ধোঁয়াবিহীন তামাক ও নারীর প্রতিরোধ

ধোঁয়াবিহীন তামাক ও নারীর প্রতিরোধ, তাবিনাজ; প্রকাশক: নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা ৬/৮ স্যার সৈয়দ রোড, মোহাম্মদপুর। ঢাকা- ১২০৭, বাংলাদেশ। ফোন: ৮৮-০২৫৮১৫৫০১৫। প্রথম সংস্করণ: ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩। পৃষ্ঠা: ১১১। মূল্য: ২৫০ টাকা।

তাবিনাজ গঠন ও আত্মপ্রকাশ

তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে ২০১১ সালের ৬ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের (৮ই মার্চ) প্রাক্কালে। তাবিনাজ গঠন এবং সকল প্রকার তামাক ব্যবহার ও তামাক চাষের বিরুদ্ধে নারীদের সংগঠিত করা বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে নতুন ভাবে হাজির করে, নারী আন্দোলনের নতুন অভিমুখও এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে তাবিনাজ গঠন সে কারনে ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অর্থ শুধু পারিবারিক বা আর্থ-সামাজিক সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়, একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী তামাক কোম্পানির কর্পোরেট ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। নারীর লড়াই কর্পোরেট বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যেখানে নারী সমাজের বৃহত্তর লড়াই ও গণপ্রতিরোধের সঙ্গে যুক্ত। তাবিনাজ নিজের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে এই গভীর ও সুদূরপ্রসারি বার্তাটি হাজির করেছে।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধের সঙ্গে নারীর নিজের শরীর সুরক্ষার প্রশ্ন যেমন জড়িত তেমনি পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশ্নও জড়িত। অন্য দিকে কৃষি জমিকে তামাক মুক্ত করা এবং সকল প্রকার তামাক ব্যবহার বন্ধ করার দাবির মধ্য দিয়ে তামাক ব্যবসায়ী মুনাফাকারি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তাবিনাজ দাঁড়িয়েছে। এর দ্বারা তাবিনাজ বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট আধিপত্যের সঙ্গে নারীর স্বার্থের দ্বন্দ্বও সামনে হাজির করেছে। নারী আন্দোলনে তাবিনাজ তাই সম্পূর্ণ এক নতুন যাত্রা যোগ করেছে। তাবিনাজের আত্মপ্রকাশ তাই শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক ভাবেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বব্যাপী ধূমপান বিরোধী জনমত গড়ে উঠছে এবং ধূমপান নিয়ন্ত্রণ, এমনকি বন্ধের জন্য আন্দোলন চলছে। ধূমপানের কারণে স্বাস্থ্য এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকগুলো এখন অত্যন্ত পরিষ্কার। নারী নানা ভাবে তামাক সেবনের সাথে যুক্ত, তামাক কোম্পানিগুলো তামাকের নতুন ভোক্তা ও বাজার হিশাবে নারীদের টার্গেট করছে। তবে এ পর্যন্ত ধূমপান বা তামাক সেবনের বিষয় নিয়ে আলোচনা পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তামাক বিরোধী আন্দোলনও পুরুষরাই মূলতঃ পরিচালনা করেছেন। তাবিনাজ সমাজের বৃহত্তর সমস্যাকে পুরুষকেন্দ্রিকতার বাইরে নিয়ে এসে নারীর ভূমিকা ও নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে।

শুধু ধূমপান ও তামাক সেবন নয়, নারীরা তামাক উৎপাদনের কারণেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তামাক চাষ করতে ব্যাপকভাবে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এর ফলে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। গর্ভবর্তী নারীদের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়, কিংবা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়। এ ছাড়াও নারীদের অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। নারীরা নানা ভাবে তামাক সেবনের সাথে যুক্ত থাকলেও ধূমপানের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টিকে কখনই গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। তামাক ব্যবহার ও তামাক চাষ বিরোধিতা নারী আন্দোলন কিংবা নারী স্বাস্থ্য আন্দোলনের দাবী-দাওয়ার অংশ হয়নি। তাবিনাজ তামাক বিরোধী আন্দোলনকে নারী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করবার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকে নতুন বৈশিষ্ট্য এবং তাৎপর্য দান করেছে।

তাবিনাজের আত্মপ্রকাশ হঠাৎ করে ঘটে নি। বাংলাদেশে ধূমপান বিরোধী আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে তা বেশীর ভাগ পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নারীদের ধূমপায়ী হিসেবে যেমন চিহ্নিত করা হয় না, তেমনি ধূমপান বিরোধী আন্দোলনেও নারীদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা দেখা যায় না। তাই নারী সংগঠনগুলো প্রতি বছরে নারী নির্যাতন বিরোধী বিভিন্ন দিবস পালন করলেও ৩১ মে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবসে কোন কর্মসূচী গ্রহণ করে না। বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস, ২০১০ পালন করার সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নারীর ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালের বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য হিশাবে তামাক পণ্য বাজারজাত করারা ক্ষেত্রে কিভাবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নারীকে ব্যবহার করে তার ওপর জোর দেয়।

নারীদের তামাক সেবনে উৎসাহিত করার জন্য তামাক কোম্পানীর কৌশলের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস (৩১ মে, ২০১০) পালন করার জন্য নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা ও উবিনীগ উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং "নারী স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্য তামাক কোম্পানী দায়ী" শীর্ষক সভাটির আয়োজন করে। সভাটি অনুষ্ঠিত হয় আইডিবি ভবন, আগারগাঁও, ঢাকা-১২০৭। এই সভায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন পেশার নারীরা অংশগ্রহণ করেন। জেলা পর্যায় থেকে আগত নারীরা নিজ নিজ এলাকার চিত্র তুলে ধরেন। সকলের আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, নারীদের জন্য তামাক বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। তাই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় একটি 'তামাক বিরোধী নারী জোট' গঠন করা হবে।

'তামাক বিরোধী নারী জোট' গঠনের প্রস্তাব নেয়া হয় ৩১ মে, ২০১০ তারিখে। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে ৬ মার্চ, ২০১১ তারিখে তাবিনাজ আত্মপ্রকাশ করে। তখন থেকে তাবিনাজের সদস্য সংগঠনগুলো ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করবার কাজ করে যাচ্ছে।

তাবিনাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

এক

নারী নানা ভাবে তামাক সেবনের সাথে যুক্ত। তবুও ধূমপান ও তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কুফলে নারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি কখনই গুরুত্ব পায় নি, গুরুত্ব দেওয়াও হয় নি। এমঙ্কি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নারী আন্দোলন কিংবা নারী স্বাস্থ্য আন্দোলনের দাবী-দাওয়ারও অংশ হয়নি। তাই ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে সকল পর্যায়ের নারীপুরুষদের সচেতন ও সংগঠিত করা তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ)-এর প্রধান একটি লক্ষ্য। গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বৃহত্তর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তাবিনাজ তামাকদ্রব্য ব্যবহার ও তামাক চাষ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে চায়।

দুই

বিশ্বব্যাপী ধূমপান বিরোধী জনমত গড়ে উঠেছে। ধূমপান নিয়ন্ত্রণ, এমনকি বন্ধের জন্য আন্দোলন চলছে। ধূমপানের কারণে স্বাস্থ্য এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকগুলো এখন অত্যন্ত পরিষ্কার। এ পর্যন্ত ধূমপান বা তামাক বিরোধী আন্দোলন পুরুষদের মধ্যেই প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল। তাঁরাই মূলতঃ এই আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। নারীর ওপর তামাকের ক্ষতির দিকটি সবসময়ই উপেক্ষিত হয়েছে। তাই তামাক ব্যবহারের কুফল ও তামাক চাষের ক্ষতি থেকে সকলকে রক্ষা ছাড়াও বিশেষ ভাবে নারীদের রক্ষার প্রতি মনোনিবেশ ও সক্রিয়ভাবে কাজ করাই তাবিনাজের প্রধান উদ্দেশ্য।

তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার এবং তামাক চাষ বন্ধ করার জন্য জনমত তৈরি ও নিজেদের সংগঠিত করবার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা তামাক ব্যবহার ও তামাক চাষ বিরোধী আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) এর প্রধান লক্ষ্য।

তিন

তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার এবং তামাক চাষ বন্ধ করাকে নারী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকে আরও বড় পরিসরে উন্নীত করতে চায়। বিশেষত স্বাস্থ্য, পুষ্টি, কৃষি, প্রাণ ও প্রকৃতির সুরক্ষা এবং প্রাণ বৈচিত্র্য ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার আন্দোলনকে শক্তিশালী করবার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনকে শক্তিশালী পরিবেশ ও প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা তাবিনাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্য।

চার

বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার এবং তামাক চাষ নিষিদ্ধ করবার কোন আইন ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল, ২০০৪ স্বাক্ষরকারি দেশ হিশেবে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়, বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে "ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫" প্রণয়ন করেছে। অথচ এই আইনে নারীদের রক্ষা করার কোন নির্দিষ্ট বিধান নাই। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগে তাবিনাজ সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে এবং ইতোমধ্যে ২০১৩ সালে "ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫" কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে। তাবিনাজ দাবি করেছে যে তামাক দ্রব্যের সংজ্ঞার মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য (জর্দা, সাদাপাতা, গুল) ছিল না, অথচ ধোঁয়াবিহীন তামাকই নারীরা বেশি সেবন করেন। সংশোধিত আইনে এই দ্রব্যগুলো তামাক দ্রব্যের সংজ্ঞায় স্থান পেয়েছে। তাবিনাজের কাজের একটি প্রধান দিক হচ্ছে ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্যের (জর্দা, গুল, সাদাপাতা) উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের কাজ করা।

পাঁচ

শুধু ধূমপান ও তামাক সেবন নয়, নারীরা তামাক উৎপাদনের কারণেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তামাক চাষ করতে ব্যাপকভাবে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় এবং তামাক পাতা পোড়ানোর জন্যে নারীদের ব্যবহার করা হয়। তারা নিকোটিন এবং তামাকের বিষাক্ত ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়। এর ফলে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। গর্ভবর্তী নারীদের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়, কিংবা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়। এ ছাড়াও নারীদের অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। নারীরা নানা ভাবে ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের সাথে যুক্ত থাকলেও এবং ধূমপানের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিষয়টি নারী আন্দোলন কিংবা নারী স্বাস্থ্য আন্দোলনের দাবী-দাওয়ার অংশ হয়নি। তাবিনাজ তামাক বিরোধী আন্দোলনকে তাই বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়।

ছয়

তামাক চাষ ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনের সাথে নারীরা জড়িত থাকায় নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তামাকের পাতা পোড়াতে গিয়ে নারীদের ৬০ থেকে ৭২ ঘন্টা এক নাগাড়ে না ঘুমিয়ে থাকতে হয়। এর ফলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা যায়। তাই তামাক চাষ ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনের সাথে জড়িত নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও তাদের মজুরী শোষণের অবসানের জন্য তাবিনাজ মেহনতজীবী খেটে খাওয়া মানুষ বা শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে শ্রম শোষণ থেকে মুক্তি চায়।

সাত

দেশের বিশিষ্ট নারী ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, কবি, লেখিকা, আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনী, ব্যবসায়ীসহ সকল পেশার নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবার মধ্য দিয়ে তাবিনাজ তামাকদ্রব্য ব্যবহার এবং তামাক চাষ বন্ধ করার আন্দোলনের পক্ষে সমাজের সজ্ঞান ও সচেতন নাগরিকদের সমর্থন মজবুত করতে চায়।

আট

জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং বিশেষ ভাবে নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে তাবিনাজ আইন প্রণয়ন ও সংশোধনে ভূমিকা রাখছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী মহলে মত বিনিময় ও তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে সঠিক নীতিনির্ধারণে তাবিনাজ সহযোগিতা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সুপারিশ করছে।

ভূমিকা

আন্দোলনের কথা দূরে থাক, দূর্ভাগ্য যে বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য জর্দা, গুল, সাদাপাতা, খৈনি ইত্যাদির উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুব বেশি কাজ হয় নি। তামাক নিয়ন্ত্রণ বলতে সব সময় ধূমপান নিয়ন্ত্রণই বোঝানো হয়েছে এবং পুরুষরা বিশেষ করে চিকিৎসকরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং এখনও আছেন। বাংলাদেশে ধূমপানের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশানের ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) এম এ মালিক। তাঁদের কথা না বললে তামাক নিয়ন্ত্রণ কিম্বা তামাক ব্যবহার বিরোধিতার কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁদের কাজ সত্তরের দশক থেকে শুরু হয়েছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার 'ফ্রেম ওয়ার্ক কনভেনশান অন টোবাকো কন্ট্রোল (WHO FCTC) সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি বিশ্ব সাহায্য সংস্থা পাশ করে ২০০৩ সালে, ২১ মে তারিখে এবং কার্যকর করা শুরু হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সালে (WHO Framework Convention on Tobacco Control World Health Organization 2003)। এই দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশ এই আন্দোলনে অনেক এগিয়ে রয়েছে। তবে ধেঁায়াবিহীণ তামাকের বিষয়ে দন্ত চিকিৎসক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসকরা খুব বেশি বলেন নি।

তাবিনাজ (তামাক বিরোধী নারী জোট) ২০১১ সালে গঠিত হওয়ার সাথে ধোঁয়াবিহীন তামাকের বিরুদ্ধে নারীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস, ২০১০ পালন করার জন্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নারীর ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। সে বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালের বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য গ্রহণ করে 'নারীদের সম্পৃক্ত করার জন্য তামাক কোম্পানীর কৌশল'। এই প্রেক্ষিতে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস (৩১ মে, ২০১০) পালন করার জন্য নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা ও উবিনীগ "নারী স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্য তামাক কোম্পানী দায়ী" শীর্ষক সভার আয়োজন করে। তখন পর্যন্ত কোন নারী সংগঠন নারীদের বিষয় এমন কি নারী স্বাস্থ্যের বিষয় হিসাবে তামাকের প্রসঙ্গ আনে নি।

এই আলোচনা সভায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন পেশার নারীরা অংশগ্রহণ করেন। জেলা পর্যায় থেকে আগত নারীরা নিজ নিজ এলাকার চিত্র তুলে ধরেন। সকলের আলোচনা-পর্যালোচনা থেকে সিদ্ধান্ত হয়, নারীদের জন্য তামাক বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে একটি 'তামাক বিরোধী নারী জোট' গঠন করা হবে। 'তামাক বিরোধী নারী জোট' গঠনের প্রস্তাব নেয়া হয় এই সভায় ৩১ মে, ২০১০ তারিখে। যার প্রেক্ষিতে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে ৬ মার্চ, ২০১১ তারিখে তাবিনাজ আত্মপ্রকাশ করে। তাবিনাজের সদস্য সংগঠনগুলো ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের বিরুদ্ধে এবং তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। ক্রমে তাবিনাজ অন্যান্য নারী সংগঠনের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং জাতীয় পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে।

তাবিনাজ গঠনের পর থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি, এই কাজ আরও অনেক আগে শুরু করা দরকার ছিল। যাদের সাথেই আমরা কাজ করেছি তাঁদের এটা বোঝানোর দরকার পড়ে নি যে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নারীদের জন্য কত ক্ষতিকর। তারা নিজেরা ব্যবহার করুক কিংবা তার আশে পাশে, ঘরে বাইরে যারা আছে করুক -- সকলেই তামাক থেকে মুক্তি চান। তামাকের ক্ষতি থেকে নারীর রেহাই পাওয়া খুব কঠিন কাজ। তবুও এখন থেকেই কাজ করলে অনেক উপকার হতে পারে এই চিন্তা থেকেই তাবিনাজ খুব সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছিল।

মূল কাজ হচ্ছে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নারীদের রক্ষা করা। নারী নিজে নিজেকে রক্ষা করতে পারলে পরিবারের অন্য সকলেই রক্ষা পাবেন এমন আশা নিশ্চয়ই করা যায়। কিন্তু এই কাজ শুরু করতে গিয়ে প্রথম হোঁচট খেয়েছিলাম। কারণ ভালভাবে করতে হলে আমাদের যথেষ্ট তথ্য দরকার। তাবিনাজের কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি তথ্য যা আছে, তা খুব কম এবং কোথাও গুছিয়ে নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে সঠিকভাবে তথ্য ব্যবহার করা যায় না। তথ্য, উপাত্ত, গবেষণা ও লেখালিখির অভাবে তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারীরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যবসা করেছে এবং মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে।

বাংলাদেশে নারীরা প্রধানতঃ ধোঁয়াবিহীন তামাক (জর্দা, গুল, সাদাপাতা) ব্যবহার করেন। এই দ্রব্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপেই ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তাবিনাজ তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারের কারণে ক্ষতির বিরুদ্ধে নারীদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।

এই উদ্দেশ্যে তামাক চাষ ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারের নানা ক্ষতির কথা তুলে ধরে একটি তথ্য চিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল ২০১১ সালে। দীর্ঘ ১১ বছর পার হয়ে যাবার পরও এই তথ্য এখনও কার্যকর। এই তথ্য চিত্রের কিছু অংশ এবং তাবিনাজের আহবায়ক ফরিদা আখতারের বিভিন্ন সময়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লেখা যুক্ত করে ধোঁয়াবিহীন তামাক ও নারীর প্রতিরোধ গ্রন্থটি প্রকাশ করা হচ্ছে। সারা দেশে তাবিনাজের সদস্যরাও নানা সময় যে সব তথ্য দিয়েছেন তা আমরা কাজে লাগিয়েছি।

ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ন্ত্রণের বিষয় এখন জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত বিষয় এবং নীতি নির্ধারণী পর্যায়েও গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। ধূমপান বিরোধী আন্দোলনে যারা আছেন তাঁরাও ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলছেন এবং তাবিনাজের কর্মসূচিতে যোগদান করছেন। আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশে ধূমপান বিরোধী এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক বিরোধী আন্দোলন একত্র হয়ে একটি শক্তিশালী তামাক বিরোধী আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে অনেক নারী আছেন, আগের তুলনায় যারা এখন অনেক বেশী দৃশ্যমান। ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সামিনা চৌধুরী এবং ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. এফ এ আসমা খান এর সক্রিয় ভূমিকা আমরা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই।

এই বইটি তামাক বিরোধী আন্দোলনে যারা আছেন এবং যারা দেশের মানুষের সুস্থতা চান তাঁরা কাজে লাগাতে পারলে আমরা খুশি হবো।

সাইদা আখতার
সমন্বক, তাবিনাজ

সূচি:

তাবিনাজ গঠনের প্রেক্ষাপট

তাবিনাজ গঠন ও আত্মপ্রকাশ/৮
তাবিনাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য/১১
ভূমিকা/১৪
তামাক ও বাংলাদেশ/২০

তামাকজাতদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন

মানুষের জীবন বাঁচাতে সংশোধিত ও কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন চাই/২৮
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন জরুরি/৩২
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের দাবি/৪২
মমতা, ওবামা ও বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ/৪৬ 

তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে করারোপ

কর বৃদ্ধির আওতায় ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য/৫২
জর্দা-গুল ব্যবহার কমাতে উচ্চহারে করারোপ করুন/৫৬
বিড়ি-সিগারেট কর বিতর্ক: তামাক কোম্পানীর কৌশল/৬০
কৃষি মন্ত্রীর বেখেয়ালের সুযোগে তামাকে শুল্ক হার কমলো!/৬৪

তামাক চাষ ও রাজনীতি

তামাকের আগ্রাসন রুখতে হবে/৭০
আদালতের নির্দেশ ও তামাক চাষ বন্ধের উদ্যোগ/৭৪
তামাকের ক্ষতি বনাম তামাক কোম্পানীর পুরস্কার পাওয়া!/৭৮
তামাক ও নির্বাচন/৮১
রাজনীতির জগাখিচুড়ি সিগারেটের সুখটান/৮৪
ঝলসে যাওয়া গীতা সরকারের প্রতিবাদ বনাম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে রাতভর ভীড়/৮৭
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে তামাক ছাড়ার অঙ্গীকার ঘোষণা/৯০ 

তাবিনাজের গবেষণা:
ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য জর্দা, সাদাপাতা, গুল

খেতে আনন্দ কিন্তু ক্ষতির শেষ নাই/৯৬
জর্দা ও সাদাপাতা ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ কেন জরুরি?/১০১
কিছু গুরুত্বপুর্ণ তথ্য/১০৮
তাবিনাজ সদস্যদের গবেষণায় অংশগ্রহণ ১০৯
জর্দা ও গুল ফ্যাক্টরি/১১০
বয়াতি শিল্পী আলেয়া বেগমের গান/১১১

 

 

 

Back to album