নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য কর্মীদের ভূমিকা


প্রশিক্ষণ কর্মশালা

দেলদুয়ার উপজেলা পরিষদ, দেলদুয়ার উপেেজলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান বিভাগ, উবিনীগ ও স্বাস্থ্য আন্দোলন আয়োজিত নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক চারটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় টাংগাইলের বিষ্ণুপুর রিদয়পুর বিদ্যাঘরে। কর্মশালাগুলো অনুষ্ঠিত হয় ২ অক্টোবর, ৩ অক্টোবর, ৯ অক্টোবর ও ১০ অক্টোবর, ২০১৬। কর্মশালায় দেলদুয়ার উপজেলার নিরাপদ খাদ্যের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে বক্তব্য রাখেন, এস. এম. ফেরদৌস আহমেদ, উপজেলা চেয়ারম্যান, দেলদুয়ার উজেলা পরিষদ। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয় বিষয়ে কথা বলেন, ডাঃ মোঃ লুৎফুল কিবরিয়া, উপ পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা), টাঙ্গাইল। মা ও শিশু সুস্বাস্থ্যের জন্য করনীয় বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন নূসরাত রশিদ, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে বক্তব্য রাখেন কানিজ সুরাইয়া সুলতানা উপজেলা কৃষি অফিসার, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল। নিরাপদ খাদ্যের গুরত্ব ও স্বাস্থ্য বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে কথা বলেন, সৈয়দ ইবনে সাঈদ, সিভিল সার্জন, টাংগাইল। স্বাস্থ্য কর্মীদের ভুমিকা ও মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে উপস্থাপন করেন ফরিদা আখতার, সভাপতি, বিএফএসএন ও নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ। ড. রোকেয়া খানম, ন্যাশনাল এ্যাডভাইজার, এফএও ফুড সেফটি পোগ্রাম নিরাপদ খাাদ্যেল ৫টি চাবিকাাঠ নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন। মেহেদী হাসান, সহকারী কমিশনার ভূমি নিরাপদ খাদ্য আইন ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে বক্তব্য রাখেন। নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্যের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন ফরহাদ মজহার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উবিনীগ। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কৃষি ও খাদ্যের ভ’মিকা নিয়ে আলোচনা করেন ড. এম. এ. সোবহান, সভাপতি, বীজ বিস্তার ফাউনডেশন ও সদস্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক।

আরো বক্তব্য রাখেন, ডাঃ মোঃ মজনু মিয়া, মেডিক্যাল অফিসার দেলদুয়ার; মাসুদুল আমিন খান, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক ; আজিবুর রহমান, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক; উবিনীগের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জনি; ইন্সট্রাক্টর মোঃ হারুন -অর-রশিদ; ও দেলদুয়ার কৃষি উপসহকারী জাকিয়া সুলতানা। এছাড়াও পরিবার পরিকল্পনা সহকারী, সূর্যের হাসি ক্লিনিক সি এস পি, গ্রামীণ স্বাস্থ্য কর্মীরা তাদের মুল্যবান বক্তব্য রাখেন।


স্বাস্খ্য কর্মী প্রশিক্ষণ কর্মশালা টাংগাইল

প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী সদস্যদের একাংশ


প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করেন উবিনীগের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য সীমা দাস সীমু, জাহাংগীর আলম জনি, ও টাঙ্গাইল কেন্দ্রের সমন্বক রবিউল ইসলাম চুন্নু। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান বিভাগ, সূর্যের হাসি ক্লিনিক, দাই মাদের অংশগ্রহনে মোট ২৫৭ জন প্রতিনিধি প্রশিক্ষন কর্মশালায় অংশগ্রহন করেন।

ড. এম এ সোবহান বলেন, উবিনীগসহ ৫টি সংগঠন মিলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক। আমরা এক সময় খাদ্যের অভাবে কষ্ট পেয়েছি আর এখন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমনকি বিদেশে আমরা চাউল, মাছ, আম, সবজী রপ্তানী করছি। এইদেশে যে পরিবর্তন তা লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন। আমরা এখন তিনবেলা খেতে পারি। খাদ্যের কোন অভাব নেই। আমরা খাদ্য উৎপাদন করছি কিন্তু খাদ্য উৎপাদনের কিছু ভুলভ্রান্তি আছে। আজকে খাদ্য দুষনের কারনে বাংলাদেশে ৩০% লোক অসুস্থ হয় খাদ্য জনিত রোগে। খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে আমাদের খাদ্য নিরাপদ থাকছে না। খাদ্য কিভাবে নিরাপদ রাখব সেই নিরাপদ রাখার ধারনাটা আমাদের পরিষ্কার থাকতে হবে। আমরা যা কিছু খাই সুস্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকার জন্য। মাঠ থেকে টেবিল পর্যন্ত উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপে খাদ্য যেন নিরাপদ হয় সেই বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

লুৎফুল কিবরিয়া বলেন, পরিবার পরিকল্পনার বিভাগের সাথে নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে সম্পৃক্ততা আছে। আগে খাদ্য কম ছিল কিন্তু এখন মানুষ বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যে নিরাপদতার অভাব দেখা দিয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে খাদ্যের কোয়ালিটি চলে আসছে। টাঙ্গাইলে ২বছর আগেও এতো ফাস্ট ফুডের দোকান ছিল না। শিশুরা বিদ্যালয়ে যাবার পথে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্যাকেট খাবার কিনে খায়। বর্তমানে ছোট ছোট বাচ্চারা ডায়বেটিস, ক্যান্সার, গ্যাষ্ট্রিক, আলসার, কিডনী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এখানে এফ ডাব্লিউ এ, এফ ডাব্লিউ ভি, নারী স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা লক্ষ্য রাখবেন শিশু জন্মের পর না কাঁদলে কি করবেন?। বাচ্চা কাঁদলে বুঝা যাবে শিশুটি সুস্থ আছে। গাড়ি ষ্ট্রাট দিলে যেমন এটি চলার জন্য প্রস্তুত বুঝা যায় তেমনি শিশুও ১মিনিটের মধ্যে কাঁদলে হার্ট থেকে রক্ত ব্রেনে গিয়ে এর কাজ শুরু করে। ১মিনিটের মধ্যে না কান্না করলে ব্চ্চাা অস্বাভাবিক হবে। এই ১মিনিটকে বলা হয় গোল্ডেন মিনিট।

নুশরাত রশিদ বলেন, একজন গর্ভবতী মাকে গর্ভের পর বেশী বেশী খাবার খেতে হবে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। শিশুর জন্মের সময় মাকে সতর্ক হতে হবে। জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে শিশূকে শালদুধ খাওয়াতে হবে।


স্বাস্খ্য কর্মী প্রশিক্ষণ কর্মশালা টাংগাইল

নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক গান পরিবেশন করছেন নয়াকৃষির কৃষক আক্কাস আলী ও আরফান আলী


ফরিদা আখতার বলেন, খাদ্য নানাভাবে দূষিত হয়। যেমন: ফসলে কীটনাষক ব্যবহার, গরু পালনে বানিজ্যিক খাদ্য ও ওষুধের ব্যবহার, মুরগী পালনে বানিজ্যিক খাদ্য ও ওষুধের ব্যবহার, খাদ্য প্রক্রিয়ায় রাসায়ানিক পদার্থের ব্যবহার, খাদ্য তাজা রাখার জন্য রাসায়ানিক সারের ব্যবহার ও খাদ্য সুন্দর করার জন্য রংয়ের ব্যবহার। উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরন, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ, বিপনন সর্বক্ষেত্রে খাবার অনিরাপদ হতে পারে। মাত্র ৬ টি রোগ ৫৪% মৃত্যুর কারণ। ৪১ % অসুস্থতার কারণ ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিস, স্ট্রোক বা উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাস কষ্ট, ক্যান্সার, কিডনী। ফরমালিন, কার্বাইড ও কাপড়ের রং খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে। কাজেই আমাদের সবাইকে নিরাপদ খাবারের ব্যাপারে আরো সজাগ থাকতে হবে। খাদ্য যেমন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে আবার মারতেও পারে। নিরাপদ খাদ্যের জন্য নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী হচ্ছে। খাবার নিরাপদ হলে তা বেশী দামে মানুষ কিনছে। স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী হিসেবে আমাদের করণীয় হচ্ছে: খাদ্যবাহিত রোগ প্রতিরোধে সমন্বিত দায়িত্ব বন্টন, মানুষকে সচেতন করা, রোগী বাড়ছে না কমছে খেয়াল রাখা এবং কারণ খোঁজা এবং রোগের লক্ষণ দেখে সতর্ক হওয়া। মনে রাখতে হবে রোগ প্রতিরোধ ও রোগ নিরাময়ের জন্য নিরাপদ খাদ্য খুবই গুরত্বপূর্ণ।

ড. রোকেয়া খানম নিরাপদ খাদ্যের ৫টি চাবিকাঠি নিয়ে তিনি ব্স্তিারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, খাদ্যেল ৫ টি মূল চাবিকাঠি হচেছ:

এক: পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: খাদ্য তেরী ও নাড়াচাড়ার আগে হাত ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে। পায়খানার আগে ও পরে হাত ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে। খাবার তেরীর উপকরণ ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

দুই: কাঁচা ও রান্না করা খাবার আলাদা রাখুন: কাঁচা খাদ্য নাড়াচাড়ার জন্য আলাদা সরনজামাদি যেমন: দ, বটি, থালা বাসন ইত্যাদি ব্যবহার করুন। রান্না করা খাদা কাঁচা খাদ্য থেকে দূরে আলাদা পাত্রে সংসক্ষন করুন।

তিন: সঠিকভাবে রান্না করুন: খাদ্য সঠিকভাবে সিদ্ব করে রান্না করুন। তৈরী খাদ্য ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সিদ্ব করুন। রান্না করা সংরক্ষিত খাদ্য খাওয়ার আগে ভালভাবে গরম করুন।

চার: নিরাপদ তাপমাত্রায় খাদ্য সংরক্ষন করুন: খাদ্যদ্রব্য নিরাপদ তাপমাত্রায় ২ ঘন্টার বেশী রাখা যাবে না। রান্না করা খাদ্য পরিবেশনের পূর্বে তাপ ওঠা পর্যায়ে গরম করুন।

পাঁচ: নিরাপদ পানি ও খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করুণ: নিরাপদ পানি ব্যবহার করুন, টিউরওয়েল ও ফুটানো পানি নিরাপদ। টাটকা ও মানসম্পন্ন খাদ্য ব্যবহার করুন। ফলমূল, শাকসব্জি কাঁচা খেতে হলে অত্যস্ত ভালভাবে ধুয়ে নিন

সেনেটরি ইন্সপেক্টর পুতুল রানী সাহা বলেন, খাদ্যের ভেজাল আমি মাঠ পর্যায়ে দেখি ও পরিক্ষা করি। প্যাকেটজাত খাবারে বেশি ভেজাল থাকে। গুড়া হলুদে ইটের গুড়া, মরিচে ইটের গুড়া, ধনিয়াতে ধানের কুড়া এমনকি রাধুনী গুড়া হলুদে পরীক্ষা করে ভেজাল পাওয়া গেছে। বাচ্চাদের হাত ধোয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। রান্নার সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাসনপত্র ব্যবহার এবং নিজে পরিষ্কার থাকতে হবে। বাইরের খাবার খাওয়া যাবে না। বাচ্চাদের সুস্থ রাখতে হলে ঘরে তৈরী খাবার দিতে হবে। আইন করে কাজ হবে না যদি আমরা নিজেরা সচেতন না হই।

সিভিল সার্জন সৈয়দ ইবনে সাঈদ বলেন, মায়ের যত্ন নিতে হবে। মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। সুষম খাদ্য ৬টি খেতে হবে। দুধে এর সবগুলো উপাদান আছে। বাচ্চার ১হাজার দিন যত্ন নিতে হবে। গর্ভে ২৭০দিন, মায়ের যত্ন ২৫০০ক্যালরি খাবার বেশি খেতে হবে। ডেলিভারী মায়ের যত্ন মাকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে। শিশু জন্মের ১ঘন্টার মধ্যে শালদুধ খাওয়াতে হবে।

ফরহাদ মজহার সকল অংশগ্রহনকারীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা হিসেবে বাস্তবায়নের জন্য উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নয়াকৃষি আন্দোলন গ্রাম পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে। দেলদুয়ার উপজেলা পৃথিবীর মানচিত্রে নিরপদ খাদ্য উপজেলা হিসেবে একটি সফল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

মাসুদুল আলম খান বলেন, আজকে যে প্রশিক্ষণ কর্মশালা হচ্ছে এটা সময়ের দাবি, যুগের দাবি। বর্তমানে খাদ্য বলতে টাকা দিয়ে আপদ কিনে খাই। আমি নিজেও ফুড পয়জনের স্বীকার হয়েছি। বিজ্ঞানে পড়েছি ফর্মালিন বিষয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা , গবেষণা কাজে ফর্মালিনেরে ব্যবহার আর এখন মাছ, মাংস এসব পচনশীল খাদ্য সংরক্ষণ করতে ফর্মালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। যা মানব স্বাস্থ্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধান ক্ষেতে আগাছানাশক বিষ ব্যবহার করে ধানকে বিষাক্ত করা হচ্ছে। ফলে এসব ধানের ভাত খেয়ে ডায়বেটিস রোগ হচ্ছে। ধান ক্ষেতে ঝাটা না গেড়ে বাসুডিন, ফুরাডান বিষ স্প্রে করা হয়। ১৯৬০শতক থেকে এফপিআই কাজ শুরু করে। ১৯৭১ সালের পর এফডাব্লিউএ নেওয়া হলো। স্বাস্থ্য সচেতনার কারনে শিশু মৃত্যু রোধ হয়েছে। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। মানব সেবা বড় ধর্ম। যার ভেতরে গুণ নাই তার ধর্ম নাই। নিজ, সমাজ, দেশের প্রয়োজনে এই কাজগুলি করা উচিত।

দিলরুবা বেগম সিএসপি-সূরর্যর হাসি বলেন, জানা শেখার শেষ নাই। আজকের নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রশিক্ষণ থেকে অনেক কিছু শিখলাম। আমরা গ্রাম পর্যায়ে মা, শিশু, সক্ষম নারীদের সেবা দেই তাদের এই বিষয়ে জানাব। তারা যেন পরিষ্কারভাবে রান্না করেন। নিজের হাতের তৈরী করা খাবারই নিরাপদ। শিশূদের যেন বাইরের খাবার খাওয়া থেকে বিরত রাখেন। শিশুদের হাত ধোয়া অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে মায়েদের বলব নিরাপদ খাদ্য মানে নিজেরা বাড়িতে শাকসবজী উৎপাদন করে খাবেন।

গোয়ারিয়া গ্রামের দাইমা সুফিয়া বলেন, সার-বিষ ছাড়া ফলানো ফসল নিরাপদ। আমরা গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য সেবার কাজ করি। সবাইকে নিজের হাতে তৈরী করা নিরাপদ খাদ্য খেতে বলব। সার-বিষ দিলে খাদ্য নিরাপদ থাকে না। দেশী মাছ, শাকসবজী তৈরী করে খেতে হবে। এসব খাবারে পুষ্টিগুণ বেশী।

খন্দকার রেহেনা এফডাব্লিউএ, বলেন, আমরা মা, শিশুদের সেবার পাশাপাশি দম্পত্তিদের সেবা দেই। এই বিষয়ে তাদের ধারণা দেব। আমরা গ্রামে ডোর টু ডোর সেবা দেই। মায়েদের বলব দুষিত খাবার খেলে অসুস্থ হয়। নানান রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। নিরাপদ খাদ্য খাওয়ার মধ্য দিয়ে সব্ইাকে সুস্থ থাকতে হবে।

জাঙ্গালিয়া সূর্যের হাসি ক্লিনিকের রুবি বেগম বলেন, গর্ভবতী মায়েদের বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন। কচুশাক, হেলেঞ্চা, পুষ্টিকর খাবার। এসব খাবার খেলে মা শিশু সবাই সুস্থ থাকবে।

নাল্লাপাড়া গ্রামের আছিয়া বেগম বলেন, আমরা নিরাপদ খাবার যেমন ধান, ডাল, কচুরলতি, বেগুন, শসা, ধুন্দুল, মিষ্টিকুমড়া, বিষছাড়া নিজেরা উৎপাদন করে খাই। আমরা গ্রামে স্বাস্থ্যসেবার কাজ করি। সবাইকে সার-বিষ ছাড়া নিরাপদ খাবার উৎপাদন করে খাওয়ার পরামর্র্শ দেই। কারণ এসব খাবারে পুষ্টি বেশী।

মোঃ আজিবুর রহমান বলেন, শিশুদের সময়মত পরিচর্যা করতে হবে। বাচ্চা ডেলিভারী হওয়ার পর কান্না করবে। জন্মের এক মিনিটের মধ্যে কান্না করবে। এই সময়কে বলা হয় গোল্ডেন ওয়ান মিনিট। ডেলিভারী জনিত জটিলতার কারনে বাচ্চা প্রতিবন্ধী হতে পারে। গর্ভবতী হওয়ার ৪ মাস, ৬ মাস, ৮মাস, ৯ মাসে বয়সে চারবার ডাক্তার চেকাপ করাতে হবে। শিশুর বয়স ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ানো যাবে না।

সেনেটারী ইন্সপেক্টর পুতুল রানী সাহা বলেন, নিরাপদ খাবার বলতে আমরা কি বুঝি? যে খাবার খেলে আমাদের শরীরের কোন ক্ষতি করে না সেই গুলো নিরাপদ খাবার। যা স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী সেটা নিরাপদ খাবার। আর ভেজাল খাবার হলো যে খাবারে যে গুণ থাকার দরকার তা না থাকা। দুধের মধ্যে পানি মেশানো, ক্রিম তুলে নেওয়া সেইটা ভেজাল। আমরা অনেক ধরনের ভেজাল খাবার খাচ্ছি। এই জন্য জন্য সচেতনতার দরকার। দেলদুয়ার উপজেলায় ২৬টি বাজার আছে। এই ২৬টি বাজারের দোকানে অভিযান চালালে অধিকাংশ দোকানই বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা গ্রামের মানুষ শহরের লোকদের চেয়ে অনেক ভাল খাবার খাই। খাবার তৈরীর ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা আমাদের অনেক বড় রোগ থেকে রক্ষা করে। বাচ্চাদের হাত ধোয়ার নিয়ম শেখাতে হবে। সবজী কাটার আগে ভালভাবে ধুতে হবে। কাটার পর সবজী ধুইলে সব পুষ্টিগুণ পানির সাথে চলে যায়। আপনারা যত সম্ভব পারেন বাড়ির তৈরী করা খাবার খাবেন, বাইরের খাবার খাবেন না। ধনিয়ার গুড়াতে ধানের কুড়া, হলুদে ইটের গুড়া মিশানো হয়। প্রসূতি মায়েদের বিদেশী ফল খাওয়াবেন না। মা সুস্থ হলে বাচ্চা সুস্থ থাকবে। আমারা নিজেরা সচেতন হব,অন্যকে সচেতন করব। দেহ সুস্থ রাখব।

জাহাঙ্গীর আলম জনি বলেন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে জনসচেতনতামুলক কার্যক্রম ও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিয়ে কাজ করে এমন ৫টি সংগঠনের একটি নেটওয়ার্ক। এফএও এর সহযোগিতায় দেশব্যাপী নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণয়ন করা হয়। আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। দেলদুয়ার উপজেলার চেয়ারম্যান জনাব এস এম ফেরদৌস আহম্মেদ ২০১৫সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর দেলদুয়ার উপজেলাকে নিরাপদ খাদ্য উপজেলা হিসেবে ঘোষনা দেন। যদি আমরা এই ঘোষনা বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে সকলের অংশগ্রহণ দরকার। এখন আমাদের মুল কাজ হলো খাদ্য নিরাপদ রাখা। যে খাবার আমরা খাব সে খাবারটা যেন নিরাপদ হয়। দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা হিসেবে বিশ্বে অনেক বেশি পরিচিতি পেয়েছে। তাই আপনাদের দায়িত্ব অনেক বেশী। আমরা খাদ্য উৎপাদন করছি কিন্তু খাদ্য উৎপাদনের কিছু ভুলভ্রান্তি আছে। খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে আমাদের খাদ্য নিরাপদ থাকছে না। খাদ্য কিভাবে নিরাপদ রাখব সেই নিরাপদ রাখার ধারনাটা আমাদের পরিষ্কার থাকতে হবে। আমরা যা কিছু খাই স্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকার জন্য। মাঠ থেকে টেবিল পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে ভৌত দূষণ, রাসায়নিক দূষণ ও জৈব দূষণ থেকে খাবারকে আমাদের নিরাপদ পাখতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জনাব হারুন- অর-রশিদ বলেন, আমি বিভিন্ন পর্যায়ে সভা করি। আমি অনেক মা সমাবেশে উপস্থিত থাকি। ঐসব সমাবেশে নিরাপদ খাদ্য বিষয় তুলে ধরব। আমি স্বাস্থ্য বিষয়ে এতো কিছ জানতাম না। এই কর্মশালায় থেকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি। শিক্ষার আলো না থাকলে কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। প্রত্যেক মায়েদের ছেলে-মেয়ে নিয়ে স্বপ্ন থাকা দরকার। আমি শিক্ষকদের বলব মা সমাবেশে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে আলোচনা করতে। তাহলে গ্রামের প্রত্যেক মায়েদের কাছে মেসেজটি পৌছে যাবে। এতে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে।

এফ ডাব্লিউ সি অলিভিয়া আকতার বলেন, একজন মা স্বাস্থ্য পরামর্শ অনুযায়ী চললে রোগ-ব্যাধি কম হবে। গ্রামে অনেক পরিবার আছে যারা টিকা সম্পর্কে জানে না। আমরা মা ও শিশু, কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে থাকি। একজন মেয়ের ৫টি টিকা দরকার। টিকা যদি না দেয় তার গর্ভে বাচ্চা আসলে সেই বাচ্চার বড় ধরনের রোগ থেকে বাঁচাতে পারবে না। একজন গর্ভবতী মাকে গর্ভাবস্থায় কমপক্ষে চারবার চেকাপ করাতে হবে। গর্ভবতী মাকে পুষ্টিকর নিরাপদ খাবার খাওয়া খুবই প্রয়োজন।

সূর্যের হাসি প্রতিনিধি আল-আশরাফুল আলম বলেন, আমরা গর্ভবতী মাকে দেশীয় ফল এবং আয়োডিনযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেই। শিশু জন্মের পরপর মায়ের বুকের শালদুধ খাওয়ার কথা বলি। জরায়ুতে ক্যান্সার প্রতিরোধের টিকা আমরা সূর্যের হাসি থেকে দিয়ে থাকি। বিনা খরচে গর্ভবতী মায়েদের ডেলিভারী করানো হয়। আজ এখানে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে অনেক জ্ঞান অর্জন করলাম। গ্রামে উঠান বৈঠকের সময় এই বিষয়ে আলোচনা করব।

গ্রামীন নারী স্বাস্থ্য কর্মী খাদিজা বেগম বলেন, আমরা গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার কথা বলি। তাদের টিকা এবং কমপক্ষে চারবার চেকাপ করানোর পরামর্শ দেই। বাড়ির আঙিনায় বিষমুক্ত শাক-সবজী উৎপাদনের কথা বলি। তাদের ৫টি ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করি। আজকে নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে আলোচনা থেকে ফর্মালিনের ক্ষতিকর দিক, অসংক্রামক রোগ, বাইরের খাবার স্বাস্থ্যের জন্য মারাতœক ক্ষতিকর তা জানলাম। এসব বিষয়ে গ্রামের মানুষকে সচেতন করব।

ফাহিমা খাতুন লিজা-গবেষক, উবিনীগ বলেন,আমরা যে খাদ্য খাই শরীরের প্রয়োজনে এবং বেঁচে থাকার জন্য আর এই খাদ্য আসে বিভিন্ন গাছপালা, মাছ, গরু, ছাগল, মুরগী, পশু-পাখি বিভিন্ন উৎস থেকে। এসব উৎস থেকে ভিটামিন, প্রোটিন, আমিষ, শর্করা পেয়ে থাকি। খাদ্য উৎপাদন থেকে টেবিল পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। খাবার ধাপে ধাপে অনিরাপদ হয়ে থাকে। বিষ, ফর্মালিন, বাইরের তৈরী প্যাকেটজাত খাবারের কারনে অসংক্রামক রোগ বেড়ে গেছে। আনারস, কলা, মাছ, ফর্মালিনের ব্যবহার, নুডলস, চিপস, বাচ্চাদের খাবারে কাপড়ের রং ব্যবহার ইত্যাদি দূষিত খাবার খেয়ে অসংক্রামক রোগ হচ্ছে। ৫৪% অসংক্রামক রোগে ৬% মানুষ মারা যায়। কাঁচা দুধ, কাঁচা ডিম, লাল মাংস এসব খাবারে সালমোনিলা নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে যা টাইফয়েড রোগের জন্য দায়ী। বিদেশে সেফ ফুডের অনেক চাহিদা আছে। তারা খাবার রান্না, কাটার ক্ষেত্রে অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে। বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা, সভা, সেমিনার হচ্ছে। যারা স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়ির তাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। রোগ হওয়ার পর রুগীরা চিকিৎসা নিতে যান। চিকিৎসা নিতে গেলে রোগ যাতে না হয় স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন তার পরামর্শ দিলে রোগ কমে যাবে। মানুষ সচেতন হয়ে নিরাপদ খাবার খাবে। সুস্থ থাকবে।

দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা বাস্তবায়নে প্রস্তাবনা

১. নিরাপদ খাদ্যের প্রচার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে করতে হবে।
২. উপজেলা চেয়ারম্যান বা উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে বাজার ভেজাল খাদ্যের তদারকির ব্যবস্থা করা
৩. নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিভিন্ন লিফল্টে, পোষ্টার ও প্রকাশন বের করা
৪. খাদ্যে ফর্মালিন ব্যবহারকারীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা
৫. রাসায়নিক সার-বিষ ব্যবহার না করে জৈব সার প্রস্তুত প্রণালী শেখানো
৬. মসজিদের ইমাম, গ্রামের মাতব্বর,নেতা সবাইকে নিরাপদ খাদ্য উপজেলা বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত করা
৭. প্যাকেটজাত খাবার থেকে বাচ্চাদের বিরত রাখতে হবে
৮. নিরাপদ খাদ্য চাষ থেকে খাবার টেবিল পর্যন্ত প্রত্যেটি ধাপে খাদ্য নিরপদ রাখার জন্য সব্ইাকে একসাথে কাজ করতে হবে।
৯. মাটি ও পানি দূষণ রোধ নিশ্চিত করা
১০. স্বাস্থ্য কর্মীরা উঠান বৈঠকে নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে আলোচনা সবাইকে সচেতন করা
১১. নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ের মেম্বার, চেয়ারম্যানদের ভূমিকা পালন করতে হবে।
১২. .জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে
১৩. আর্সেনিকমুক্ত নিরাপদ পানি পান করতে হবে
১৪. মা সমাবেশে শিক্ষকরা নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে যেন আলোচনা করেন
১৫. প্রতিটি স্কুলের শিক্ষকদের নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে
১৬. গৃহিণীদের নিরাপদ খাদ্য রান্নার উপর উঠান বৈঠক করতে হবে
১৭. বাজার কমিটির লোকদের নিয়ে সভা করতে হবে
১৮. যারা খাবার ভেজাল করে তাদের জরিমানার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
১৯. নিরাপদ খাদ্য আইন -২০১৩ বাস্তবায়ন করতে হবে
২০. দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা ঘোষণা দিবস নিয়মিত পালন করতে হবে।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।