স্বাস্থ্য ব্যবস্থাঃ নজরের বাইরের বিষয় আমলে আনা


এই বছর (২০১৬) কলম্বো, শ্রীলংকায় পিপলস হেলথ মুভমেন্টের একটি পরামর্শমূলক পর্যায়ের সভায় আমার অংশগ্রহণ করবার সৌভাগ্য ঘটে। নানান দেশে গণমানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন এমন সব সক্রিয় মানুষদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সভা। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন তাকে সম্যকভাবে বোঝা এবং নতুন বাস্তবতায় সম্ভাব্য কী ধরণের কর্মকাণ্ড ফলপ্রসূ হতে পারে মূলত তা নির্ধারণের জন্যই আলোচনা।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই পুঁজির আত্মস্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের প্রক্রিয়া কিভাবে সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষ, কৃৎকৌশল, তথ্য ইত্যাদি সবকিছুর তুমুল বদল ঘটাচ্ছে তা নিয়ে কথা ওঠে। এটা বোঝা কঠিন নয় মোটেও। আমাদের নিজেদের শরীরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে বদল ঘটেছে; আমরা যা কিনে খাই, ব্যবহার করি তা আমরা নিজেরা চাই কিনা সন্দেহ, কারণ আমাদের চাওয়া পাওয়া কোম্পানির – বিশেষত বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। আর্থিক লেনদেনের বাইরে রোগী আর ডাক্তারের কোন সম্পর্ক আছে কিনা সন্দেহ। অর্থাৎ খোদ ডাক্তারি শাস্ত্রের নীতিনৈতিকতার মধ্যে রোগের চিকিৎসা ও নিরাময়ের যে সংস্কৃতি তার ক্ষয় হয়েছে দ্রুত। ডাক্তার আর দশজন ব্যবসায়ীর মতো ব্যবসায়ী এবং তার সময় রোগীকে খুব চড়া দাম দিয়ে কিনতে হয়। এর আরেক মানে হচ্ছে বড় বড় রাজনৈতিক বুলি বা সবার জন্য স্বাস্থ্যের শ্লোগান দিলেও দিনশেষে সত্য এই যে টাকা না থাকলে চিকিৎসা পাবার কোন সুবিধা নাই। চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেখা যায় যেসব রোগে ডাক্তার, ক্লিনিক বা হাসপাতালে মুনাফার সুবিধা বেশী সেই সবের জন্য স্পেশালাইজড হাসপাতাল গড়ে তোলা হচ্ছে, কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করবার কোন উদ্যোগ নাই। এই দিকে আগ্রহের কোন কারণও নাই। কারণ এই খাতে মুনাফা কামাবার সুযোগ নাই।

তাহলে স্বাস্থ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সংক্রান্ত আলোচনাকে শুধু ডাক্তারি শাস্ত্রের বিষয় হিসাবে বিবেচনা করার সুযোগ নাই। পুঁজি, পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নে বা আরও সাধারণভাবে পুঁজির আত্মস্ফীতি ও পুঞ্জিভবন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা নজরে ও আমলে এনেই কেবল স্বাস্থ্য, ওষুধ, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে হবে। এই গোড়ার কাজটিকে স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীদের অবশ্যই নজরে আনতে হবে। স্বাস্থ্যের সঙ্গে গোলকায়নের সম্পর্ক বোঝা খুবই জরুরী। স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা যেন স্বাস্থ্য সমস্যাকে বাস্তবসম্মতভাবে বুঝতে পারেন এবং অবস্থা ও সাধ্য অনুযায়ী নিজেদের করণীয় বোঝেন তার জন্যই এই কাজ দরকার। স্বাস্থ্য আন্দোলনের প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং আন্দোলনের অভিমুখ সুনির্দিষ্ট করবার জন্য এই বোঝাবুঝি জরুরী।

উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীদের প্রতি আন্তর্জাতিক আগ্রহ বিপুল। কলম্বোর সভাতেও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। সকলেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য আন্দোলনের তারিফ করছেন। এর কারণ অবশ্য অজানা নয়। একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রণক্ষেত্রে ফিল্ড হাসপাতাল পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বাস্থ্য আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিলেন তার নজির মেলা ভার। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে সেই হাসপাতালই সাভারে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের লড়াই হিসাবে শুরু হয়। জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষায় বৈপ্লবিক অবদান রাখবার ক্ষেত্রে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবদান অনস্বীকার্য। ক্রমে ক্রমে যাঁরা গণস্বাস্থ্যের কার্যক্রমের সঙ্গে নানা ভাবে যুক্ত ছিলেন তাঁরাও নিজ নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে নানান ভাবে অবদান রাখেন। গণস্বাস্থ্য ছাড়াও এই প্রসঙ্গে ডাঃ কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত কমিউনিটি হাসপাতালের নাম উল্লেখ করা জরুরী। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য আন্দোলনের চরিত্র হচ্ছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরাসরি কাজ এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ইতিবাচক বদল ঘটাবার চেষ্টা করা।

আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণায় আশির দশক থেকে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে স্বাস্থ্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা সারা দুনিয়াকেই অনুপ্রাণিত করেছিলো। শ্রীলংকার সভায় সকলেই ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তারিফ করছেন। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সভা সমিতিতে দেখেছি সকলেই জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে এখনও স্বাস্থ্য আন্দোলনের গুরু হিসাবে মানেন।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শুরু থেকেই এটা স্রেফ এডভোকেসি বা কি করতে হবে জাতীয় আন্দোলন ছিল না। বরং গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছিয়ে দেবার কঠিন কাজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। আরও বিস্ময়কর যে প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরির বড় কারখানা স্থাপন ও জেনেরিক নামের ওষুধ উৎপাদন এই আন্দোলনকে শক্তি যুগিয়েছে। অন্যান্য দেশে স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীদের কাছে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এখনও প্রেরণা হিসাবে কাজ করে। যার প্রথম সাফল্য ওষুধ নীতি। বাংলাদেশে দেশীয় ওষুধ শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে ওষুধ নীতির অবদান আজ সকলে স্বীকার করেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য 'ফিল্ড হাসপাতাল' স্থাপন আর পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে তারা বলেছিলেন যুদ্ধ শেষ হয় নি, কারণ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। লড়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য আন্দোলনের সংগে মুক্তিযুদ্ধের এই গভীর সম্পর্ক ভুলে যাবার উপায় নাই।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিখ্যাত পোস্টারঃ 'সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি'। একটি স্বাধীন দেশের জনগণের উপযুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদকে বোঝা এবং অসম আন্তর্জাতিক বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে সঠিক নীতি ও কৌশল প্রণয়ন তো যুদ্ধই বটে। সেদিন যাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ হিসাবে শনাক্ত করা হোত, আজ তাই বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা। পুঁজির গোলকায়নের মধ্যে দিয়ে যার বিস্তার ঘটেছে। এখন পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন ও স্বাস্থ্য নিয়ে যদি আমরা কথা বলি তাহলে আগের লড়াই-সংগ্রামগুলো সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। একইভাবে পুরানা বোঝাবুঝি ও অভিজ্ঞতা ঝালাই করার মধ্য দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের নতুন বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে।

দুই

‘আধুনিক’ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নামক যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চলছে, তা নিজেই কিভাবে স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক সেইদিকে আমাদের নজর নাই বললেই চলে। অনুমান হচ্ছে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে সকলকে আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অধীনে আনতে হবে। আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিজেও যে স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারন হতে পারে সেই দিকগুলো আমরা পর্যালোচনা করে দেখি না। নীতিনির্ধারণী পর্যালোচনা হিসাবে এই দিকটি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের এলাকা।

এর পালটা ব্যবস্থা হিসাবে অনেকে স্থানীয়, বিকল্প বা ভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা বলেন। যেমন, আয়ুর্বেদ, ইউনানী, হোমিওপ্যাথী, ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবদান এবং অবস্থা ভেদে উপযোগিতা অনস্বীকার্য। একই ভাবে তাদের সীমাবদ্ধতা এবং বিপদও রয়েছে। একটির পরিবর্তে বিকল্প বা ভিন্ন ব্যবস্থা একটি দেশের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের পথ নয়। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল প্রকার জ্ঞানকাণ্ডের নির্মোহ পর্যালোচনা এবং বিদ্যমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সমাধান অন্বেষণই আসল কথা।

বাস্তবসম্মত পথ হচ্ছে সাধারণ মানুষ কিভাবে এখন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিজেই করছে তাকে বাস্তব ভাবে বোঝা এবং তার ভালমন্দ বিচার করা প্রথম কাজ। সেখানে কোথায় বিপদের জায়গা, কোথায় তার সংস্কার করতে হবে আর কোথায় তাদের স্বাস্থ্যচর্চা বৈজ্ঞানিক ও বাস্তব সম্মত সেটা বোঝা খুবই জরুরী। জ্বরে এবং কিছু কিছু অসুখে নিম পাতা, চিরতার পানি, বাসক পাতা নির্ঘাৎ কাজ করে। অতএব লোকায়ত চিকিৎসা উপেক্ষা করবার কোন জো নাই। কাশির জন্য খামাখা অকেজো এলোপ্যাথ কাশির ওষুধ কিনে খাবার কোন যুক্তি নাই। কিন্তু পাশাপাশি কখন কাশি যক্ষা বা অন্য কোন জটিল রোগের উপসর্গ, সেটা শনাক্ত করবার মতো ব্যবস্থাও গড়ে তোলা চাই। লোকায়ত জ্ঞানের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে আধুনিক চিকিৎসা যক্ষা নিরাময়ে যে ভূমিকা রাখে তা এড়িয়ে যাবার কোন যুক্তি নাই।

গ্রামের মেয়ে ও শিশুর স্বাস্থ্য যদি আসলেই আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে তাহলে দাই মার সঙ্গে গ্রামের মানুষের সম্পর্ক আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ ভাবে বোঝা দরকার। তাদের শুধু ‘বার্থ এটেন্ডেন্ট’ বা বাচ্চা ধরার ঝি গণ্য করলে মেয়ে ও শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবে দাই মায়েরা যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে তার কিছুই আমরা বুঝব না। স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সঙ্গে কিভাবে সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক নানান ভাবে জড়িত তা আধুনিক ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজের প্রাদুর্ভাবে এখন আর নজরে পড়ে না। নজরে আনাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এর অসামান্য গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমরা দাই মাদের নিয়ে গ্রামে কাজ করি। ‘ট্রাডিশনাল বার্থ এটেন্ডেন্ট’ নামে দাইমাদের কথা বলা হয়। তবে তার উদ্দেশ্য আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিম্ন পর্যায়ের জন্য নতুন কিছু কর্মী তৈরী করা। দাই মাদের ভূমিকা বোঝা এবং তাদের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রেখে কিভাবে তাদের সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনিবার্য অঙ্গ হিসাবে গড়ে তোলা যায়, নজরের বাইরে থাকা এই কাজটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।

আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে কৃষি, যা আসলে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। অবিশ্বাস্য হোল কৃষি সম্পর্কে এই বোধ আমাদের নাই। কৃষির সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি অবিচ্ছেদ্য – এই বোধ থেকে আমরা বহু বহু আলোকবর্ষ দূরে। ফলে যে কৃষি নীতি ও কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। রসায়নিক সার, বিষ ও মাটির তলা থেকে পানি তোলার কুফলের কারণে আর্সেনিকের বিষে আমরা আক্রান্ত। একটি জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার ধারণা থেকে সার, বিষ, ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার কমালে তা সরাসরি দেশের জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, এটা আমরা কাণ্ডজ্ঞানেই বুঝতে পারি। কিন্তু বুঝি কি? কৃষিকে আমরা স্বাস্থ্য ও পুষ্টির নজরে রাখি না। আজকাল খাদ্য ও পুষ্টির সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা সচেতনতা এসেছে বটে, কিন্তু তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। অসুখ ঘটবার আগে প্রতিরোধ দূরে থাকুক, বরং অসুখ তৈরি করাই আমাদের কাজ। আমরা চিকিৎসাকে নিরাময়মূলক ব্যবস্থার অধীন করতে চাই। চিকিৎসাকে আমরা হাসপাতাল ও ক্লিনিক কেন্দ্রিক করে ফেলেছি।

পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন কিভাবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত সেটাও সত্য বলতে কি এখনও আমাদের নজরের বাইরে রয়ে গিয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার যে পর্যায়কে অনেক সময় 'গোলকায়ন' কিম্বা ‘নিউ লিবারেলিজম’ বলা হয় তাকে বোঝা আর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, ওষুধ ও খাদ্য ব্যবস্থার নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার নীতি ও কৌশল নিয়ে দুনিয়াব্যাপী কাজ তো আর থেমে থাকে নি। আমরাও থেমে নাই।

আশির দশকে যখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নেতৃত্বে ওষুধ নীতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছিল তখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয় ছিল কাকে আমরা ‘ওষুধ’ বলব আর কাকে বলব আবর্জনা। অর্থাৎ ‘ওষুধ’ নামে চলছে অথচ তা কোন ওষুধই নয়। যেমন কাশির সিরাপ, কিম্বা গ্লাক্সোজ ডি, ইত্যাদি। যার কোন ওষুধ গুণ নাই কিম্বা অপ্রয়োজনীয় তাকে ওষুধের তালিকা থেকে বাদ দেবার জন্য নতুন মানদণ্ড খুঁজতে হয়েছে। তখন অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় ১৭৭৪টি ওষুধ বাতিল বলে ঘোষিত হয়।

বাজার ব্যবস্থায় ওষুধ পণ্য। তার মানে তার মধ্যে দুটো গুণ থাকতে হবে। এক: তার উপযোগিতা – অর্থাৎ ওষুধ হিসাবে তাকে কাজ করতে হবে। ওষুধের বাছবিচার নির্ণয়ের মানদণ্ড হিসাবে ওষুধের উপযোগিতা এবং বাজারে তাকে ‘ওষুধ’ হিসাবে চালানোর ফারাক ওষুধ নীতি প্রণয়ণের পেছনে কাজ করেছে, কোনটা ওষুধ আর কোনটা ওষুধ নয়। তেমনি গ্রহণ করবার যুক্তি দেখাতেও অসুবিধা হয় নি। এর নগদ অবদান হচ্ছে বিপুল সংখ্যক অপ্রয়োজনীয়, অকার্যকর ও ক্ষতিকর ওষুধ থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি।

ওষুধ নীতির প্রণেতারা তাদের নিজেদের বুদ্ধি, বিবেচনা ও প্রজ্ঞা থেকেই প্রয়োজনীয় ওষুধকে ক্ষতিকর, অপ্রয়োজনীয় ও অকার্যকর পদার্থ থেকে আলাদা করেছেন। এটা করতে গিয়ে তারা পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের নতুন একটি চরিত্রের দিকেও আমাদের নজর ফিরিয়েছেন। পুঁজির আমাদের কাজে লাগে শুধু তেমন বস্তুকেই পণ্যে পরিণত করে না। যা কাজে লাগে না তাকেও পুঁজি পণ্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়, কারণ পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের উদ্দেশ্য প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন করে আমাদের প্রয়োজন মেটানো নয়। বরং যা মুনাফা কামায় তা উৎপাদন করা। সেটা অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর কিম্বা বিষ হোক তাতে পুঁজির কিছুই আসে যায় না।

তিন

নিউ লিবারেলিজম বা নয়াবাজারবাদ নামে একটি ধারণার সঙ্গে আমরা আজকাল পরিচিত। এই বাজারগিরির মুল কথা হচ্ছে ব্যাক্তিকেই ব্যাক্তির দায় নিতে হবে, সেটা জনগণের নামে রাষ্ট্র নিতে পারবে না। অন্ন বস্ত্র স্বাস্থ্য শিক্ষা বাসস্থান ইত্যাদির দায় যার যার তার তার। রাষ্ট্র বাজারে কোন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না তাকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিতে হবে। পণ্য কিম্বা পুঁজির অবাধ যাতায়াতে রাষ্ট্র কোন বাধা দিতে পারবে না। বিদেশী ওষুধের অবাধ প্রবেশ বা বিদেশী স্বাস্থ্য সেবাদানকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অবাধ ব্যবসায় কোন বাধা দিতে পারবে না। সব করবে বাজার, রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে শুধু আমাদের নিরাপত্তা দেওয়া। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার এই নয়াবাজারবাদী পর্যায়ে রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে নাগরিকদের ওপর নজরদারি করবার প্রতিষ্ঠান; পাহারাদার হয়ে উঠেছে পুঁজির – অর্থাৎ ব্যবসায়ী আর ব্যবসার – বিশেষত বহুজাতিক কম্পানির।

এই অবস্থায় স্বাস্থ্য পাবার যে অধিকারের কথা আমরা ১৯৭৮ সালে আলমা আটা ঘোষণায় পেয়েছিলাম তার কোন ছিটেফোঁটা অস্তিত্বই নাই।‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ কথাটা এখন তামাশার মতো শোনায়। আপনার টাকা নাই তো আপনি স্বাস্থ্য সেবা পাবেন না। সেবা আপনাকে বাজার থেকে কিনতে হবে। সরকারী হাসপাতালের জায়গায় ছত্রাকের মতো গড়ে উঠেছে প্রাইভেট হাসপাতাল আর ক্লিনিক। শুধু তাই নয় বিদেশী ডাক্তার আর স্বাস্থ্য সেবা কম্পানি ব্যবসা করছে বাংলাদেশে। প্রাইভেট হাস্পাতাল বা বড়লোকদের জন্য ক্লিনিক হতেই পারে, কিন্তু নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত দেবার যে প্রতিশ্রুতির কথা আমরা এতোকাল শুনে এসেছি তা অপসৃত হয়েছে। এখন কথা চলছে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ-এর। রাষ্ট্র স্বাস্থ্য খাতে খরচ করবে তবে সেই খরচ থেকে ব্যবসা করবে মুনাফাকারী ইনসিউরেন্স কম্পানি। পুরা স্বাস্থ্যখাতকে বেসরকারীকরণ করে নয়াবাজারবাদ সন্তুষ্ট নয়, একে পুঁজির সহজে মুনাফা কামাবার জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করেছে।

এই গুণগত পরিবর্তনগুলো গত কয়েক দশকে ঘটেছে। একে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ দরকার। স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা নানান দিক থেকে সেই কাজ করছেন। বাংলাদেশে এই কাজগুলো আমাদের আরও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য আন্দোলনের সুনাম আশির দশক থেকেই বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্ত। বাংলাদেশে এর শক্ত ভিত্তি আছে। আগামি দিনে তা আরও শক্তিলাভ করবে, এই আশা করি।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।