বিকৃত বীজ

বিকৃত বীজ । ফরিদা আখতার; দ্বিতীয় প্রকাশ: ফাল্গুন ১৪২৯, ফেব্রুয়ারী ২০২৩। প্রথম প্রকাশ: ফাল্গুন ১৪১৫, ফেব্রুয়ারী ২০০৯। আগামী প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০। ফোন: ০১৭৯০৫৮৬৩৬২।

পৃষ্ঠা: ১৮৪; মূল্য: ৪০০/=

----------------------------------------------------------

বাংলাদেশ কৃষি ও প্রাণসম্পদে প্রাচুর্যপূর্ণ একটি দেশ। আমাদের রয়েছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, লালন ও বিকাশের দীর্ঘ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জ্ঞানভান্ডার। কৃষি ও কৃষকের সংস্কৃতির মধ্যে চর্চিত হয়ে সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ঋতুচক্র ও প্রকৃতির পারস্পরিক সুষম বিন্যাসের ভেতর দিয়ে একটি উৎকৃষ্ট চাষাবাদব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। মাটি ও অঞ্চলভেদে উপযুক্ত প্রজাতি নির্বাচন, নতুন জাতের উদ্ভাবন ও তাকে সংহত করে খাদ্য ও পুষ্টিগুণানুযায়ী শস্যপঞ্জিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার যে ভারসাম্যপূর্ণ কৃষিব্যবস্থা আমাদের পূর্বপুরুষদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল তাতে আজ মারাত্মক ছেদ পড়েছে।

আধুনিক কৃষির নামে ষাটের দশকে 'সবুজ বিপ্লব'-এর মারফতে একদিকে রাসায়নিক উপকরণ, কীটনাশক ও কৃৎকৌশলের নির্বিচার প্রচলন মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস, পরিবেশের বিপর্যয়, পানি দূষণ করাসহ সর্বোপরি আমাদের নিজস্ব কৃষিব্যবস্থাপনাকে ধ্বংসের সূচনা করে; অন্যদিকে জিনবিপ্লবের বরাতে উচ্চফলনশীলতার দোহাই দিয়ে বিদেশি কোম্পানির বীজের বাজারে পরিণত করার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়। খুব সহজে প্রপাগান্ডার শিকার হয়ে, জনসংখ্যার ভয়ে আমরা নিজেদের বিপুল প্রাণসম্পদ লুণ্ঠন, কৃষিকে গুটিকয়েক বিদেশি কোম্পানির মুনাফা কামানোর নিশানা বানিয়ে দিই। তাদের আধিপত্য ও বীজ ডাকাতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের এ-বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের কাজ।

আবার খাদ্য চাহিদা ও সংকটের অজুহাতে নতুন নতুন কৃৎকৌশলের বাহারি প্রচারণা দিয়ে শুধু মুনাফা ও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য এমন কিছু প্রজাতি প্রচলনের চেষ্টা করা হচ্ছে যা বৈজ্ঞানিকভাবে এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়। শস্যের মধ্যে নানা প্রাণীর জিনের বৈশিষ্ট্য প্রবেশ করিয়ে তাতে যে গুণাগুণ আরোপ করা হচ্ছে, তা শেষপর্যন্ত কী ফল দেয় ও পরিবেশে এবং মানবদেহের ওপর কী প্রভাব ফেলে, তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। জিন-মিশ্রণের এই কারিগরিকে অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীই প্রাণ ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন। তবু আমাদের দেশে খাদ্যের সংকট ও নানান রোগবালাইয়ের কথা বলে এই ধরনের বিকৃত বীজের প্রচলনে কোম্পানিগুলো পুরো মাত্রায় উঠেপড়ে লেগেছে।

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

'বিকৃত বীজ' প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে। তেরো বছর পর আবার বেরুলো। এবার আগামী প্রকাশনীকে ধন্যবাদ, বিশেষ করে মেনন ভাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন একটি বিষয়ের প্রতি আগ্রহ প্রকাশের জন্য।

প্রথম সংস্করণের পর দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিকৃত বীজের কারবারী বহুজাতিক কোম্পানি আরো বেশি সক্রিয় হয়েছে এবং তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়িয়েছে। তারা তাদের ব্যবসা জোরদার করার জন্যে একে অন্যের সাথে হাত মেলাচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসার কিভাবে জোটবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে তার তথ্যও দেয়ার চেষ্টা করেছি। এই কারণে বিকৃত বীজের দ্বিতীয় সংস্করণে নতুন তথ্য দিয়ে আপডেট করতে হয়েছে এবং একটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে জিএমও ফসলের গবেষণা চলছে এবং কৃষক পর্যায়ে চাষের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে, যা খুব উদ্বেগজনক। দুইহাজার নয় সালের পর থেকে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব থাকায় বহুজাতিক কোম্পানি সেই সুযোগ নিয়ে তাদের ব্যবসার ক্ষেত্র হিশেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। সেই সব তথ্যও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

এটাও বলা দরকার যে একদিকে কোম্পানি তাদের ব্যবসা শক্তিশালী করছে, তারা বিভিন্ন দেশের সরকারকে প্রভাবিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে, অন্যদিকে জিএমও বিরোধি আন্দোলন বিশেষ করে "GM- free" দেশ ঘোষণার আন্দোলনও জোরদার হচ্ছে। নির্দিষ্ট ভাবে মনসান্তোর উৎপাদিত গ্লাইফোসেট ভিত্তিক আগাছানাশক (Herbicide) কুখ্যাত Round- Up এর ক্ষতির কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ২০১৬ সালে নেদারল্যান্ডের The Hague শহরে মনসান্তোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মনসান্তো ট্রাইব্যুনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল, উবিনীগ সেখানে মনসান্তোর বিটি বেগুনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। ইওরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে ভোক্তারাও সচেতন হচ্ছে, তারা জানতে চায় তাদের খাদ্যের মধ্যে কি আছে। তাই জিএম খাদ্যের ওপর লেবেল দেয়ার বাধ্যবাধকতার দাবি উঠেছে, যদিও কোম্পানি সে বিষয়ে আগ্রহী নয় কারণ তারা জানে জিএম লেখা লেবেলের পণ্য কম বিক্রি হতে পারে।

বাংলাদেশে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে গোপনীয়ভাবে বিকৃত বীজ যেমন বিটি বেগুন প্রবর্তন করা এবং এর বিরুদ্ধে পরিবেশ ও কৃষক সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালে সোচ্চার প্রতিবাদ। জিএম বিরোধী মোর্চাও গঠিত হয়েছে, উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলন এই সব আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছে এবং নেতৃত্বে আছে। নয়াকৃষির কৃষকরা গ্রাম পর্যায়ে এবং ঢাকা শহরে এসে মিছিল এবং সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিটি বেগুন এখন মাঠ পর্যায়ে চাষের পর্যায়ে আছে, যদিও চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তবে কোম্পানির প্রপাগান্ডায় মিথ্যা সাফল্য দেখানো হচ্ছে। অন্যদিকে ২০১৭ সাল থেকে বিকৃত ধান তথাকথিত ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ 'গোল্ডেন রাইস' অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় আছে। কাজেই এই দুটি বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে।

উবিনীগ ২০১৪ সাল থেকে মাঠ পর্যায়ে বিটি বেগুন চাষীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছে। এই কাজে যুক্ত আছেন গোলাম রাব্বি বাদল, আব্দুল জব্বার, গোলাম মোস্তফা রনী ও রবিউল ইসলাম চুন্নু। তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সাধারণভাবে জিএমও বিষয়টি আগের তুলনায় একটু জানাজানি বেড়েছে। তাই আশা করছি দ্বিতীয় সংস্করন পাঠকরা আগ্রই ভাবে গ্রহন করবেন। 

আবারও ভুলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিচ্ছি।

ফরিদা আখতার; ২৬ মাঘ ১৪২৯ / ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সূচিপত্র

প্রথম অধ্যায়

আধুনিক কৃষির অভিজ্ঞতা । ১৯
বিকৃত বীজ প্রবর্তনের কথা । ২৯
বিকৃত বীজ ও খাদ্য সমস্যা। ৪২
কৃষক নয়, করপোরেশন। ৫২
বিকৃত বীজ ও শস্য। ৭০
বিকৃতির বিপর্যয়। ৮৫
জিএমও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। ৯২

দ্বিতীয় অধ্যায়

আধুনিক কৃষির অভিশাপ না যেতেই জিই প্রযুক্তি! ॥ ১১৯
গ্লাইফোসেট ও মনসান্তো ॥ ১৩৫
বিকৃত বীজের ঝুঁকির প্রশ্ন । ১৪০
বিটি বেগুন: অতি প্রিয় বেগুনের বিকৃতি । ১৪৬
বিষ ব্যবহারে নির্বিচারে প্রাণ ধ্বংসের ভয়াবহতা। ১৫০
তথাকথিত মাঠ গবেষণা বিকৃত বিজ্ঞানের স্বরূপ। ১৫১
বিকৃত বেগুন ও আইন এবং রাষ্ট্রের বিকৃতি । ১৫৪
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ধারণায় বিকৃতি । ১৫৮
গোল্ডেন রাইস: বিকৃত ধান ॥ ১৬০
বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইসের প্রয়োজন নাই। ১৬৭
কিছু নতুন তথ্য । ১৬৯
শেষের কথা । ১৭১ 

 

Back to album