তামাকের শৃংখল থকে মুক্তি

তামাকের শৃংখল থেকে মুক্তি, উবিনীগ; প্রথম সংস্করণ: ১৭ ডিসেম্বর ২০১২; নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা প্রকাশনা ঢাকা ১২০৭। পৃষ্ঠা ১৮৪; মূল্য:৬০০/=

‘তামাকের শৃংখল থেকে মুক্তি’ গ্রন্থটি প্রকাশ হচ্ছে দেখে আমি খুব খুশি। এর পেছনে আমার সহকর্মী ও বন্ধুদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম যেমন জড়িয়ে আছে, তেমনি জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের কৃষক ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।

যখন কৃষকদের সঙ্গে মিলে আমরা ‘নয়াকৃষি আন্দোলন’ গড়ে তুলি তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল বিষ ও রাসায়নিক সারের অভিশাপ থেকে কৃষক ও বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকে মুক্তি দেওয়া, কৃষির জন্য মাটির তলা থেকে পানি তোলা বন্ধ করা। কারন পরিবেশ, প্রাণ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য প্রকৃতির সঙ্গে এই দুষমনি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। এর কুফল সরাসরি ভোগ করে কৃষক ও গ্রামের মানুষ, আর কৃষি ব্যবস্থার বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের সবাই। আমাদের খাদ্য ও পুষ্টি চক্রে বিষ ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ঢুকে যাবার ফলে তার কুফল বয়ে বেড়াতে হয় আমাদের। আরেকটি বড় কাজ প্রাণবৈচিত্র ও প্রাণসম্পদ রক্ষা করা। এ ব্যাপারে আমাদের সমাজে সচেতনতা খুবই কম। একে রক্ষা করার কাজও অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ।

যেমন, বীজ। বীজ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে জমি থাকলেও বীজ নাই বলে আমরা চাষাবাদ করতে পারব না, বীজ কোম্পানির ওপর নির্ভর করা ছাড়া আমাদের উপায় থাকবে না। তাছাড়া বীজ সংরক্ষণ ও তা বছর বছর পুনুরুৎপাদন করা, কিম্বা নতুন জাত সনাক্ত করে পরিবেশ অনুযায়ী ভাল জাত নির্বাচন ও তার মধ্য দিয়ে ফসলের বৈচিত্র, গুণ ও পরিমান বাড়াবার যে জ্ঞান হাজার বছর ধরে কৃষক চর্চা করে এসেছে সেই চর্চাতেও ছেদ পড়বে। প্রাণোৎপাদনের যে সমৃদ্ধ জ্ঞান আমামদের জনগণের ওইতিহাসিক ভাবে রয়েছে তার ভিত্তি বিনষ্ট হবে। এর দীর্ঘস্থায়ী কুফল হচ্ছে নিজেদের বীজ, ফসল ও খাদ্য ব্যবস্থার ওপর আমাদের আর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। সেটা চলে যাবে যাবে অল্প কিছু সার, বিষ ও বীজ কম্পানির হাতে। নিজেদের জীবন নিজেরা উৎপাদনের ক্ষমতা যদি আমরা এভাবে হারিয়ে ফেলি তাহলে রাজনৈতিক সাবর্ভৌমত্বের কোন মর্ম আর থাকে না। এই অবশ্যম্ভাবী বিপদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্যই আমরা খাদ্য নিরাপত্তা না বলে ‘খাদ্য সার্বভৌমত্ব’ অর্জন ও রক্ষার কথা বলি।

বেশ কয়েক বহর আগে (২০০৫) সালে কুষ্টিয়ার কৃষক আমিনুল ইসলাম গায়েন আমাকে এসে তার এলাকায় তামাক চাষ কিভাবে আগ্রাসী রূপ নিয়েছে এবং কিভাবে তামাক কোম্পানির কাছে কৃষকেরা জিম্মি হয়ে আছে সে কথা বলেছিলেন। ধূমপান ক্ষতিকর, জানতাম, ফলে তামাক চাষে ক্ষতি আছে সেটা কাণ্ডজ্ঞানেই বুঝতাম। তামাক চাষ শুধু তামাক চাষীদের জন্য নয় বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার জন্য কতো বড় হুমকি সেটা আন্দাজ করতে পারি নি। তাছাড়া কোম্পানি – বিশেষত বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগকেই আমরা সাধারণত পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক গণ্য করি। কিন্তু তামাক চাষের ক্ষেত্রে সে পুঁজি একটা সামন্তীয় মহাজনী রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে, সে সম্পর্কেও আমাদের দেশে বিশেষ গবেষণা হয়েছে বলে দেখি নি। তখন আমরা উবিনীগ থেকে বিষয়টি আরো সরেজমিনে দেখার জন্য আগ্রহী হই। এখান থেকেই উবিনীগের উদ্যোগে তামাক চাষ বন্ধ করে সেখানে খাদ্য উৎপাদনের সমস্যা ও তা সমাধানের সম্ভাব্য নীতি ও কৌশল কি হতে আরে তার জন্য গবেষণার শুরু করি। শুরু থেকেই আমরা চেয়েছি সরাসরি কৃষক যেন নিজেই তামাক চাষের ক্ষতি এবং তামাক চাষ থেকে বেরিয়ে আসার সমস্যাটি চিহ্নিত করে। বাইরে থেকে তাদের বাতলে দিলে সেটা কাজ করবে না। কাজটি করার জন্য কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র (IDRC) সহযোগিতা করেছে। তিনটি প্রধান তামাক চাষের এলাকা কুষ্টিয়া, কক্সবাজার ও বান্দরবানে ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত তামাক চাষ বন্ধ করে খাদ্য উৎপাদনে কিভাবে ফিরে আসা যায় সে গবেষণা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই গবেষণা কাজটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক নিয়ে এর আগে তে্মন কোন গবেষণা হয় নি। তামাকের অর্থনীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে পক্ষান্তরে তামাককে একটি অর্থকরী ফসলের মর্যাদা দেয়া হয়েছে, যা তামাকের ক্ষেত্রে মোটেও প্রযোজ্য নয়। তামাক আদৌ কোন ‘ফসল’ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। এটা কোন অবস্থাতেই কৃষকের ফসল নয়। এর সাথে কৃষকের জীবন জীবিকার কোন সম্পর্ক পাওয়া যায় না। কৃষক তামাক উৎপাদন করে কোম্পানির প্রচারে ধরা দিয়ে; কোম্পানির সাথেই তার সম্পর্ক, আর কারো সাথে নয়। প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামুলক বাজার ব্যবস্থার সম্পর্কের মধ্যে কৃষক এই সিদ্ধান্ত নেয় না। সে দিক থেকে তামাকের অর্থনীতি বলে মুক্ত বাজার সম্মত কিছু নাই, এটা নিতান্তই কোম্পানির ঋণ ও তামাক পাতা কেনার বিধিবিধানের শৃংখলে আবদ্ধ একটি মধ্যযুগীয় মহাজনী প্রথা। এর পেছনে আছে কোম্পানির সীমাহীন শোষণ। এই গ্রন্থে যে সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা একেবারে মাঠের কাঁচা তথ্য, এবং দীর্ঘ চার বছরের সংগৃহিত যাচাই-বাছাই করা তথ্য। তার চেয়েও বড় কথা, কৃষকরা নিজেরা জড়িত থেকে কাজটি করেছেন। আমরা বিশ্বাস করেছি কৃষক তার নিজের অবস্থা নিজে বোঝার মতো জ্ঞান ও বুদ্ধি ধারণ করেন। তারা নিজেরা গবেষণা করতে সক্ষম এবং তাঁদের নিজেদের মতো করে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের গুরুত্ব অসাধারণ। তাঁরা দেখিয়েছেন তামাক চাষ বন্ধ করা সম্ভব এবং এর পরিবর্তে সেই এলাকায় আগে যে খাদ্য ফসল চাষ করা হোত কিম্বা এলাকার পরিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ফসলের জাতই বিশেষ ভাবে উৎপাদন করা উচিৎ। অন্য কোন একাট্টা, কিম্বা শুধু বাজারের জন্য অর্থকরী ফসল করতে হবে এমন কোন কথা নেই। কৃষককেও তো খেতে হয়, তিনি হাঁসমুরগি গরু ছাগল পালেন। তাদেরও খাদ্য দরকার, সেটাও মাঠ থেকেই চাষ করে খাওয়াতে হবে। আমরা দেখেছি, কৃষকরা যা হারিয়েছেন তা ফিরে পেতে চান, এই অর্থে নয় যে পুরানা বা সনাতন কৃষিতে প্রত্যাবর্তনই সমাধান। তারা তাদের মাটির উর্বরতা ফিরে পেতে চান, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষ ও রাসায়নিক পদার্থ বন্ধ করতে চান। অর্থাৎ পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষার মধ্য দিয়েই তাঁরা কৃষি পদ্ধতির চর্চা ও কৃষি ব্যবস্থার বিকাশ চান। সেই কাজটি কৃষক জমিতে তামাক চাষ না করে দুটী রবি ফসলের মৌসুমে খাদ্য উৎপাদন করে প্রমাণ করেছেন, এটা করা সম্ভব। অর্থাৎ একদিকে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষা করা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া। তবে তামাক কোম্পানি যেমন কৃষককে বীজ থেকে শুরু করে সার, কীটনাশক সব কিছু দিয়ে কোম্পনির শৃংখলে কৃষককে বেঁধে ফেলে, শেষ পর্যন্ত পাতাটি কিনে নেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সময় পর্যন্ত কৃষকের প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। ফসল বাজার জাত করবার সহায়তাও কৃষকের প্রয়োজন হতে পারে। এই গবেষণার ক্ষেত্রে নয়াকৃষি আন্দোলন সেই ভুমিকা পালন করেছে। তারা তামাক চাষীদের স্থানীয় জাতের বীজ সরবরাহ করেছেন, সার-কীটনাশক ব্যবহার না করে ফসল ফলাবার পদ্ধতি শিখিয়েছেন তাদের জানা পদ্ধতির ভাল দিক নতুন করে দেখিয়ে দিয়েছেন এবং ফসল বাজারজাত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন। এসব দিক থেকে এই গ্রন্থে যে সব তথ্য তা গবেষক, কৃষক, সমাজ কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, নীতি নির্ধারক বা যারাই বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষি নিয়ে ভাবেন তাদের সবারই কাজে আসবে।

ফরহাদ মজহার

Back to album