“স্বাস্থ্য সূচকে বরিশাল জেলার অবস্থার পর্যালোচনা” ২০১৬


প্রতিবেদন

স্বাস্থ্য আন্দোলন গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বরিশাল মহিলা সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘স্বাস্থ্যসূচকে বরিশাল অঞ্চল পিছিয়ে’- এ বিষয়টি নিয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

বরিশাল মহিলা কল্যাণ সংস্থার (বিএমকেএস) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ মতবিনিময় সভায় স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য কর্মী, উন্নয়ন কর্মী, নারী নেত্রীসহ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন।

সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন বরিশাল মহিলা কল্যাণ সংস্থার (বিএমকেএস) এর পরিচালক কাওছার পারভীন। মতবিনিময় সভায় প্রারম্ভিক বক্তব্য প্রদান করেন স্বাস্থ্য আন্দোলনের সদস্য এবং উবিনীগের গবেষক পলাশ বড়াল।

তিনি উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। পলাশ বড়াল বলেন, স্বাস্থ্য আন্দোলন নেটওয়ার্ক এবং বরিশাল মহিলা কল্যাণ সংস্থার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ মতবিনিময় সভার উদ্দেশ্য হলো “স্বাস্থ্য সূচকে বরিশাল অঞ্চল পিছিয়ে আছে”- সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত এ প্রতিবেদন নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যম, স্বাস্থ্যকর্মী, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, উন্নয়নকর্মী, নারী নেত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। একই সঙ্গে এ অবস্থা কিভাবে নিরসন করা যায় তার উদ্যোগ গ্রহণ করা।

হাসপাতালের ওষুধ সরবরাহ

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত স্বাস্থ্যসূচকের বিষয়টি উপস্থাপনে বরিশালসহ পার্শ্ববতী এলাকাগুলোকেও নির্দেশ করা হয়েছে। তবে ওই অঞ্চলগুলো সবই বরিশাল বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। উপস্থিত প্রতিনিধিরা সভাকে অবহিত করেন যে, স্বাস্থ্যসূচকের মানদন্ড বিবেচনায় বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ এবং বরিশাল সদর হাসপাতাল নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। ফলে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজের সেবাদান কার্যক্রম পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক।

আলোচনার শুরুতেই দৈনিক মতবাদ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার ফারুক আহমেদ বলেন, বরিশাল মেডিকেল কলেজে প্রতিদিন ২:০০ লক্ষ টাকার ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ প্রতিদিন ২:০০ লক্ষ টাকার ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত আছে। এখানে প্রতিদিন আউটডোরে ১২০০ - ১৩০০ রোগী আসেন।

রেফারেল

শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ প্রধানত রেফারেল কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল থেকে রোগীরা রেফার হয়ে এখানে আসেন। প্রতিদিন ২০০ - ৩০০ রোগী ভর্ত্তির জন্য আসেন। ফলে, ২:০০ লক্ষ টাকার ওষুধ রোগীদের জন্য যথেষ্ট। এখানে প্রধানত রেফার করা রোগীরা ইর্টানী চিকিৎসকদের নেতৃত্ব প্রাথমিকভাবে রোগ নির্নয়ের জন্য প্রেরিত হন। কিন্তু অত্যন্ত দুখের বিষয় যে, ইন্টার্নী চিকিৎসকরা জেলা এবং উপজেলা হাসপাতালের রোগ নির্নয়ের জন্য যে সকল পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়েছে তা সবই বাতিল করে দেন। রোগীর চিকিৎসা শুরু নতুন করে। ফলে, রোগীর দুর্ভোগ বেড়ে য়ায়।

স্বাস্থ্য জনবল

স্বাস্থ্য জনবল প্রসঙ্গে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে গুরুত্বপূর্ণ বা জরুরী তেমন ঘাটতি নেই। মেডিকেলে ২২০ জন চিকিৎসকের পদ আছে - ৭০ জন কম, নার্স ৪০৫ জন। ইর্ন্টানী ২১০ জন। ফলে, ৭০ জন চিকিৎসক কম থাকলেও ২১০ জন ইন্টার্নী চিকিৎসক ওই শূণ্যতা সর্বদাই ঢেকে রাখেন। তারা নিয়মিত সার্ভিস দিয়ে আসছেন।

সংবাদ কর্মী জনাব ফারুক আহ্মেদ যিনি অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজসহ বরিশাল সদর হাসপাতালের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, মেডিকেল কলেজ যেহেতু প্রধানত রেফারেল রোগীদের সেবা প্রদান করে, তাই এখানে স্বাস্থ্য জনবলের সংকট অতোটা প্রকট নয়। ফারুক আহ্মেদ বলেন, মেডিকেলে ২২০ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও ৭০ জন কম আছে তবে নার্স এবং ইন্টানী চিকিৎসকের কোন শূন্যতা এখানে নেই। ইন্টানী চিকিৎসক আছেন ২১০ জন এবং নার্স আছেন ৪০৫ জন।

প্রসূতি বিভাগ

বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শতকরা ৮০ ভাগ (প্রায়) সিজার হয় । গর্ভবতী । এর পুরো লাভ চিকিৎসকরাই পেয়ে থাকেন। যেমন, পরীক্ষা-নীরিক্ষা প্রাইভেট ক্লিনিকে, চিকিৎসকদের পরিচিত দোকান থেকে ওষুধ ক্রয়। প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ওষুধ ক্রয় ইত্যাদি।

মা ও শিশুদের বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৭০ জন গর্ভবতী মা আসেন। কিন্তু তাদের চিকিৎসকরা সিজারের সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন। শেরেবাংলানগর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮০% গর্ভবতী মায়ের সিজার হয়। এটা নিছক অবহেলা। সঠিকভাবে পরীক্ষা করার কোন প্রাইভেসী নেই। আলট্রাসনগ্রাম মেশিন আছে। কিন্তু চিকিৎসকরা কমিশনের জন্য ওই মেশিন ব্যবহার না করে পাশ্ববর্তী প্রাইভেট ক্লিনিকে তাদের প্রেরণ করেন। এতে অহেতুক বিলম্ব হয়। সিজার করার সম্ভবনা বেড়ে যায়।

কিডনী বিভাগ

কিডনী বিভাগে ডায়লাইসিস মেশিন আছে। ২০০৮ সালে মেশিনগুলো আসে। কিন্তু টেকনিশিয়ানের অভাবে মেশিন খোলাই হয় নি। ওইভাবেই বাক্সে পড়ে আছে। বর্তমানে বেড ৫০০, কিন্তু প্রতিদিন গড়ে ১৪০০ রোগী হাসপাতালে ভর্ত্তি থাকেন। অতিরিক্ত রোগীরা হাসপাতালের বারান্দায়, কক্ষের ফ্লোরে বিছানা বিছিয়ে চিকিৎসা নেন। বর্হিবিভাগের প্রতিটি চিকিৎসক এবং টেকনিশিয়ান কোন না কোন ডায়গষ্টিক সেন্টারের সাথে সম্পর্কিত। রোগীদের প্রাইভেট ডায়গষ্টিক কেন্দ্রে পরীক্ষ-নীরিক্ষার কমিশন নিয়ম করে বর্হিবিভাগের চিকিৎসকদের কাছে চলে আসে। দৈনিক ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধি এবং দালাল চক্রই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটাকে দখল করে রেখেছে।

জনাব বিল্পব (সভাপতি, বরিশাল হেলথ্ জানালিষ্ট এসোসিয়েশন) বলেন, ”আমাদের অনুসন্দানে দেখা গেছে টেকনিয়ানরা নিজেরা ইচ্ছে করে মেশিন বিকল করে রাখে। যাতে করে পরীক্ষাগুলো বাইরে যেতে পারে।”

জরুরী বিভাগ

জরুরী বিভাগে দালালরা সবসময় তৎপর। এটা অভিনব কাহিনী, চিকিৎসকরা কোন পরীক্ষা দিলে পরীক্ষার ফলাফল সাধারণত ২টার পরে আসে। হাসপাতালের চিকিৎসকদের আর দেখানো যায় না। ফলে, ওই রোগী চিকিৎসকদের প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগীকে নিয়ে নতুন করে ফি দিয়ে দেখান। রোগীর চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রে নতুন করে শুরু হয়।

সংক্রামক ব্যধি

আরিফুর রহমান, যায়যায় দিন পত্রিকার বরিশাল সংবাদ দাতা। তিনি বলেন, তার অভিজ্ঞতায় সংক্রমক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে যথেষ্ট সংখ্যক রোগী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। সংক্রমক ব্যধির সংখ্যা ৬টি। তার অভিজ্ঞতায় উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যারা ওই ৬টি রোগ দ্বারা আক্রান্ত হন, তারা অধিকাংশই গরীব। তাই স্বাস্থ্য শিক্ষা সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আরিফুর রহমান একই সঙ্গে ডায়গনষ্টিক সেন্টার এবং প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর পরীক্ষা-নীরিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, বরিশালে যে ডায়গনষ্টিক সেন্টারগুলো আছে তার টেকনিশিয়ানদের যোগ্যতা এবং দক্ষতা নিয়ে অনেক সংশয় আছে। একই সঙ্গে যে রিজেন্টগুলো ব্যবহার করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদ উত্তীর্ন। ফলে, ডায়গষ্টিক সেন্টারগুলো যে রিজেন্টগুলো ব্যবহার করে, তা পরীক্ষা করা আবশ্যক।

জবাবদিহীতা

শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যাবতীয় কার্যক্রম নীরিক্ষা করার জন্য জবাবদিহীতা বাড়ানোর জন্যে অটোমেশন পদ্ধতি চালু হয়েছিল। এ কার্যক্রমের আওতায় শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪২টি কম্পিউটার, ৫২টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। মেডিকেল কলেজের পরিচালক জানিয়েছেন, মাত্র ২ মাসের মধ্যে পদ্ধতিটি বিকল্প হয়ে যায়। ফলে, জবাবদিহীতার গোড়াপত্তনেই মৃত্যু হয়।

জনাব জাহাঙ্গীর, সদস্য

কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ। তিনি জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় করার জন্য যে কমিটি, তিনি একজন সদস্য, কিন্তু গত এক বছর ধরে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে কোন ওষুধ প্রদান করা হয় না। চিকিৎসকরা নিয়মিত থাকেন না।

চরাদী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র

মানপাশা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসকরা ৫০ থেকে ১০০ টাকা ফি নেয়ার পরিবর্তে রোগী দেখেন। এটা জনাব বিল্পব (সভাপতি, বরিশাল হেলথ্ জানালিষ্ট এসোসিয়েশন) নিজেই রোগী সেজে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন।

বরিশাল সদর হাসপাতাল

বরিশাল জেলা সদর হাসপাতাল একটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রোগীদের এখানেও রেফার করা। চিকিৎসকের সংকট নেই।

বরিশাল সদর হাসপাতালে নার্স ১৪১ জন, কিন্তু প্রতিদিন রোগী আসেন ৭০-৮০ জন মাত্র। সভায় উপস্থিত সংবাদ কর্মীরা যারা সরাসরিভাবে স্থানীয় সরকারী স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র অর্থাৎ বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র সমূহ, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো নিয়ে কাজ করেন তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তারা বলেন, এত বড়ো হাসপাতাল কিন্তু অ¯্রপাচারের (অপারেশনের) সুযোগ নেই। ওটা মাত্র একটি বিদ্যুৎ লাইনের অভাবে। ফলে চিকিৎসকরা বিপাকে আছেন। অপারেশনের উদ্যোগ নিলেও হঠাৎ বিপাকে পড়তে হয়।

সভায় স্বাস্থ্য আন্দোলনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং কার্যক্রমের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন, দৈনিক শাহনামা পত্রিকার সহকারী বার্তা সম্পাদক জনাব বিল্পব এবং মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ, স্টাফ রির্পোটার সভাকে অভিমত দেন যে, স্বাস্থ্য আন্দোলন বরিশালে সক্রিয়ভাবে কাজ করায় তারা সকল ধরনের সহযোগীতা প্রদান করবেন।

সভা প্রধানের ধন্যবাদ জ্ঞাপন

সভা প্রধান কাওছার পারভীন উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং ররিশালের স্বাস্থ্যসূচকের নি¤œগতি হওয়ার মূল কারণ অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন তৈরীর জন্য জনাব ফারুককে অনুরোধ জানান।

কাওছার পারভীন একই সঙ্গে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার কাজ শেষ করেন।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।