বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস
উবিনীগ || Saturday 01 March 2014 ||২২ মে, ২০১১ ঢাকা: বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবসে নায়াকৃষি আন্দোলন, উবিনীগ ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার উদ্যোগে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার সবার পক্ষ থেকে সেই বিশেষ দিনের তাৎপর্য ব্যখ্যা করে বক্তব্য পেশ করেন। ড, এম এ সোবহান ও গোলাম রাব্বি বাদল সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সীমা দাস সীমু, সাইদা আখতার ও জাহাংগির আলম জনি।
প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস নিয়ে এতদিন অনেক সাবধান বাণী আমরা শুনেছি কিন্তু আমাদের দেশের সরকার এবং আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য যারা সহযোগিতা করেন তাঁরা কেউ বিষয়টি আমলে আনেন নি, তাই বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস ২০১০ পালন করতে গিয়ে এতদিন কত ক্ষতি হয়েছে তার হিশাব নিয়ে বসতে হচ্ছে।
আমরা জানি, ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে অনেকেই গেছেন এবং জানেন যে সেখানে প্রাণবৈচিত্র্য সনদ বা Conventional on Biological Diversity (CBD) গৃহিত হয়েছে। কিন্তু তার আগে এর প্র্রস্তুতির কাজ হয়েছে মে মাসে নাইরোবীতে; নাইরোবী ফাইনাল এ্যাক্ট অব দা কনফারেন্স ২২ মে, ১৯৯২ তারিখে এই সনদের বক্তব্য অনুমোদন করে। সেই দিনকেই বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস হিশেবে পালন করা হয়। আর বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয় ৫ জ়ুন, যেদিন রিও ডি জেনেরিওতে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে প্রাণবৈচিত্র্য সনদ স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু যতই পরিবেশ সচেতনতা বেড়েছে মনে করা হোক না কেন, প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস কিন্তু বন্ধ হয় নাই। এবং ২২ মে তারিখটিও কারো মনে নেই। প্রাণবৈচিত্র্য সনদ নিয়ে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর সভা প্রতি বছর (Conference of the Parties, COP) অনুষ্ঠিত হয়; ২০০২ সালের সভায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যে ২০১০ সালের মধ্যে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ শনাক্ত করে দারিদ্র বিমোচন ও সকল মানুষের কল্যানের জন্য কর্মসুচী নেয়া।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসুচী এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ঠিক করেছে, Biodiversity for Development and Poverty Alleviation, অর্থাৎ উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনের জন্য প্রাণবৈচিত্র্য। এর সাথে মিলেনিইয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল ৭ এর সম্পর্ক রয়েছে, কারণ সেখানে বলা হয়েছে পরিবেশের স্থায়িত্ব রক্ষা করতে হবে। এ বছর প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা, উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্য সব এক জায়গায় এসে মিলেছে।
প্রাণবৈচিত্রের সঙ্গে সম্পদ সৃষ্টি ও দারিদ্র থেকে মুক্তির সম্পর্ক সরাসরি। নয়াকৃষি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার যে প্রাণবৈচিত্র ভিত্তিক কৃষি পদ্ধতি খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জনের পথ।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে অনেক দেরিতেই এই বিষয়টির প্রতি নজর দেয়া হচ্ছে যখন প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসুচী (UNEP) ও প্রাণবৈচিত্র্য সনদ এর পক্ষ থেকে এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন "Biodiversity, Development and Poverty Alleviation: Recognising the Role of Biodiversity for Human Well-being" এ প্রকাশিত তথ্য দেখলে বোঝা যায় কত ক্ষতি হয়ে গেছে এবং এখনো কিছু রক্ষা হতে পারে যদি সময় মতো কাজ করা যায়। প্রাণবৈচিত্র্যকে কখনই অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখা হয় না, কারণ এর সাথে বাজারের সম্পর্ক পরিস্কার নয়, অথচ মানুষের জীবন জীবিকা, উৎপাদন সব কিছুই কোন না কোন ভাবে প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে জড়িত। গত ৫০ বছরে ৬০% প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, এবং গত ১০ বছরে শুধু জমিতেই প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ক্ষতি হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বা ৫০ হাজার কোটি ডলার। বিশ্ব ব্যাপী ৭০% গ্রামের মানুষ সরাসরি প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে জীবন জীবিকা চালায়, শহরের মানুষও কোন না কোনভাবে প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে। গত শতকে বিশ্বের ৩৫% প্যারাবন, ৪০% বন এবং ৫০% জলাশয় হারিয়ে গেছে। এই কথাও প্রমণিত হয়েছে যে মানুষের কর্মকান্ডের জন্য প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস প্রাকৃতিক কারণের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি হয়। পৃথিবীর ১১০ কোটি গরিব মানুষ তাদের ৯০% চাহিদা যেমন খাদ্য, জ্বালানী, ওষুধ, বাড়ী-ঘর এবং যানবাহনের ব্যবস্থা তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকেই মেটায়।
অর্থনৈতিকভাবেও প্রাণবৈচিত্র্য অনেক গুরুত্বপুর্ণ। ওষুধ কোম্পানী বছরে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে, তার শতকরা ২০ থেকে ৫০ ভাগ কাঁচামাল আসে গাছ-গাছালি থেকে। ওষুধ কোম্পানীর তৈরি করা ওষুধের ৫০% প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করে। বন থেকে ওষুধের গাছ অসংখ্য মানুষ সংগ্রহ করে চিকিৎসা করে যার মূল্য হচ্ছে ১ বিলিয়ন ডলার (বা ১ হাজার কোটি ডলার)। জনগণের ছয় ভাগের এক ভাগ জীবন জীবিকার জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলের ওপর নির্ভর করে। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ গাছ-গাছালির ওষুধের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এই সব গাছ-গাছালি হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাণবৈচিত্র্য খাদ্য ঘাটতি মেটাবার জন্য খুব জরুরী। ফসলে পোকা দমন করতে হলেও শুধু কীটনাশক ব্যবহার না করে ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে।
বিশ্বে তিন শত কোটি মানুষ সমুদ্র ও উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে। এক শত কোটি মানুষ সরাসরি মাছ ধরার কাজে জড়িত, অর্থাৎ এটাই তাদের জীবন-জীবিকা, বেঁচে থাকার উপায়। সামুদ্রিক মাছ থেকে ১৬% প্রোটিন সরবরাহ হয়। মাছ সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তেমনি নদী ও জলাশয় থেকে পাওয়া মিঠা পানির মাছের অর্থনৈতিক মূল্য বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার।
আমরা দেখেছি প্রাণবৈচিত্র্য যেমন ধ্বংস হচ্ছে তেমনি মানুষের জীবন জীবিকা ও হুমকির মুখে পড়েছে। উন্নয়নের কথা বলে প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট করা হয়েছে। খাদ্য যোগানের কথা বলে ফসলের বৈচিত্র্য নষ্ট, শুধু ধানের মত একক ফসল উৎপাদন করে অন্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। উন্নয়নের যারা দাতা তারাই এই ক্ষতি করার জন্য দায়ি। আন্তর্জাতিক দাতাদের পক্ষ থেকে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার কাজে সাড়া খুব কম। এখনও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য নির্দিষ্টভাবে অর্থ বরাদ্দ মোট বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ৩%। শুধু তাই নয়, দাতা সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গাছ-পালা, বিশেষ করে আগ্রাসী জাতের গাছ লাগিয়ে প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি করা হয়েছে। কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ বিশেষ করে হাইব্রিড ও জিএমও প্রযুক্তির কারণে ফসলের বৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে ধনী দেশেরই কোম্পানীর মাধ্যমে। ১৯৯২ সালের পর এমন কাজ মেনে নেয়া যায় না।
বাংলাদেশে কৃষি জমি রক্ষার কোন নীতি নাই। বছরে ১% জমি কমে অন্য খাতে চলে যাচ্ছে। খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ করে যেমন খাদ্য ঘাটতি হচ্ছে তেমনি প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। চিংড়ী চাষ মাটিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দিয়েছে, এখন সেখানে জিএম ধান করার জন্য কোম্পানীগুলো সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে।এর ফলে প্রাণবৈচিত্রের ক্ষতি হবে জেনেও সরকার সেই দিকে ঝুঁকছে। কোম্পানী বলেছে বেশি ফলন হবে এবং সরকার তাই করছে। বর্তমানে বিটি বেগুন তেমনি এক হুমকীর সৃস্টি করেছে। পনেরো কোটি মানুষকে খাওয়াবার দোহাই দিয়ে প্রযুক্তির বিনা বিচার ব্যবহার আমাদের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে খুব সফল হতে পারে নি। অথচ, বাংলাদেশের কৃষক এখনো প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করে কৃষি উৎপাদন করছে এবং তাদের কারণেই এখনও কয়েক হাজার জাতের ধান ও অন্য ফসলের বৈচিত্র্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় জাতিসংঘ সনদের অংশীদার হিশেবে অন্যান্য দেশের মত ২০১০ প্রাণবৈচিত্র্য লক্ষ্য মাত্রা (Biodiversity Targets 2010) সমীক্ষাপূর্বক সিবিডি বাস্তবায়নের উপর চতুর্থ প্রতিবেদন দাখিল করার কাজ করেছে। এই প্রতিবেদনে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের সীমিত কিছু কারণ দেখানো হয়েছে। কিন্তু মুল কারণ গুলো খুব বলা হয় নাই। কিন্তু কোন বিশেষ প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়েছে বা হুমকীর মুখে পড়েছে তা বোঝার উপায় নাই। বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্যের বর্তমান অবস্থা (status) সম্পর্কে কোন তথ্য নেই। অর্থাৎ প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে কোন ইনভেনটরি নেই, যা দেখে বোঝা যাবে আগে কি ছিল, আর এখন কি আবস্থা। অথচ গ্রামের মানুষ এবং কৃষকরা ঠিকই এসব হিসাব রাখছেন। প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় নারীদের বিপুল অবদান থাকা সত্তেও কোন উল্লেখ নেই।
তবুও যা বলা হয়েছে তাতে জানা যায় যে উজানের পানির সরবরাহ কমে যাওয়া প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের একটি অন্যতম কারণ। তাছাড়া জমির ব্যবহারের পরিবর্তন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের নামে নানা ধরণের অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তাঘাট নির্মাণ পানির গতিতে পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে মাছসহ অনেক জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে। আগ্রাসী গাছ (যেমন ইউকেলিপটাস, একাসিয়া), আগ্রাসী ফল, পশু ও মাছের চাষ স্থানীয় জাতের ক্ষতি করেছে। কৃষিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্যবহার ও তার সাথে সার, বিষসহ নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার কৃষকের নিজ হাতে রাখা বীজ ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করছে। আগে যেখানে ১০,০০০ জাতের ধান ছিল এখন মাত্র ২২টি উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষ হচ্ছে। তবে নয়াকৃষি আন্দোলনের হিশাব অনুযায়ী আমাদের ১৫,০০০ জাতের ধান ছিল। এখন সরকারের ধান গবেষণা কেন্দ্রে সংগ্রহ আছে ৫৯৭৮ জাত। নয়াকৃষির কৃষকদের হাতে সংগ্রহ আছে ২২০৮ জাত।
চলনবিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চল। সরকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এই চলনবিল শীতকালে শুকিয়ে যায় বলে অনেক জলচর পাখী এখন আর পাওয়া যায় না। এ বছর চলনবিলে তামাক চাষ করার কারণে বর্ষাকালে মাছ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হবে কারণ ব্যাপক পরিমাণ কীটনাশকের ব্যবহার মাছ মেরে ফেলবে। তাই এখনি সতর্ক হওয়া দরকার। উন্নয়নের নামে, খাদ্য উত্পাদনের নামে এ দেশে অনেক ভুল পদক্ষেপ আগে নেয়া হয়েছে যা আজ প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের কারন হিসেবেও চিহ্নিত হচ্ছে।
সম্মেলনে জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনায় রেখে দাবী হচ্ছে
- প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করা শুধু মুখের কথা নয়, সরকারকে আন্তিরকতার পরিচয় দিতে হবে।
- কৃষিতে এমন কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে না, যা কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট করে।
- উন্নয়ন পরিকল্পনায় মানুষের জীবন জীবিকার ক্ষতি হয় এমন পরিকল্পনা করা যাবে না।
- দেশীয় বীজ রক্ষা এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করা নারী উন্নয়ন নীতি ও কর্মকান্ডের অংশ হতে হবে।
- প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতির জন্য দায়ি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্বে শাস্তি ও বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।