বিটি বেগুন অনুমোদন প্রত্যাহার কর, বিটি বেগুন চাষ বন্ধ কর


আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি বাংলাদেশে জিএম ফসলের প্রবর্তন করে এ দেশের কৃষি ও ভোক্তা হিশেবে জনগণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির সহযোগিতায় জেনেটিক কারিগরির মাধ্যমে আমাদের অতি প্রিয় বেগুনের প্রাণ গঠনের পরিবর্তন করে বিটি বেগুন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ এবং আমাদের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্টি কৃষির উপর নির্ভরশীল। একই সাথে এদেশ ফসলের দিক থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যে বীজ সম্পদ আছে তা দিয়েই বোঝা যায়। এখানে সবজি, ডাল, তেলসহ জনগণের জন্যে প্রয়োজনীয় নানা ফসলের বীজ সংগ্রহ করা আছে। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের দেশের কৃষকদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান এবং আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের দক্ষতা দেশের কৃষিখাতকে অনেক সমৃদ্ধ করতে পারে।

আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ্য করেছি ২০০৫ সাল থেকে শুরু হওয়া জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহারে বিটি বেগুনের গবেষণা শুরু করে ২০১৩ সালে হঠাৎ তড়িঘড়ি করে কৃষক পর্যায়ে চাষের অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখে বিটি বেগুনের ৪টি জাত (বিটি বেগুন-১ (উত্তরা), বিটি বেগুন-২ (কাজলা), বিটি বেগুন-৩ (নয়নতারা) এবং বিটি বেগুন ৪ (ISD006) নামে অবমুক্ত করার অনুমোদন দেয়া হয়। গত ২২ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বারি) পক্ষ থেকে বিটি বেগুনের ৪টি জাত গাজীপুর, রংপুর, পাবনা ও জামালপুর এলাকায় মাঠ পর্যায়ে চাষ করার জন্য ২০ জন কৃষকের মাঝে চারা বিতরণ করা হয়েছে।


বিটিবেগুন প্রতিবাদ


আমরা উদ্বিগ্ন যে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের নামে এই বিতর্কিত জেনেটিকালি মডিফাইড খাদ্য ফসল ভারত ও ফিলিপাইনের মতো দেশে প্রবর্তন করা যায় নি, অথচ বাংলাদেশের মতো কৃষি নির্ভর দেশে প্রবর্তন করে কৃষক, ভোক্তা এবং বাংলাদেশের কৃষির জন্যে হুমকি তৈরি করা হচ্ছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করার কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং বলা হচ্ছে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে না। কিন্তু বেগুন গাছকেই বিষাক্ত করে দেয়া হচ্ছে, সেটাই হচ্ছে বিটি বেগুন। বেগুনে আরও যেসব পোকা ও রোগের আক্রমণ হয় তার জন্যে বিষ ব্যবহার কমছে না। অথচ যে সকল বেগুনের জাতের ওপর জেনেটিক ইঞ্জিনয়ারিং করা হচ্ছে যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং পোকার আক্রমন তেমন হয় না। তাই কীটনাশক অতিরিক্ত ব্যবহার কমাবার যুক্তি এখানে খাটে না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ করে খাদ্য ফসল চাষে কীটনাশক ব্যবহারের বিরোধিতা করছি। আমরা মনে করি জাতি সংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা স্বীকৃত সমন্বিত বালাই দমন (Integrated Pest Management) ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সে গবেষণা আরও ব্যাপকভাবে করে কৃষকের এবং ভোক্তাদের উপকার করতে পারে।


বিটিবেগুন প্রতিবাদ


বাংলাদেশ বেগুনের আদি উৎপত্তি স্থল এবং বেগুনের বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) দেশীয় বীজ রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করা আছে কৃষকের হাজার বছরের লালিত বেগুনের বিভিন্ন জাত। জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং প্রযুক্তি যে পদ্ধতিতে আমাদের দেশে আসছে তাতে কৃষকের পছন্দ ও চাহিদার কথা উপেক্ষা করেই বেগুনের স্থানীয় জাত কৃষকদের অনুমতি ছাড়াই বহুজাতিক কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে, পাশাপাশি কৃষকরা অপ্রস্তুত অবস্থায় বিটি বেগুনের মতো জিএম ফসল চাষে বাধ্য হচ্ছে, যা কৃষকের জন্য সর্বনাশ বয়ে আনবে। কৃষকরা এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মোটেও অবগত নয়।


বিটিবেগুন প্রতিবাদ


বেগুনে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের নামে মাটির ব্যাক্টেরিয়ার জিন, ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (bacillus thuringienesis সংক্ষেপে বিটি) ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রিসটাল জিন বেগুনে সংযোজন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হিশেবে বলা হয়েছে বেগুনের ফল ও কা- ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এভাবে বেগুনকে জিএম খাদ্য বানানো হয়েছে। এর আগে কোনো ফসলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় নি। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জিএম ফসল প্রবর্তনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিটি বেগুনের গবেষণায় এই ধরণের বিপজ্জনক টেকনোলজি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে আগাম হুঁশিয়ার থাকার নীতিমালা (Pre-cautionaryPrinciples) মেনে চলা হয়েছে কিনা তার কোন প্রমাণ মেলে নি। জিএম খাদ্যের উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক ঝুঁকি আছে বলে বিটি বেগুনের চাষের অনুমোদনের আগে ও পরে ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ হয়েছে; পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। কোর্টে মামলা হয়েছে। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে বিটি বেগুন মানুষের জন্যে এবং পরিবেশের জন্যে নিরাপদ কিনা না জেনেই কৃষক পর্যায়ে চাষের জন্যে দেয়া হয়েছে। এই ধরণের ফসলের চাষের জন্যে যে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয় কৃষকের তা জানা নেই। তাদের পক্ষে সব সতর্কতা মেনে চলা সম্ভব নয়। আশে পাশের কৃষকদের সাধারণ ফসলও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর সাথে খাদ্য নিরাপত্তারও কোন সম্পর্ক নেই, এটা কেবল পোকা দমন করার কৌশল হবে।


বিটিবেগুন প্রতিবাদ


বাংলাদেশের জন্যে বেগুনে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের ফলে কোন অর্থনৈতিক লাভ নেই। এই সবজিকে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং করার ফলে আন্তর্জাতিক বাজার বাড়বে না বরং সংকুচিত হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশী, কারণ বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে যারা সবজি আমদানী করে তারা জিএমও নয় এমন খাদ্যের জন্যেই কেনে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১১ কোটি ডলারের সবজি রপ্তানি হয়েছে ২০১৩ সালে, এর মধ্যে বেগুনও আছে। এ দেশ অতি আধুনিক জিএমও ফসলের উৎপাদনের জায়গা নয়, কাজেই এই ফসলে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং আমাদের সবজি রপ্তানী বাজারকে হুমকির মধ্যে ফেলবে, যার ইঙ্গিত ইতিমধ্যে ইওরোপের দেশগুলোর ভোক্তা সংগঠন থেকে পাওয়া যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশে জিএমও ফসল হলে লেবেল লাগাবার দাবী জানিয়েছে। অর্থাৎ যারা জিএম খাদ্য খেতে চান না, তারা যেন জানতে পারেন কোনটি জিএমও এবং কোনটি জিএমও নয়। অতএব, এদেশের সাধারণ কৃষক ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিরোধী এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর করা থেকে সরকার বিরত থাকবেন আমরা এই আশা করছি।


বিটিবেগুন প্রতিবাদ


আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য

১. বাংলাদেশে বিটি বেগুনের প্রয়োজন নেই। এটা করা হচ্ছে কোম্পানীর স্বার্থে, কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থে নয়।

২. স্বাস্থ্য ক্ষতি সংক্রান্ত কোন গবেষণা বাংলাদেশে হয় নি। ফলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণের ক্ষতি হবে না এই দাবী ভিত্তিহীন।

৩. পরিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্র্যের ক্ষতি স¤পর্কে কোন মূল্যায়ন বা হুঁশিয়ারি নাই। অথচ প্রাণবৈচিত্র্য সংক্রান্ত নানান আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যা করতে বাধ্য কারণ বাংলাদেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং তা বলবত করবার জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

৪. বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের কোন যৌক্তিকতা নাই। বিটি বেগুনের চারা বিতরণ ও চাষ, প্রাণ ও পরিবেশের মারাত্মক হুমকি। অবিলম্বে বিটি বেগুনের চাষ বন্ধ করা হোক; যে সব কৃষক চারা নিয়েছেন তাদের কাছে অনুরোধ দেশের ও কৃষির সর্বনাশ করবেন না।

৫. বাংলাদেশ ফসলের দিক থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ। এই দেশকে জিএম মুক্ত রাখতে হবে, নইলে এ দেশ বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এটা হতে দেয়া যাবে না।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।