অর্থনৈতিক-সামাজিক অসমতা: নারী অধিকারের অন্তরায়
ফরিদা আখতার || Friday 11 March 2016 ||বরাবরের মতো এবারও আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চ উদযাপিত হয়েছে। আজকাল দেখা যায়, ৮ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয় না, মার্চের শুরু থেকেই নারী দিবসের কর্মসূচি লেগে থাকে, কারণ দিবসটিতে যানজটের মতোই ‘কর্মসূচি-জট’ লেগে যায়। কোনটা ছেড়ে কোনটায় যাই, শেষ পর্যন্ত কোনোটাতেই যাওয়া হয় না। কাজেই এখন আর দিবস নয়, সপ্তাহ পালন করা হয় বলা যেতে পারে। সংবাদ মাধ্যমে নারীদের সম্পর্কে এবং তাদের অবস্থান জানা ও বোঝার চেষ্টা দেখা যায়। লেখালেখি হয়, বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। আমি এ প্রবণতা ইতিবাচক বলে মনে করি। দিনটি আছে বলেই বছরে একবার হলেও যার যার মতো করে বিশ্লেষণ করা হয়— নারী এগোতে পারল কি পারল না।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, কারা দিবসটি পালন করছেন এবং কাদের জন্য আসলে দিবসটির উৎপত্তি হয়েছিল। তাদের কথা কি আমরা জানি? তাদের খোঁজ নেয়া কি আমাদের যথেষ্ট হচ্ছে? তারা কি সক্রিয় আছেন? শুধু শ্রমিক নারী নন, অন্য নারীদের শ্রেণী বিচার করে কি জানার চেষ্টা হয়, আসলে ঘটনাটা কী ঘটছে? উন্নয়নের ভাষায় বললে, গরিব, মধ্যবিত্ত ও ধনী নারীর মধ্যে ফারাক এখন কেমন বা তাদের শ্রেণীগত অবস্থানের পার্থক্য অনুযায়ী নারীর অবস্থানের পরিবর্তনের বিষয়টি কেমন, তা দেখা হচ্ছে না।
এবারের মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা নারী দিবস সামনে রেখে মেনে নেয়া যায় না। এক নারী, যার নাম মাহফুজা— দুই সন্তানের ঘাতক বলে প্রচার মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মুখপাত্র বলছেন, তিনি নিজের মুখে স্বীকার করেছেন, তার ওড়না পেঁচিয়ে দুই সন্তানকে মেরেছেন। এ নিয়ে একদিকে ছি ছি করতে যেমন দেখছি, তেমনি একটি বড় গোষ্ঠী আছে, যারা বলছেন— এটি হতে পারে না। তারা যুক্তি দিচ্ছেন, কোনো মা এমন কাজ করতে পারেন না। তবে অপরাধ যারা করে, তারা কী করতে পারে বা পারে না, তা অপরাধ তদন্তেরই বিষয়। কিন্তু এখানে যেন একটু তড়িঘড়ি করেই প্রমাণের চেষ্টা আছে যে, ‘মা তার সন্তানকে হত্যা করেছেন!’ এর পেছনে কারণ কী, তারও উঁকিঝুঁকি আছে। ঠিক তেমনি প্রশ্ন তোলা যায়, ঐশী তার মা-বাবাকে যেভাবে হত্যা করেছে বলা হচ্ছে, তেমন করে ঐশীর বয়সী একটি মেয়ে করতে পারে কিনা! ঐশীর সাজার রায়ও হয়ে গেছে, কিন্তু এসব প্রশ্নের সুরাহা হয়নি; খুব সহজে হবে না। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, নারীকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। এত দিন নারীকে অসহায় ও নির্যাতিত-রূপেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, এখন তাকে ঘাতকরূপে, জঙ্গিরূপে এবং এমন অনেক রূপে দেখা যাচ্ছে, যা নারী করতে পারে তা আগে কখনো ভাবা হয়নি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আন্তর্জাতিক নারী দিবস সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে নারী শ্রমিকের দাবি পূরণের জন্যই আবির্ভূত হয়েছে। গত শতাব্দীর প্রথম কয়েক বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে শ্রমিক নারীদের দাবি প্রতিষ্ঠার লড়াই, এ দিবস ঘোষণার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রাশিয়ার কথা সবাই জানলেও অন্যান্য দেশের সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর নেতৃত্বে যেমন— যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক কারখানার নারী শ্রমিক, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া— সবখানে আন্দোলন হয়েছে। এবং সেই যুগে ইন্টারনেট না থাকলেও তাদের যোগাযোগ যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯১৮ সালে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত ১৭টি দেশের ১০০ জন সমাজতান্ত্রিক নারীর সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের ডাক দেন। দাবি ছিল— শ্রমিকের অধিকার এবং নারীদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা।
এখন নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হয় সমতা অর্জনের এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার। আমরা যখন ‘নারী’ বলি, সেই নারী কে, তা পরিষ্কার করে উচ্চারণ করি না। শ্রেণীগতভাবে নারীদের মধ্যে অনেক বিভেদ আছে। নারীর ক্ষমতায়ন বললে সব নারীর ক্ষমতায়ন একইভাবে হয় না। আন্তর্জাতিকভাবে নারী অধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নারীর শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আগে হয়েছে, নাকি নারীর ব্যক্তি অধিকারের আলোকে হয়েছে, এটি খতিয়ে দেখার বিষয়। নারী আন্দোলনের ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবে। তবে ‘নারীবাদী’ হওয়ার সঙ্গে শ্রমিক নারীর অধিকার সবসময় গুরুত্ব পায়নি। শ্রমিক নারীর পক্ষে বলার অর্থ সবসময় নারীবাদিতার চরিত্রের মধ্যে পড়েনি। তার একটি কারণ হচ্ছে, নারীবাদী আন্দোলন বা ফেমিনিজম নিয়ে যারা কাজ করেছেন, তারা নিজেরা শ্রেণীগতভাবে শ্রমিকের পর্যায়ে পড়েন না। তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিংবা বর্ণের দিক থেকেও শ্রমিক নারী থেকে ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রে এই পার্থক্য বোঝা গেছে সাদা ও মধ্যবিত্ত নারী বনাম কালো ও শ্রমজীবী নারীদের দাবিদাওয়া এবং সংগ্রামের ধরনে পার্থক্য দেখে। তবে নিঃসন্দেহে ফেমিনিজমের অবদান আছে নারীর ব্যক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, যার সুফল নারী শ্রমিকও হয়তো নিতে পারেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত মহিলাদের নারীবাদ কতোটা ফেমিনিজম আর কতোটা স্রেফ বুর্জোয়া ব্যাক্তিতান্ত্রিকতা তা নিয়ে তর্ক আছে। এমনকি ব্যাক্ত অধিকারের ক্ষেত্রেও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীবাদ শ্রেণী চরিত্রের কারণে সংকীর্ণ। যেমন নিজের শ্রমশক্তি বিক্রি করবার জন্য দরদাম করবার অধিকার একটি বুর্জোয়া অধিকার। কিন্তু পোশাক তৈরি কারখানার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করবার অধিকার যখন রীতিমতো আইন করে হরণ করা হয় তখন তা নিয়ে নারীবাদের বিশেষ মাথাব্যথা নাই। নারী শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি এখনো মূল স্রোতের নারী আন্দোলনের অংশ নয়। কারখানায় যে নারী কাজ করে সেও নারী বটে, কিন্তু নারীবাদ নারীর বিশেষ বায়োলজিকাল চিহ্ন নিয়ে যতোটা চিন্তিত নারীর শরীর নিয়ে ততোটা চিন্তিত নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দুঃখজনকভাবে এটাই সত্যি।
বাংলাদেশে নারীমুক্তির চিন্তা-চেতনায় বেগম রোকেয়াও নারীকে পুরোপুরি শ্রমিক হিসেবে দেখেননি; তিনি দেখেছেন তার সার্বিক বঞ্চনা ও স্ত্রী-জাতির অবনতির অবস্থা এবং সেখান থেকে মুক্তির জন্য নারীকে প্রস্তুত করবার কর্তব্যের দিক থেকে নারীকে দেখেছেন। নারীমুক্তির জন্য নারীকে কেরানি হোক বা জজ-ব্যারিস্টার, কিছু একটা হওয়ার স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন। বর্তমানে নারীরা সেই কাজটি করছেন সফলভাবেই। সার্বিকভাবে নারীকে কর্মক্ষেত্রে আনার বিষয়টি রোকেয়া কখনই ভুলে যাননি। সেদিক থেকে বলব, পশ্চিমা নারীবাদের তুলনায় বেগম রোকেয়ার চিন্তা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রসর ছিল। অবশ্য বেগম রোকেয়ার সময়কালেই বিভিন্ন দেশে ‘সূচ কারখানা’ বা পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন। বাংলাদেশে সেই পরিবেশ ছিল না, কিন্তু নারীদের অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণে বৈষম্য ও স্বীকৃতি না পাওয়া, নারীর ঠিকানাহীন হয়ে যাওয়া— এসবই পদ্মরাগের মতো রচনায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি শ্রেণীর কথা আলাদাভাবে বলেননি ঠিকই, কিন্তু সব শ্রেণীর নারীর দুঃখ-কষ্ট তার ভাবনায় ছিল। জানি না ক্লারা জেটকিনের চিন্তা বা কাজের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার জানাজানির কোনো সুযোগ ছিল কিনা। না থাকলেও বেগম রোকেয়া সে চিন্তা থেকে দূরে ছিলেন না মোটেও। সরাসরি নারীর কর্মঘণ্টা বা মজুরি নিয়ে কথা না বললেও নারীর শ্রমিক হওয়ার বিষয়টি তার চিন্তায় ছিল না বলা যাবে না। বেগম রোকেয়া জীবিত থাকাকালে ১৯১০ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষিত হয়েছিল শ্রমিক নারী আন্দোলনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস জাতিসংঘের ঘোষণায় আসার পর থেকে দিবসটি নিয়ে সরকার ও নারী উন্নয়নে নিয়োজিত এনজিওগুলোর মধ্যে আগ্রহ বেশি বেড়েছে। টাকাও আসছে ভূরি ভূরি। এটা সমাজতান্ত্রিক দাবিদাওয়া বা সমতার পর্যায়ে আর থাকেনি। প্রতি বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে একটি প্রতিপাদ্য ঠিক করে দেয়া হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও নারী সংগঠনগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিষয় নির্ধারণ করে। লক্ষ করে দেখলাম, ১৯৯৬ সাল থেকে যেসব প্রতিপাদ্য জাতিসংঘ ঠিক করে দিয়েছে, তার মধ্যে একটিতেও শ্রমিকের অধিকারের কথা বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যেমন— নারী ও শান্তি (১৯৯৭), নারী ও মানবাধিকার (১৯৯৯), সংঘাত নিরসনে নারী (২০০১), আফগান নারীর বাস্তবতা ও সম্ভাবনা (২০০২), নারীর সমতা ও এমডিজি (২০০৩), নারী ও এইডস (২০০৪), নারী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ (২০০৬), গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিরসন (২০১২) ইত্যাদি। এ বছরের প্রতিপাদ্য তারা যেভাবে দিয়েছে তা হচ্ছে— ‘Planet 50-50 by 2030: Step It Up for Gender Equality.’ অর্থাতি ২০৩০ সালের মধ্যে নারী-পুরুষের সমতা অর্জন করার জন্য এগিয়ে যেতে হবে।
দেখাই যাচ্ছে, নারী শ্রমিকের দাবি হারিয়ে গেছে, এমনকি নারীও হারিয়ে ‘জেন্ডার’ হয়ে যাচ্ছেন। জেন্ডারের ভালো বাংলা আজো হয়নি, যা হয়েছে তা সাধারণ মানুষের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য বা বোধগম্য নয়। কাজেই নারী জেন্ডার হয়ে গেলে আমরা খুশি হই না; আমরা দেখতে চাই, নারী আন্দোলন সমাজের সব স্তরের নারীদের মধ্যে বৈষম্য দূর করে শক্তিশালী হয়ে এগিয়ে যাবেন।
নারীদের শ্রেণী প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসতে হলে আন্তর্জাতিক নারী দিবস খুব ভালো একটি উপলক্ষ। বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক নারী আন্দোলন আছে, কিন্তু মূলধারার আন্দোলনে তারা আলাদাভাবে তাদের মতাদর্শিক অবস্থান পরিষ্কার করার সুযোগ পাচ্ছেন না। আমাদের সমাজ ক্রমাগত পুঁজিতন্ত্রের দিকে ছুটছে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ নারীকে যতটুকু প্রয়োজন, শুধু ততটুকুই ব্যবহার করছে; বিশেষ করে সস্তা শ্রম হিসেবে তাদের কদর খুব বেশি। অথচ শ্রমজীবী নারীরা যখন নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার বিরোধিতা করেন, তাদের কথার কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না। পুঁজিতন্ত্রের ধর্মই হচ্ছে, শ্রম শোষণ করা এবং সেটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশে নারীদের সমমজুরি নিশ্চিত করতে পারেনি; বরং নারীশ্রম শোষণ তাদের অর্থনীতির চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে।
পুঁজিতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় নারীদের সুযোগ সৃষ্টি হয়, কিন্তু তা এখনো খুব সীমিত। পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলোয় কয়েকজন ক্ষমতাবান নারী, যেমন— জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ক্রিস্টিন লাগার্দের মতো গুটিকয়েক পুঁজির নিয়ন্ত্রক নারী দেখলেও এখনো বিশ্বের ৫০০টি বড় কোম্পানির সিইওর মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ নারী। করপোরেট বোর্ডেও নারীর সংখ্যা খুব কম, নেই বললেই চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন জয়ী হলে আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বে হইচই হবে, কিন্তু বিশ্বের নারীদের ভাগ্যের কি কোনো পরিবর্তন হবে? হিলারি নারী বলেই কি আমেরিকার সব নারী তার জন্য ভোট দিতে যাবেন?
নারী আন্দোলন করতে গিয়ে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের অবস্থান ঠিক করি না যে আমরা কি পুঁজিতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় মুড়ি-মুড়কির ভাগ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকব; নাকি যে শোষণ ও নির্যাতন্মূলক সম্পর্ক বিশ্বব্যাপয় তীব্য হচ্ছে তার প্রবর্তন ও রূপান্তরের জন্য কাজ করব? সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীর শোষণ ও নির্যাতন চেয়ে চেয়ে দেখা আমাদের কাজ হতে পারে না। এখনো অনেকের ধারণায় বিষয়টি পরিষ্কারভাবে নেই যে, পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক শোষণ যখন এক বা একীভূত হয় তখন তা নারীর জন্য অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও নির্মম হয়ে ওঠে।। পুরুষতন্ত্রকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক হিসাবে বোঝা যায় না, তার নির্দিষ্ট চরিত্র রয়েছে যা বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহণ করে। সমাজ বিপ্লবের ধারণার উদ্দেশ্যের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের রূপান্তরই প্রধান প্রতিপাদ্য হিসাবে এখনও বহাল। এর ফলে পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্কের রূপান্তর বা বিনাশের প্রশ্ন আজও প্রধান হয়ে উঠতে পারে নি। এর সমাধান নারীকেই দিতে হবে।
বর্তমান নারীবাদের ধ্যান-ধারণার মধ্যে ক্ষমতায়নের কথা বেশি আসে। নারীকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই যে সমাধান হয় না, তা বাংলাদেশসহ অনেক দেশের উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাবে। যারা মনে করেন, নারীকে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে দিলে তিনি নারীর পক্ষে পুরুষের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল হবেন, তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। এই ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার নীতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার কারণে তারাও অজান্তে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার খপ্পরে পড়ে যান এবং অন্য সব নারীকে পেছনে রেখে নিজে এগিয়ে যান। আজকাল নারীবাদীরাও এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছেন। যেমন— চার্লট বানচ ও সুসান ফালুদি এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। সুসান বলেছেন, ‘You can’t change the world for women by simply inserting female faces at the top of an unchanged system of social and economic power.’ অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার মধ্যে কোনো পরিবর্তন না এনে উচ্চপর্যায়ে বসিয়ে দিলেই নারীদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন আসবে না। সমাজের অংশ হিসেবে নারীদের মধ্যেও শ্রেণীবিভাজন আছে। তাই উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীরা যখন (তাদের ভাষায়) গরিব, অশিক্ষিত, অসুস্থ, সাংস্কৃতিকভাবে অনগ্রসর নারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তখন তাদের ভাষায় অসম শ্রেণীগত অবস্থান ফুটে ওঠে। কাজেই যে নারীবাদ পুঁজিতান্ত্রিক শোষণ কায়েম রেখে নারীর ক্ষমতায়ন চায়, তারা মূলত নারীদের দ্বারা নারী শোষণের পথ তৈরি করছেন। আবার যারা শ্রমবাজারে আছেন এবং শুধু মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে নিয়োজিত, তাদের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে দেরি হবে। কারণ তারাও অজান্তে পুঁজিতন্ত্রকে মেনে নিয়েছেন। তাদের আন্দোলন ট্রেড ইউনিয়নের বেশি কিছু নয়। পুঁজির সুবিধার জন্য নারীকে সামনে নিয়ে আসার যে নীতি, তা নারীর পক্ষের নয়। এ সত্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।
এখনকার পুঁজিতন্ত্রের রূপ বিশেষভাবে আসছে করপোরেট পুঁজি হিসেবে। তারা আমাদের কৃষিতে ঢুকে পড়ছে, পরিবেশ নষ্ট করে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনসহ মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করছে। বলা হচ্ছে, এরই মধ্য দিয়ে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হব। তাতে নারীর কী সুবিধা? নারী কি তার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন, নাকি দাবি করার জায়গাটুকুও হারিয়ে ফেলবেন? অসম সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা রেখে দিয়ে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা কখনই সম্ভব নয়, এ সত্যটুকু মেনে নিয়ে আমাদের কাজের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক
উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)