৃষি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ১৯৯৮ সাল থেকে এলাকার কৃষকরা কীটনাশক ও রাসায়াসিক সার ব্যবহার না করে চাষাবাদ করে আসছে। ফলে চরাঞ্চল হওয়া সত্বেও এলাকাটি প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ।

যমুনা নদীর পানির সাথে সোনাতনীবাসীদের সহাবস্থান নয়াকৃষি অনুশীলনে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, ফসলের বৈচিত্র্যতা রক্ষা ও সামগ্রিকভাবে প্রাণবৈচিত্র্যের সমৃিদ্ধর ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।

নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের পুনরুদ্ধার করা বীজের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তার প্রয়াসের মধ্যে প্রধানত রয়েছে স্থানীয় জাতের আ্উশ ধান, আমন ধান, তিল, কাওন, মাসকলাই, খেসারী, পাট, শাকসবজি ও বিভিন্ন মসল্লা জাতীয় ফসল। আউশ ধানের জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে কালাবকরি, কালামানিক, ষাইটা ও ভাতুরি। আমন ধানের জাতগুলোর মধ্যে প্রধানত রয়েছে বকঝোল, ভাওয়াইলা, দীঘা, হিজলদীঘা, কার্তিকঝোল, লালঢেপা, সাদাঢেপা, পাতিশাইল ইত্যাদি। শস্যাবর্তন পদ্বতিতে মিশ্র ফসলের চাষ সোনাতনীবাসীদের চাষাবাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নয়াকৃষির সাথে সম্পৃক্ততার পর মিশ্র ফসলের চাষের ব্যাপকতার আরো অনেক সমৃদ্ধি ঘটেছে। কৃষকদের মিশ্র ফসলের এই চাষের সফলতা এলাকার অন্যান্য কৃষকদেরও উৎসাহিত করছে।


কৃষক

সিরাজগঞ্জ জেলার সোনাতনী ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে কাউন, তিল ও লাল ঢেপা আমন ধানের মিশ্র ফসল চাষ দেখাচ্ছেন কৃষক আনছার আলী।


ফাল্গুনের ১০ থেকে চৈত্র মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে কৃষকরা মাঠে আমন ধান, কাওন ও তিল একসাথে বুনে। চৈত্রের খরার সাথে ধান, কাওন ও তিল হাত ধরাধরি করে একসাথে বাড়তে থাকে। খরা যত প্রকট হয় তিল তত বাড়তে থাকে। বর্ষার পানি মাঠে আসার আগে আষাঢ় মাসের প্রথমে তিল ও আষাঢ় মাসের পরের দিকে কাওন ঘরে তোলা হয়। আষাঢ়ের পর বর্ষার সাথে মিতালির মধ্য দিয়ে আমন ধান বাড়তে থাকে।

চরবাসী নবান্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটতে শুরু করে। আমন ধান কাটার ১৫/২০ দিন আগে ধানের মধ্যে মাসকলাই / খেসারী বুনা হয়। জমি ধোপা (নীচু) হলে খেসারী এবং ডাংগা (উঁচু) হলে মাসকলাই ছি্টিয়ে দেওয়া হয়। মাঘ মাসে মাসকলাই এবং চৈত্র মাসে খেসারী তোলা হয়।

মিশ্র ফসলের চাষ প্রসংগে কৃষক লোকমান ব্যাপারী বলেন, “ মিশ্র চাষ করলে মাটি অনেক জোর পায়, মাটিকে তুলতুলা (নরম) করে। যার কারণে চাষ ছাড়াই ডাল বুইনা দেওন যায়। মাসকলাই ও খেসারাী মাটিকে ফাঁস (সার) দেয়, যার কারণে মাটি অনেক জোর পায়। পরবর্তীতে যে কোন ফসল ভাল হয়”।

কৃষক মরিয়ম বেগম, রেখা বেগম, আমোদ আলী ও গাজী প্রামাণিক বলেন, মিশ্র চাষে খরচ খুব কম হয়, ফলন বেশী হয়, খরচের তুলনায় আয় ভাল হয় ও মাটির জোর বাড়ে।

আমন ধান, কাওন, তিল ও পরবর্তীতে মাসকলাই ও খেসারী মিশ্র চাষের গত বছরের উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে কৃষকরা জানালেন, প্রতি বিঘা জমিতে বীজ, জমি চাষ, নিড়ানী, কাটা ও ফসল ঘরে তোলার শ্রমিকসহ মোট খরচ হয়েছে প্রায ৬,৪৯০ টাকা। এক বিঘা জমি থেকে ধান পাওয়া গেছে প্রায় ১০ মন, তিল ৫ মন, কাওন ১ মন ও মাসকলাই ৪ মন যাদের মূল্য ২৪,৮০০ টাকা। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে প্রকৃত আয় হয়েছে ১৮৩১০ টাকা।

আমন ধান, কাওন ও তিলের বিদ্যমান মাঠ ঘুরে দেখা গেল, নারী, পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে ফসলের মাঠ থেকে গবাদী পশুর জন্য ঘাস সংগ্রহ করছেন। ফসলের মাঠ নিড়ানী ও ঘাস সংগ্রহের এই দৃশ্য দেখে বোঝা গেল মিশ্র ফসলের এই চাষাবাদের সাথে গবাদী পশুপাখি লালন পালনের বিষয়টি অত্যন্ত সম্পর্কিত।

সবুজের সমারোহে বিশাল ফসলের মাঠের মাঝখানে আম, কড়াই ও নিম গাছ বেষ্টিত একটি উঁচু ভিটা। এই ভিটাটি কিরণের ভিটা হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। মাঠ ঘুরে আমরা কৃষকদের সাথে সভা করার জন্য কিরণের ভিটাতে বসলাম। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মাঠের কৃষকরা সভায় যোগ দিলেন। দক্ষিণের হিমেল হাওয়ায় প্রাণবন্ত, সমৃদ্ধ ও ফলপ্রসু হলো সভাটি। সভাশেষে কৃষকরা নদীতে গোসল করে ঘাসের ঝাকা নিয়ে বাড়ী ফিরে যাওয়ার দৃশ্যটি বাংলার সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলার শান্তিপ্রিয় রূপকে মনে করিয়ে দিল।

সোনাতনীর মিশ্র ফসল চাষের সফলতা আর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এলাকায় ও এলাকার বাইরেও এই মিশ্র ফসলের চাষ ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। মিশ্র ফসলের এই চাষের ব্যাপক বিস্তার ঘটুক এটাই সোনাতনীর কৃষকদের প্রত্যাশা।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।