লতিফা আপা নিজের ঘরে নিজেই যেন বৃদ্ধাশ্রমে ছিলেন:


সোমবারের আড্ডায় প্রয়াত প্রফেসর লতিফা আকন্দ এর প্রতি স্মৃতিচারণ এবং শ্রদ্ধা নিবেদন

প্রয়াত প্রফেসর লতিফা আকন্দ এর প্রতি নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় অনুষ্ঠিত সোমবারের আড্ডায় স্মৃতিচারণ এবং শ্রদ্ধা প্রদান করা হলো ৮ ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখে। সোমবারের আড্ডার সকল সদস্য গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন লতিফা আপাকে। উপস্থিত সদসদের মধ্যে অনেকেই লতিফা আপার মৃত্যু খবর আগে জানতে পারে নাই। সোমবারের আড্ডায় এসে জানতে পেরে গভীর শোক প্রকাশ করেন।


adda


বাংলাদেশে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মধ্যে লতিফা আপা ছিলেন একজন। নারী আন্দোলনেও তিনি সমান ভূমিকা রেখেছেন। নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা আয়োজিত যে কোন অনুষ্ঠানে যেমন, সেমিনার, কর্মশালা, আলোচনা সভা, মানববন্ধন সব কিছুতেই তিনি বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি একটি পরিণত বয়সেই মৃত্যু বরণ করেছেন কিন্তু এভাবে মৃত্যু মেনে নেয়া কষ্টকর। পহেলা ডিসেম্বর, ২০১৪ সারাদিন তিনি একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছেন, বক্তব্য রেখেছেন। তিনি হাসিখুশি ছিলেন। কিন্তু সেদিন রাত থেকেই তাঁর পেটে ব্যথা শুরু হয়। তাৎক্ষণিক বাড়ির কাছাকাছি নয়া পল্টনের এক হাসপাতালে তাঁকে নেয়া হয়। পরদিন সকালে নেওয়া হয় ঢাকা বাডেম হাসপাতালে। কিন্তু ডাক্তাররা তাঁকে সুস্থ করে তুলতে পারলেন না। ৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ দিবাগত রাত ১টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


latifa


লতিফা আপা’র বাড়িতে কেউ নাই, তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে সবাই দেশের বাইরে থাকে। কারও সাথেই যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। লতিফা আপার মরদেহ ঢাকা বাডেম হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। সেখানে গেলেও কোন লাভ নাই। তাই লতিফা আপাকে দেখা ও পরবর্তী পদক্ষেপ জানার জন্য ওমেন ফর ওমেন অফিসে যেয়ে অনেক খোঁজ খবর করে জানা গেল ৫ ডিসেম্বর, ২০১৪ তাঁকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

মানুষের একটাই জীবন। লতিফা আপাকে বয়স থামাতে পারে নাই। কাজ করতে গেলে বয়স কোন ব্যাপার হতে পারে না এটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। লতিফা আপা ছিলেন নারীবাদী নেত্রী। নারী আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয়। শুধু নারী আন্দোলন নয় পরিবেশ বিপর্যয়ও তাঁকে ব্যথিত করতো। একবার বেশ রাগ হয়ে ফোন করে বলেন, রমনা পার্কে পলাশ ফুলের গাছ কাটা হয়েছে। এখন সরস্বতী পূজায় পলাশ ফুল কোথায় পাবে।

নিজ পরিবার লতিফা আপাকে কতটুকু দিয়েছে তা দেখা দরকার। তাঁর ছেলে মেয়েরা কেউই দেশে থাকতেন না। বৃদ্ধাশ্রমে তবুও কথা বলার সঙ্গী থাকে। লতিফা আপা নিজের ঘরে নিজেই যেন বৃদ্ধাশ্রমে ছিলেন। লতিফা আপা ছিলেন একা। কথা বলারও কেউ তাঁর বাড়িতে ছিল না। দেশের মিডিয়াও লতিফা আপার মৃত্যুর কথা তেমনভাবে তুলে ধরেনি বা প্রচার করেনি। দেশের ছোট-খটো বিষয়েও মিডিয়া যেভাবে প্রচার করে লতিফা আপার ক্ষেত্রে তা দেখা যায় নি। লতিফা আপা তা পাওয়ার যোগ্য ছিল। এভাবেই উপস্থিত সোমবারের আড্ডার সদস্যদের অবিহিত করেন নারী আন্দোলনের নেত্রী ফরিদা আখতার।

লতিফা আপার বাড়ির কাছাকাছি থাকতেন ডেইজি আপা। গত এক বছর ডেইজি আপা নয়া পল্টন থেকে দূরে বাড়ি করেছেন। তাই লতিফা আপার সাথে যোগাযোগটা একটু কম হতো। তিনি বলেন, লতিফা আপার বাড়ির কাছাকাছি থাকতাম কিন্তু তাঁকে চিনতাম না। লতিফা আপাকে জেনেছি, চিনেছি, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তারপর থেকেই একত্রে বেড়ান। ভোরে রমনা পার্কে হাঁটতে যাওয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লতিফা আপার সাথে বেড়াতে গেলে খুব মজা হতো। তাঁর ছাত্ররা অনেক বড় পদে ছিল, কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করছেন তারা ছুটে আসতেন, কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। লতিফা আপা আমার সাথে ভারতে বেড়াতে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি বেড়াতে ভাল বাসতেন। আমি চিন্তা করছিলাম ট্রেনে করে পশ্চিম বঙ্গ যেতে অনেকটা সময় লাগবে। লতিফা আপার পক্ষে তা সম্ভব হবে কি না। লতিফা আপাকে ফেলে লুকিয়েও যেতে পারছিলাম না। চিন্তা করছিলাম, কি করবো। শেষ পর্যন্ত ভারত যাওয়ার বিষয়টি আপার সাথে আর ফয়সালা হলো না।

লতিফা আপা রোকেয়া পদক পাওয়ার পরে আমাকে বলেছিলেন, “রোকেয়া পদকের টাকা নিয়ে আমি কি করবো”। পুরো টাকাটা তিনি আঞ্জুমান মফিদুল এ দিয়েছিলেন। আর আমাকে বলেছিলেন, “কাউকে কথাটা বলবে না”। আজকে এই কথাটা না জানিয়ে পারলাম না। এভাবেই শ্রদ্ধা জানান ডেইজি আপা।

ঢাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের সামনে মায়েরা তাদের বাচ্চাদের ক্লাশে দিয়ে বসে থাকে। লতিফা আপা সব সময় বলতেন এদের নিয়ে একত্রে কোন কাজ করা যায় কি না চিন্তা করো। এরা অনেক সময় নষ্ট করছে। নারীগ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ সকল আয়োজিত অনুষ্ঠানে লতিফা আপা আসতেন। সাথে থাকতেন মেহেরুননেসা ইসলাম। মেহেরুননেসা ইসলাম উন্নয়ন ও নারী শিক্ষার উপর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু মেহেরুননেসা ইসলামের মৃত্যুর পরে লতিফা আপাকে নরীগ্রন্থ প্রবর্তনার অনুষ্ঠানে আনার জন্য গাড়ি পাঠাতে হতো। কখনও গাড়ি না থাকলে সিএজি চালিত বেবী ট্যাক্সিতে আনতে হতো। এতে তিনি মটেও বিরক্ত হতেন না। বিরক্ত হতেন রাস্তার যানজটে। লতিফা আপা লম্বা বক্তব্য রাখতেন। তাঁর বক্তব্য শ্রোতারা পছন্দ করতেন। বলেন নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সমন্বক সাইদা আখতার।

নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় গত মে, ২০১৪ তাবিনাজ (তামাক বিরোধী নারী জোট) আয়োজিত আলোচনা সভায় এসেছিলেন লতিফা আপা। কিন্তু বক্তব্য দিয়েছিলেন ছোট করে। লম্বা বক্তব্য তিনি দেন নি। বলেন জামিলা আইনুন আনন্দ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফেরদৌস আখতার।

পশ্চিম বাংলা থেকে সোমবারের আড্ডায় এসেছিলেন কলকাতা থেকে স্কুল শিক্ষক ও রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী রুমা চক্রবর্তী। লতিফা আপার উপর উপস্থিত সদস্যদের স্মৃতিচারণ শুনে রুমা চক্রবর্তী বলেন, লতিফা আপা এমন একজন মানুষ ছিলেন তাঁর এক হাত কাজ করলে অপর হাত জানতে পারত না। তিনি একজন নিঃস্বার্থ মানুষ ছিলেন। আমার অনেক জানা এবং বোঝার আছে লতিফা আপা সম্পর্কে।

স্মৃতি চারণের পরে উপস্থিত সকল সদস্য লতিফা আপার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করেন।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter