বালাইনাশক ‘ইনডোসালফেন’ মারত্মক হুমকি


বাংলাদেশে শস্য উৎপাদন করার জন্য বিভিন্ন ডিগ্রি ও মাত্রার রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন রকম রাসায়নিক বালাইনাশকের মধ্যে এনডোসালফেন (endosulfan) একটি মারাত্মক বালাইনাশক। এই এনডোসালফেন বিষক্রিয়ায় ২০১২ সালে দিনাজপুরে লিচু বাগানের লিচু খেয়ে ১৩ জন শিশু অকালে প্রাণ হারায়।

দেখুন প্রতিবেদন।

১৩ শিশুর মৃত্যু কীটনাশক দেওয়া লিচু খেয়েই
যে বিষাক্ত কীটনাশকের কারণে দিনাজপুরের ১৩শিশুর মৃত্যু

বাংলাদেশে এনডোসালফেন ব্যবহারঃ ‘এনডোসালফেন’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ রাসায়নিক পেস্টিসাইড। ‘এনডোসালফেন’ এর বিভিন্ন বাণিজ্যক নামের মধ্যে ‘থাইওডন’ বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল। সেটাও এখন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ‘এনডোসালফেন’ নিষিদ্ধ করা হলেও, মে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ কৃষি অধিদ্প্তর এগ্রো-বিজনেস কোম্পানিকে ‘এনডোসল’ (Endosol)’ আমদানীর অনুমতি দেয় (নিউ এইজ ৩১ জুলাই, ২০১৭)। ‘এনডোসল’, এনডোসালফেনের আর একটি বানিজ্যিক নাম।

২০১৩ সালে এটোমিক এনার্জি’র এক গবেষণায় বিভিন্ন সবজিতে ‘এনডোসল’ ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়। এটোমিক এনার্জি ঢাকা শহরের বিভিন্ন সবজি বাজার থেকে বিভিন্ন সবজি নমূনা সংগ্রহ করে এবং সেসব পরীক্ষা করে সেখানে এনডোসলের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের চা বাগানেও এনডোসল ব্যবহার করা হয়। শুধু লিচু নয়, বিভিন্ন সবজি, ফল, চা, চিংড়ি চাষে ব্যাপকভাবে ‘এনডোসল’ ব্যবহার হচ্ছে। (নিউ এইজ ৩১ জুলাই, ২০১৭)।


Litchi endosulfan


এনডোসালফেন কি?
এনডোসালফেন অরগানোক্লোরিন (organochlorine insecticide and acaricide) গোত্রের একটি তিব্র বিষ। এটি কীটনাশক ও ক্ষদ্র মাকর নাশক হিসেবে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বালাইনাশকের শ্রেণীকরণ হিসেবে ক্লাশ-১ বালাইনাশক। এর অর্থ তিব্র বিষাক্ত। এনডোসালফেন এর রাসায়নিক ফর্মূলা (C₆H₆Cl₆O₃S)। বর্তমানে ইউরোপিয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে বাতিলকৃত (banned) বালাই নাশক। ১৯৫০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্টের হয়েস্ট (Hoechst) নামে রাসায়নিক কোম্পানি এ বালাইনাশক প্রস্তুত করে। হয়েস্ট রাসায়নিক কোম্পানির বর্তমান নাম সানোফি (Sanofi)। ১৯৫৪ সালে এনডোসালফেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রয়ের জন্য অনুমোদন পায়। ২০০২ সালে এনডোসালফেন ব্যবহারের কারণে মানুষের স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, মাছ, পানি, জীব-অণুজীব মারাত্মক ভাবে ক্ষতির কারণ প্রমাণিত হবার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্টে নিষিদ্ধ করা হয়।


endosulfan


এনডোসালফেন ডিডিটি’র মতো বিষাক্ত, কমপক্ষে তিন পুরুষ পর্যন্ত এর বিষক্রিয়া কর্মক্ষম থাকে। এনডোসালফেন বিভিন্ন বাণিজ্যিক নামে বাজারজাত করা হয়, যথা- এ্যাফিডন (Afidan), বিওসিট (Beosit), এন্ডোসেল (Endocel), এন্ডোসাইড (Endocide), এন্ডোসল (Endosol), হিলডন (Hildan),ইনসেক্টোফেন (Insectophene), ম্যালিক্স (Malix), থাইফর (Thifor), থাইওনিক্স (Thionex) এবং থাইওডন (Thiodan)। এসব নাম ব্যতিত আরোও নাম রয়েছে।

এনডোসালফেনের ব্যবহারঃ এটি সারা পৃথিবীতে কৃষিতে ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হতো। ব্যাপক ব্যাবহৃত ফসলগুলো হচ্ছে-দানাশস্য, সবজি, আপেল, টমেটো, বেগুন, করলা, তরমুজ, আম, তুলা চা’পাতা, তামাকসহ বিভিন্ন খাদ্য শস্য, ফলমূল এবং খাদ্য বর্হিভূত অন্যান্য গাছ-গাছালিতেও ব্যবহার করা হয়। এটি প্রধানত ফসলের সাদামাছি, জাবপোকা, লিফহপার, আলুর পোকা, পাতাকপির পোকা ইত্যাদি নিধনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এনডোসালফেনের দ্রুত কর্মক্ষমতার জন্য ব্যপক জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে তিব্র এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

স্বাস্থ্য ক্ষতিঃ Endosulfan মানব দেহের শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্য, পানি এবং শরীরের ত্বকের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে যকৃৎ ও কিডনিকে দ্রুত বিকল করে মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। এছাড়া এটি মানুষের স্নায়ু, টিস্যু, কোষ, পুরুষ ও নারী প্রজননতন্ত্রকে তিব্রভাবে আক্রান্ত করে।


endosulfan baby


তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়াঃ ইউএস এজেন্সি ফর টক্সিক সাবশট্যান্স এন্ড ডিজিজ রেজেস্ট্রি (ATSDR) তথ্য মতে যদি কোনো মানবদেহে এনডোসালফেন প্রবেশ করে, তাহলে প্রথমে স্নয়ুতন্ত্রকে আঘাত করার সাথে সাথে ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডকে অকার্যকর করে। ফলে ঐ মানুষসহ যেকোনো প্রাণির তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটতে পারে। তাৎক্ষণিক অন্যান্য উপসর্গগুলো হচ্ছে ঠোটের অথবা আঙুলের রং পরিবর্তন হয়ে যাওয়া, মাথা যন্ত্রণা, দূর্বলতা, ঝিমুনি, বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া, প্রবলভাবে কম্পন, শ্বাসকষ্ট এবং মতিভ্রম ঘটতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়াঃ কোনো মানব দেহে এনডোসালফেন প্রবেশ করলে তার পাকস্থলী, রক্ত, যকৃৎ,  বৃক্ক, কিডনি ও প্রজনন অঙ্গ দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এছাড়া ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

পরিবেশ-প্রতিবেশ জনিত প্রতিক্রিয়াঃ কৃষি ক্ষেত বা ফল বাগান অথবা যেকোনো স্থানে যদি এনডোসালফেন ব্যবহার করা হয় তাহলে সেখানে ৩৫ বছরেরও অধিক সময় পর্যন্ত এর বিষক্রিয়া কর্মক্ষম থাকে। এটি মানুষ, অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণি, মাছ, পাখি, জীব-অণুজীবসহ সকল প্রাণিকে আক্রান্ত করে। এনডোসালফেন অতি সহজে পানিতে মিশ্রিত হয়। ফলে পুকুর, ডোবা, নদীর পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। একই সঙ্গে মাটির তলার পানি এবং বসবাসকারি জীবের ক্ষতি করে। এছাড়া বায়ু দূষিত করে।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।