বন্যার খবর: টাঙ্গাইলের হাট বাজার


বন্যায় দেলদুয়ার উপজেলার ৮ টি ইউনিয়নের ৫৮ গ্রামের ৫২০০০ লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরী নদী ও এর অসংখ্য শাখা প্রশাখা দিয়ে বন্যার পানি দ্রুত সবগুলো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। তার সাথে যোগ হয়েছিল মুষল ধারে বৃষ্টি। অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি ও বন্যার ধরণ এমন হবে কৃষকেরা ভাবতে পারে নাই। এলাসিন, দেউলি ও লাউহাটি এই তিনটি ইউনিয়ন সরাসরি নদী দ্বারা বেষ্টিত। এই ইউনিয়নগুলোর মধ্য দিয়েই পানি অন্যান্য গ্রামে প্রবেশ করেছে।

খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ, দেলদুয়ার উপজেলার কৃষকেরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা ও এর আশে পাশের জেলাগুলোতে খাদ্য শস্য সরবরাহ করে। কিন্তু বন্যার কারণে এক দিকে মাঠে ফসলের যেমন ক্ষতি হয়েছে তেমনি হাঁস-মুরগী, মুরগীর খামার, মাছ চাষের পুকুর, কৃষকের বাড়ির গাভীর দুধ, ছোট ছোট গাভীর দুধের খামার, বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি ও পথখাবার তৈরীর ছোট ছোট পরিবারগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে ৫২৮ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ এবং আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ২১৫০ হেক্টর জমির ফসল। অনেক খাদ্য শস্য বিভিন্ন জায়গা থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে সরবরাহ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বন্যার কারণে রাস্তা ভেঙ্গে যাতায়াত ব্যবস্থা দূর্বল হয়ে পড়েছে। ১৪২ কিলোমিটার রাস্তাঘাট ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ৫ টি ব্রীজ কালভার্ট সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে।

উপজেলার হাট বাজারগুলোর মধ্যে লাউহাটি, করটিয়া বাজার, কাতলী বৌর বাজার, দেউলী ও ছিলিমপুর (আংশিক ভাবে ) বাজারে পানি উঠার কারনে অনেক ব্যবসায়ীর মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়েছে। আবার চাউল, ডাল, কাঁচা বাজার, দুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ উচুঁ রাস্তার ধারে নিয়ে বেচাকেনা করা হয়েছে। সাপ্তাহিক হাট বাজারে গরু –ছাগল হাঁস-মুরগীর জন্য আলাদা উঁচু জায়গায় করা হয়েছে। রাস্তা ঘাট ভাঙ্গার কারণে মালামাল পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে যার জন্য কিছুটা বেশী দামে ক্রেতাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। আবার কৃষকরা তাদের চাহিদা মত গরু-ছাগল,হাঁস-মুরগী, ধান ও উৎপাদিত কৃষি পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারছে না। পানি ভেঙ্গে অথবা নৌকায় করে হাট-বাজারে তাদের চলাচল করতে হচ্ছে।

রাস্তার ধারে চানাচুর, জিলাপী, পিঠা, ঝালমুড়ি সহ নানা ধরণের পথ খাবার বিক্রি করা হচ্ছে। তবে খাবার বিক্রেতার সংখ্যা অনেক কম। কারণ অনেক খাবার বিক্রেতার বাড়িতে পানি উঠার কারণে খাবার তৈরী করে তারা বাজারে বিক্রি করতে পারছে না। সাপ্তাহিক হাটের দিন অস্থায়ী ভাবে পিঠা ও রুটির দোকান বসত। সেগুলো এখন আর বসে না। তা ছাড়া নৌকার অভাবে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন হাট-বাজারে আসতে পারছে না, তাই বেচা কেনাও হাট বাজারে কম।

মোঃ আবুল কালাম, সবজি ব্যবসায়ী

মি গত ৭ বছর থেকে এই দেলদুয়ার বাজার এবং হাটে সবজি বিক্রি করে আসছি। আমি এলাকার কৃষকদে কাছ থেকে সবজি সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করি। বাজারে মোকামের শাক-সবজির চেয়ে কৃষকদে উৎপাদন করা শাক-সবজির চাহিদা বেশি এবং দামও বেশি পাওয়া যায়। বর্তমানে বন্যার কারণে এলাকার শাক-সবজি তলিয়ে গেছে। এলাকার কৃষকের শাক-সবজি পাওয়ার আর কোন উপায় নেই। কৃষকদের শাক-সবজি ও ফসলের জমি সব ডুবে গেছে। বর্তমানে কৃষকের ভিটা বাড়িতে বন্যার পানি উঠেছে, তাদের এখন থাকার কষ্ট হচ্ছে। তারা এখন শাক-সবজি আবাদ করবে কিভাবে? কয়েক জন হাতেগোনা কৃষক আছে যাদের ভিটা বাড়ি উঁচু যায়গায়। তাদের কাছ থেকে সামান্য কিছু শাক-সবজি সংগ্রহ করে বিক্রি করছি। পাশাপাশি টাংগাইল মোকামের থেকে শাক-সবজি কিনে এনে বিক্রি করছি। এখন সারা দেশে বন্যার পানি হওয়ার কারণে কোথাও তেমন ভাল কোন শাক-সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। সব কিছুর প্রচুর দাম। নিজের কাছে দেখতে পছন্দ হয় না, গ্রাহকের আর কি পছন্দ হবে।

মোঃ আলেক মল্লিক, ফুসকা ও চটপটি বিক্রেতা

আমি ৫ বছর থেকে ফুসকা ও চটপটি বিক্রি করছি। এই ফুসকা ও চটপটি বিক্রি করে কোন ভাবে সংসার চালাচ্ছি। বর্তমানে বন্যার কারণে বাড়ি ঘরে পানি।যাওয়া আসার রাস্তা ঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও রাস্তা ভাঙ্গা। ফুসকা ও চটপটি ভ্যানগাড়িটি আনা নেওয়া কষ্ট হয়। সেই জন্য বাড়িতে বেশ কয়েকদিন বসে ছিলাম।আজ না এসে পারলাম না। বাড়িতে বাজার নেই। বাড়িতে ঋনের টাকা নিতে কিস্তি ওয়ালা আসবে। কিস্তির টাকা জোগারের জন্য আজ বন্যার পানিতে কষ্ট করে চটপটি বিক্রি করতে এসেছি। চারিদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এর জন্য বাজারে লোকজন আসতে পারে নাই, সেই কারনে বিক্রি কম হচ্ছে।

মোঃ পলাশ, হাট-বাজারে পথখাবার বিক্রেতা। দেলদুয়ার, টাংগাইল।

আমি হাট-বাজারে পথখাবার বিক্রি করি গজা, বাদাম টানা, খাজা, ফুচকা, মুরালী ইত্যাদী। বন্যার কারণে দোকানের মালামাল তৈরী করতে খুব কষ্ট হচ্ছে, চুলায় পানি, লাকড়ী দিয়ে রান্না করতে হয়। লাকড়ী জোগার করা যাচ্ছে না। রাস্তায় পানি।হাটা চলা করা খুব অসুবিধা হচ্ছে। বন্যার কারণে কাঁচা মালামাল কিনতে টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। মালামাল আনা নেয়ায় খরচ বেশি হচ্ছে। মাল তৈরী করে বিক্রি করতে গেলে বন্যার জন্য হাট-বাজারে লোকজন কম আসছে। সেই জন্য বিক্রিও কম হচ্ছে। আগের দিনে বিক্রি করতাম যেখানে সবমিলে ৬০-৭০ কেজি, বন্যার কারণে এখন বিক্রি করতে পারছি ৩০-৩৫ কেজি। বন্যার জন্য বিক্রিও কম হচ্ছে লাভও কম পাচ্ছি।

উপজেলা পরিষদ, হাসপাতাল, উপজেলা প্রশাসন, সেনেটারী ইনেসপেক্টর বন্যায় মানুষের সহযোগিতার জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। বন্যায় পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়া এবং জ্বর সহ নানা ধরণের সেবার জন্য হাসপাতাল ইমার্জেন্সী বিভাগ ২৪ ঘন্টা খোলা রেখেছে। উপজেলা পরিষদ হাট বাজারগুলোর জন্য নিরাপদ ও উচুঁ রাস্তার পাশে বসার ব্যবস্থা করেছে। নোংড়া, অস্বাস্থ্যকর খাবার যাতে হাট বাজারে বিক্রি না হয় এর জন্য সেনেটরী ইনেসপেক্টর সার্বক্ষনিক বাজার মনিটরিং করছে। হোটেল, মিষ্টির দোকান, পথ খাবার, পচামাছ, মাংস যাতে বাজারে বিক্রি না হয় তা নিশ্চিত করছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র যাতে ভেজাল না হয় এ ব্যপারে কাজ করছে।

তারিখ: ২২ আগস্ট, ২০১৭


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।