তামাক নয়, বৃক্ষরোপন


তামাক চাষে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গাছ লাগানো

কুষ্টিয়া : ৩০ জুলাই ২০১০। দৌলতপুর উপজেলাধীন রেকাইতপুর ইউনিয়নের ভেড়ামারা অন্যতম একটি গ্রাম। অন্যান্য গ্রামের চাইতে ভেড়ামারা গ্রামে গাছপালা কম। তাই গাছ লাগানোর জন্য এই গ্রাম খুবই উপযোগী। ভেড়ামারা হতে তেলেগা দিয়া গ্রাম পর্যন্ত রাস্তাটির চার পাশে ফাঁকা। জানা যায় স্বাধীনতার আগে রাস্তাটি তৈরি হলেও দুঃখের বিষয় রাস্তার ধারে একটিও গাছ নাই।

এলাকায় তামাক চাষ শুরু হওয়ায় কোম্পানীরা কৃষকদের হাতে স্বল্প মেয়াদী কিছু গাছ (একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস) তুলে দেয় যা তামাক পাতা পোড়ার জন্য উপযোগী। বর্তমানে রাস্তাটি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। রাস্তার দৃশ্য দেখে মনে হয় নতুন একটি রাস্তা।

২৯ জুলাই, ২০১০ তারিখে উবিনীগ নয়াকৃষি আন্দোলন এর উদ্যোগে ভেড়ামারা গ্রামে গাছ লাগানো কর্মসূচী নেয়া হয়। এতে বিভিন্ন জাতের গাছের মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, জাম্বুরা, জামরুল, নিমগাছ প্রভৃতি রাস্তার দু’ধারে লাগানো হয়।

লাগানো কর্মসূচী

বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা নিয়ে এসেছেন নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষক ও কর্মীরা।


গাছ  উদ্বোধন করেন, অধ্যক্ষ রেজাউল হক, বড়গাংদিয়া নাছির উদ্দিন বিশ্বাস কলেজ। আরো উপস্থিত ছিলেন শামছুল হুদা (অব:) সহকারী শিক্ষক বড়গাংদিয়া। মোস্তাফিজুর রহমান, রেকাইতপুর ইউপি সদস্য, শাহাবুবুল আলম খান, প্রধান শিক্ষক বিটিপি মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়, দুলাল হোসেন, প্রধান শিক্ষক, ভেড়ামারা প্রাথমিক বিদ্যালয়, আতাহার আলী (মজনু) সমাজ সেবক, ভেড়ামার। এলাকার আরো অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মোজাহিদুল ইসলাম, উবিনীগ নয়াকৃষি আন্দোলন কুষ্টিয়া কেন্দ্রের সমন্বয়ক ।

গাছ লাগানো কর্মসূচীতে অধ্যক্ষ রেজাউল হক বলেন, আমাদের দৌলতপুর উপজেলায় সরকারি, বেসরকারি অনেক সংস্থা আছে তারা রাস্তা - ঘাটে, স্কুল - কলেজের মাঠে আজ পর্যন্ত একটি গাছ ও লাগায়নি। এই প্রথম রেকাইতপুর ইউনিয়নের ভেড়ামারা গ্রামে উবিনীগ নয়াকৃষি আন্দোলন গাছ লাগিয়েছে। আমি এলাকাবাসির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। এই গাছগুলো টিকে থাকলে আমাদের উপকারে আসবে। এই গাছ থেকে আমরা ফল পাব, কাঠ পাব। এই আমানতগুলো আমাদের রক্ষা করতে হবে। রাস্তাটি সরকারি তবে সরকার কিন্তু ফলগুলো নিয়ে যাবে না। আমরাই ফলগুলো ভোগ করতে পারবো। গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, পানি দেওয়া, পরিচর্যা করার ব্যাপারে তিনি এলাকাবাসিকে আহবান জানান।

তিনি আরো বলেন, যেখানে প্রকৃত সবুজ গাছপালা আছে সেখানেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আমাদের কুষ্টিয়ার পাশের জেলাগুলোতে যেমন পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। কৃষকরা অনায়াসে কৃষি কাজ করতে পারছে। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে হাওর, বিল, পুকুরে এক ফোটা পানিও নাই। পাট চাষীদের দুঃখের সীমা নাই। কৃষকরা পাট জাক দেবার জন্য পানি পাচ্ছে না। আমরা যদি গাছপালা ঠিক রাখতাম, চারিদিকে প্রকৃতি সবুজের সমারোহ থাকতো অবশ্যই দেশে বৃষ্টি পাত হতো। দেশে গাছ পালা নাই এর একমাত্র কারণ তামাক চাষ। তামাক চাষ আসাতে গাছপালা উজার হয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে সবধরণের গাছপালা উজার হয়ে গেছে।

শামছুল হুদা বলেন, নয়াকৃষি শুধু গাছপালা নিয়ে কথা বলে না। তারা মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন নিয়ে কথা বলেন, যুদ্ধ করেন। আমি দেখেছি গত ৫/৬ বছর যাবৎ ভেড়ামারা গ্রামে নয়াকৃষি আন্দোলন কৃষকদের নিয়ে সভা, সমাবেশ করেছে। তারা সরাসরি কৃষকদের সাথে যুক্ত থাকে। যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি কৃষকদের সাথে যুক্ত থাকতো তাহলে বাংলাদেশ আরো উন্নত হতো। আজ নয়াকৃষি ভেড়ামারা গ্রামে গাছ লাগাচ্ছে। এর পাশাপাশি অন্য সংগঠন যদি আসতো তাহলে রেকাইতপুর ইউনিয়ন গাছপালা দিয়ে ভরে যেত। আমরা ইচ্ছা করলে বাড়ির ধারে, জমির আইলে নিজেরা গাছ গাছালি লাগাতে পারতাম কিন্তু আমরা পরনির্ভরশীল। গত তিন বছর ধরে তামাক কোম্পানীরা কৃষকদের হাতে একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস গাছ তুলে দিয়ে বলেন ৩ বছর পরে তামাক পড়ানো উপযোগী হবে। কৃষকরা কোম্পনীর কথাই শুনছে। তিনি বলেন, ভেড়ামারা গ্রামে উপস্থিত যত লোকজন আছেন সবার প্রতি অনুরোধ রইল নয়াকৃষি আমাদের যে গাছগুলো দিয়েছে, এই গাছগুলো আমরা সবাই মিলে রক্ষা করবো ।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উবিনীগ নয়াকৃষি আন্দোলন রেকাইতপুর ইউনিয়নে গাছ লাগানোর যে কর্মসূচী হাতে নিয়েছে তাতে আমার দায়িত্ব একটু বেড়ে গেল। আমি নিজেই গাছগুলো রক্ষা করবো। আশে পাশে লোকজনকে বলে দিব যেন সঠিক পরিচর্যা করে। একটি গাছও যেন হারিয়ে না যায়। গাছগুলো বড় হলে সারা রাস্তা ছায়া হবে এবং ফলও পাওয়া যাবে।

শাহাবুবুল আলম খান বলেন, একটা সন্তানকে মানুষ করতে যে যতœ দরকার তদরুপ একটি গাছকে যতœ দরকার। আমরা আগে যে পরিমাণ গাছপালা দেখেছি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে গাছ উজার হয়ে গেছে। তামাক কোম্পানীর ফাঁদে পড়ে আমরা কাঠজাত, ফলজাতীয় গাছ দিয়ে তামাক পাতা পুড়িয়েছি। তামাক কোম্পানীর লোকেরা বলেছিল কাঠজাত দ্রব্য দিয়ে তামাক পুড়াতে হবে। অন্য লাকড়ী দিয়ে তামাক পোড়ানো যাবে না। বর্তমানে গাছপালা উজার হয়ে গেছে। তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য আর গাছ পালা নাই। এখন তারা বলে, যে কোন গাছের পাতা, ধানের বিচালী দিয়ে তামাক পাতা পোড়ানো যাবে। এখন ইপিল ইপিল বিদেশী গাছের চারা কৃষদের হাতে তুলে দিচ্ছে। তা আবার তিন বছর পরে কাটতে হবে। এরকম কোম্পানীর চালাকি আমরা সকল মিলে রুখে দাঁড়াব। নয়াকৃষি আমাদের ভেড়ামারা গ্রামে যে গাছগুলো দিয়েছে আমরা অবশ্যই টিকিয়ে রাখব।

আতাহার আলী মজনু বলেন, আমি সরকারের মাধ্যমে অনেক জাতের গাছ পালা আনার চেষ্টা করেছি। এম, পি চেয়ারম্যানের কাছে গাছ লাগাবার জন্য আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছি। নয়াকৃষি আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা এখানে গাছ লাগাতে পারছি। শুধু ভেড়ামারা রাস্তা নয় সমগ্র রেকাইতপুর ইউনিয়নের রাস্তায় আমাদের গাছ লাগাতে হবে। তিনি আরো বলেন, এই রাস্তা দিয়ে কত মানুষ চলাফেরা করবে গাছ গুলো বড় হলে, ফল পাবে তারা। রাস্তাতে একটুও রোদ লাগবে না। তিনি ছেলে মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলেন, এই গাছগুলো তোমরা খেয়াল রাখবে। এগুলো তোমাদের সম্পদ। তোমাদের দায়িত্ব বেশি। তোমরা গাছগুলোর যত্ন করবে।

কৃষক তালেব আলী বলেন, আমার জমির পাশে যে গাছগুলো লাগানো হয়েছে অবশ্যই গাছগুলো যত্ন করবো। একটি গাছও হারাতে দেব না।

কৃষক আনার আলী বলেন, আমরা দারুন খুশী এরকম ফলের গাছ লাগানো হচ্ছে। প্রথমে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। যখন দেখি সত্যই গাছগুলো লাগানো হচ্ছে তখন আমার বিশ্বাস হয়েছে। রাস্তার গরু, ছাগল যেন গাছ ধ্বংস করতে না পারে আমি সেদিকে সময় নজর রাখবো।

শেষে উবিনীগ নয়াকৃষি আন্দোলন কুষ্টিয়া কেন্দ্রের সমন্বয়ক মোজাহিদুল ইসলাম উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে গাছের উপর একটি কবিতা বলেন,

জাম, জামরুল, কদবেল

আতা, কাঁঠাল, নারকেল

তাল, তরমুজ, আমড়া,

কামরাঙ্গা, বেল, পেয়ারা

পেঁপে, ডালিম, জলপাই

বরই, দিলাম আর কি চাই।

তিনি বলেন, আপনারা এই গাছগুলো রক্ষা করবেন। এগুলো আপনাদের সম্পদ। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বৃক্ষ রোপন কর্ম সূচী শেষ করেন।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।