জেনে শুনেই বিষ খাচ্ছি প্রতিদিন


রাজধানীর বাদমতলীর কলার মোকামে স্প্রে এবং হিট দিলে রাতারাতি পেকে যায় কাঁচাকলা

মিষ্টি ফলের মাস জ্যৈষ্ঠ। বাজারে পাওয়া যাচ্ছে আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, বেল, জামরুল, তরমুজ ও কলাসহ নানা রকম ফল। দেখতে সুন্দর, খেতেও মজাদার কিন্তু বাজারের এসব ফল কতটা নিরাপদ এ প্রশ্ন সবারই। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন সরকারি কিংবা বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিগত এক দশকের তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, মৌসুমি ফলগুলোর অধিকাংশই পাকানো হয় রাসায়নিক উপাদান দিয়ে। অধিক মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা কাঁচা ফলই ক্ষতিকারক রাসায়নিকের মাধ্যমে পাকিয়ে বাজারে নিয়ে আগাম আসেন। এর ফলে স্বাস্থ্যগত দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ক্রেতা বা ভোক্তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো ফল খেয়ে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে বদহজম, পেটের পীড়া, পাতলা পায়খানা, জণ্ডিস, গ্যাস্টিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনির সমস্যার মতো জটিল রোগের শিকার হচ্ছে তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব রাসায়নিক পদার্থের কারণে মহিলারা বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দিতে পারেন। শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া রাসায়নিক দ্রুত মেশানোর কারণে ফলের পুষ্টি ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।

কলায় স্তরে স্তরে বিষ

কলা নয় যেন বিষের দলা। সেটাই খাচ্ছি প্রতিদিন। কলার কাদি কাটা থেকে আরম্ভ করে বাজারজাত করা পর্যন্ত স্তরে স্তরে দেয়া হয় তরল বিষ। দেখতে সুন্দর এবং হলুদ রঙের কলাগুলোই বাজার থেকে কিনে খাচ্ছেন সবাই। মাঠ পর্যায়ে কলা চাষীদের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, কাদি কাটার আগ পর্যন্ত ভাইরাস তাড়ানোর নাম করে স্প্রের মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে নানা কীটনাশক। এরপর কলাগুলো রাজধানীতে প্রবেশের আগে পাইকাররা আরেক দফায় স্প্রের মাধ্যমে নানা ধরনের কীটনাশক মেশান। চাষীরা জানান, তারা স্প্রের মাধ্যমে মার্শাল, হিলডন, রাইজার, বাসুডিনসহ আরও অনেক ধরনের ওষুধ ছিটান কাঁচা কলায়। কলার পাইকার ও কৃষক দাবি করেন, এসব মাখালে কোনো ক্ষতি হয় কিনা তারা জানেন না। তবে স্প্রে করলে কলা দ্রুত পেকে যায়। এছাড়া বিভিন্ন মেডিসিন মিশ্রিত পানিতে কলার পানা ডুবিয়ে পরে জাগ দিয়েও পাকান হচ্ছে মানব দেহে আয়রনের ঘাটতি পূরণে অতি প্রয়োজনীয় ফলটি। কলাগুলো সুন্দর আর স্পটমুক্ত করতেও ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের রাসায়নিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ফলগুলো না পাকা অবস্থাতেই গাছ থেকে পেরে এনে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইথিলিন, রাইপেন, ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিচ্ছে। এই ফলগুলো খাওয়ার ফলে পাকস্থলীতে এসিডের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। পাকস্থলীতে যদি কোনো ক্ষত থাকে সেটি আরও বেড়ে যায়। সেখান থেকে ক্যান্সারও হতে পারে।

আনারসেও কেমিক্যাল

আনারসের জন্য টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলা বিখ্যাত। মধুপুর থেকে এই মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ২০০ ট্রাকভর্তি আনারস রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে সরবরাহ করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আনারস দ্রুত বর্ধন এবং পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হয় হরমোনাল রাসায়নিক। আনারসের রং সুন্দর করার জন্য দেয়া হয় রাইপেন বা ইথোফেন। সাধারণত, আনারস প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠতে এবং খাবার উপযোগী হতে সময় লাগে তিন মাস। কিন্তু বেশি লাভের আশায় দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে চাষীরা ব্যবহার করছেন রাসায়নিক। ইথাইলিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রয়োগের কারণে ২-৪ দিনের মধ্যেই ফল হলুদ রং ধারণ করে। আর ফল পাকাতে যে বিপজ্জনক রাসায়নিক পর্দাথটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় তার নাম কার্বাইড। স্থানীয় বাজারে কীটনাশকের দোকানে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে রাইপেন, টমটম, প্যানোফিক্স, সুপারফিক্স নামক কেমিক্যালগুলো।

এসব কেমিক্যাল ব্যবহারে ফুলেফেপে বড় হয়ে ওঠে আনারস। এরপর সেই আনারসে ইথোফেন স্প্রে করা হয়। ফলে অল্প সময়ে পেকে যায় আনারস। সবশেষে স্প্রে করা হয় ফরমালিন। এতে অসময়ে পাকানো আনারস পচনের হাত থেকে রক্ষা পায়। ফরমালিন স্প্রের পরদিন কাটা হয় আনারস। এভাবেই আনারসেও মেশানো হচ্ছে বিষ।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভোক্তারা খুবই অসহায়। সাধারণ ভোক্তার অসহায়ত্ব দূর করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, আইন এবং শাস্তি আরও ব্যাপক জনমুখী, গণমুখী হওয়া দরকার। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা, মাঠ পর্যায়ের জরিপ, বাস্তব অবস্থা, ভোক্তার স্বার্থবিনাশী সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ থাকতে হবে। তবে ভোক্তার স্বার্থরক্ষার গুরুদায়িত্বটি সরকারের হাতে। শুধু নিয়ম রক্ষার কাজ করলেই হবে না। 

তরমুজে বিপজ্জনক রং

গ্রীষ্মের রসালো ফল তরমুজ। সুস্বাদু এ ফলটি গরমে কাহিল মানুষের যেমন তৃষ্ণা মেটায় তেমনি আনে স্বস্তি। শহরবাসী অথবা গ্রামের মানুষ সবাই কমবেশি তরমুজ খেতে পছন্দ করেন। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পানি। তরমুজে শতকরা ৬ ভাগ চিনি এবং ৯২ ভাগ পানিসহ অন্যান্য ভিটামিন জাতীয় উপকরণ রয়েছে। ফলটির পুষ্টিগুণ যেমন তেমনি দেশি ফলের ভেতরে দামও তুলনামূলক কম থাকায় গরমে স্বস্তি দিতে তরমুজের জুড়ি নেই। তরমুজের মতো সহজলভ্য ফলেও এখন মেশানো হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান। তরমুজকে পাকা এবং লাল দেখানোর জন্য মেশান হচ্ছে বিপজ্জনক লাল রং ও মিষ্টি স্যাকারিন। ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমে তরমুজের বোঁটা দিয়ে এসব দ্রব্য পুশ করে তরমুজ পাকা ও লাল টকটকে বলে বিক্রি হচ্ছে। ক্ষতিকারক দ্রব্য মেশান এ ধরনের তরমুজ খেয়ে সারা দেশে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ অসুস্থ হওয়ার বেশ কিছু ঘটনা সম্প্রতি খবরে আসছে।

জানা যায়, শহরের ফলের আড়তগুলোতে ব্যবহৃত পুরনো ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমে ভোরবেলায় বিষাক্ত লাল রং ও মিষ্টি স্যাকারিন পানি পুশ করা হচ্ছে। আর এ তরমুজগুলোই দোকানে ছুরি দিয়ে কেটে পাকা দেখিয়ে বেশি দাম আদায় করা হয়। সেইসঙ্গে তরমুজ যাতে তাড়াতাড়ি নষ্ট না হয় সে জন্য মেশানো হয় কেমিক্যাল।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন গবেষক জানান, রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বিষাক্ত রং। ইফতারির বেশিরভাগ আইটেমেই নানা ধরনের রং মিশিয়ে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করে তোলা হয়। এছাড়া যত রকম গুঁড়া আইটেম আছে সেগুলোতেও সহজে ভেজাল মেশানোর সুযোগ থাকে। মিষ্টি ও তৈলাক্ত আইটেমেও ভেজালের প্রবণতা দেখা যায় রুটিন পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। ভাজা আইটেমেও রাসায়নিক মেশানো হয়।

ফলে মাছি বসাতেও কেমিক্যাল

ফলের মধ্যে ফরমালিন মেশানো হলে তার ওপর মাছি বা এ ধরনের পোকা বসে না। এতে ফল কেনার ক্ষেত্রে অনেক ক্রেতাই সতর্ক হয়ে যান। তাই সচেতন ক্রেতাদের ফাঁকি দিতে ব্যবসায়ীরা নিয়েছেন নতুন কৌশল। মাছি আকর্ষণ করতে তারা এখন মেশাচ্ছেন নতুন আরেক ধরনের বিষাক্ত কেমিক্যাল। এর ফলে একদিকে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা, অন্যদিকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। পুরান ঢাকার স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ফলের ওপর আগে মাছি ভনভন করত। এখন আর সেগুলোর আশপাশে কোনো মাছি বসতে দেখি না। শুনেছি কেমিক্যালের গন্ধে ফলের ওপর মাছি বসে না। তাই যেসব ফলের ওপর মাছি বসছে, সেগুলো বেছে বেছে কিনছি। তবে শুনছি নতুন আরেক ধরনের কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে যাতে ফলের ওপর পোকা বসে। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

‘ফরমালিনমুক্ত’ ব্যানারের পসরা

ভোক্তাদের ফরমালিন ভীতির সুযোগ নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিশেষ করে ফল উৎপাদন হয় এমন এলাকাগুলোতে এক শ্রেণীর মতলবি ব্যবসায়ী ‘ফরমালিনমুক্ত ফলের দোকান’ এরকম ব্যানার টানিয়ে ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কিন্তু কেউ বলতে পারেন না, দোকানের ফলগুলো যে ফরমালিনমুক্ত তার গ্যারান্টি কী? কেননা সত্যিকার অর্থে, ফরমালিন শনাক্ত করার কথা মুখে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সে রকম কোনো উদ্যোগ বা চিত্র কোথাও চোখে পড়ে না।

বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত প্রতি বছর ৪৫ লাখ মানুষ

কিছুটা অবাক করার মতো তথ্য হলেও অর্ধেকেরও বেশি খাদ্যে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। চরম হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য। চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজাল খাবারের ফলে শুধু এই প্রজন্মই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও। ক্রমাগত ভেজাল খাবার গ্রহণের ফলে পুরুষত্বহীন, পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে প্রতি বছর ৪৫ লাখেরও অধিক মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

সম্প্রতি সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের গবেষণাগারে ৪৩টি খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। গবেষণাগারে পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব পণ্যের মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনার মধ্যে ৪০ শতাংশই অর্থাৎ ২ হাজার ১৪৭টি নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত ও ভয়াবহ ভেজালের উপস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি খাদ্যপণ্যের নমুনায় শতভাগ ও প্রায় শতভাগ ভেজালের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। ভেজালযুক্ত এসব খাদ্যপণ্যের মধ্যে রয়েছে- মধু, মিষ্টি, ঘি, রসগোল্লা, ডালডা, দধি, সেমাই, ছানা ও ছানার মিষ্টি, চাটনি, জুস, লজেন্স ইত্যাদি। এর বাইরে প্রায় ৮০ শতাংশ ভেজালের অস্তিত্ব রয়েছে অতি ব্যবহার্য ভোজ্য তেলে। এর মধ্যে সয়াবিনে ভেজালের উপাদান পাওয়া গেছে ৭৮ ভাগ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, রোজা আসলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল ও বিষাক্ত উপাদান মিলিয়ে কম মূলধনে বেশি মুনাফা লাভের চেষ্টা করে। এসব ভেজাল ও বিষাক্ত উপাদান স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। ভেজালের বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষ পুরো রমজানে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় থাকেন। এবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ভেজালবিরোধী ব্যাপক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রতিনিয়ত ঢাকাসহ সারা দেশে অভিযান চলছে।

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ভোক্তার নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’ কার্যকর করেছে সরকার। আইন অনুযায়ী খাদ্যে ভেজাল মেশালে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। ইতিমধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’-এর কার্যক্রম শুরু করেছে।

লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে (যুগান্তর ৬ জুন ২০১৭) থেকে: জেনে শুনেই বিষ খাচ্ছি প্রতিদিন

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।