দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের সংকট চলছে
আব্দুল জব্বার || Thursday 16 April 2015 ||বাংলাদেশ নদ-নদী হাওর, বাওড়, খাল-বিল নালা, ডোবার দেশ। এক কথায় প্রচুর মিঠা পানির দেশ। আর প্রচুর মিঠা পানির কারণে এদেশ মিঠা পানির প্রাচুর্যেরও দেশ। বাংলাদেশে এখনো যত প্রজাতির মিঠা পানির মাছ রয়েছে সারা ইউরোপ মহাদেশে তা নেই। মিঠা পানির এই অতিমূল্যবান সম্পদ দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেন কি কারণে মিঠা পানির মাছ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি, কিন্তু আমলে আনি না।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলাতে চির পরিচিত নানান জাত ও প্রজাতির ছোট মাছের আকাল চলছে। যেমন খাল বিল হাওর, নদ নদীসহ মুক্ত জলাশয় গুলো মাছ শূন্য হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু তথা আবহাওয়া পরিবর্তন এবং তথাকথিত অপরিনামদর্শী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে ধীরে ধীরে খাল বিলের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এটি মাছ না থাকার একটি অন্যতম কারণ। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলাতে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে খয়ারা, লালচান্দা, পাবদা, সরপুটি, তিতাপুটি, ডানকুনা ও মায়া সহ বিভিন্ন জাত ও প্রজাতির ছোট মাছ বিলুপ্ত। এ ছাড়াও অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে চেলাপুটি, টেংরা, ফলই, ভেদা, শিং, মাগুর, কৈ, বেলে, শৈল, গজার, বোয়াল, চিতল, লালখলিশা, বাইমসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ।
গ্রামাঞ্চলের ছোট হাট বাজারে এসব প্রজাতির ছোট মাছ এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। চেনা মাছ হয়ে পড়েছে খুবই অচেনা, অপরিচিত, বাজার গুলোতে প্রাকৃতিক মাছের আমদানী একেবারে কমে গেছে। মফস্বলের প্রধান প্রধান বাজার গুলোতে যদিও কিছু ছোট মাছ আমদানী হয়, তা আবার চলে য়ায় ভাগব্যান তথা অর্থবিত্ত ওয়ালাদের নিকটে। সাধারন মানুষের কপালে এসব মাছ আর জুটছে না।
দেশীয় ছোট প্রজাতির প্রায় সব মাছের বংশবৃদ্ধির হার আশংকাজনক ভাবে কমে যাচ্ছে। এসব স্থান দখল করে নিচ্ছে বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। উদাধারন: গ্রাসকার্প, মিরর কার্প, সিলভার কার্প তেলাপিয়া,ইত্যাদি। মাছের ভরা মৌসুমে বিভিন্ন জেলা গুলোতে দেশীয় মাছের ব্যাপক সংকট বিরাজ করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিন গুলোতে নদ নদী, খাল বিল সহ মুক্ত জলাশয়গুলো প্রাকৃতিক মাছ শূন্য হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিবে।
পুষ্টির উৎস হিসাবে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের দেহ গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উপাদান ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং আয়রন ছোট মাছ থেকে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতে দেশের মানুষের শরীরে প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৮০ ভাগ আসে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ থেকে। মাছ সম্পর্কে বিজ্ঞানের দেয়া তথ্য উপাত্ত দেখলে পাওয়া যায়। বাঙালীর অতীত এবং ঐতিহ্যের সাথে ছোট মাছ একসূত্রে গাঁথা।
একসময় মাছই ছিল বাঙালীর প্রাধান খাদ্য। এ খাদ্য সংস্কৃতিকে ঘিরেই রচিত হয় বিখ্যাত প্রবাদ ‘মাছে ভাতে বাঙালী’। দু’দশক আগের দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের কোন ঘাটতি ছিল না। নদ নদী, হাওর- বাওড় খাল বিল খানা খন্দ ও প্লাবন ভূমিতে দেশীয় মাছের এতই আধিক্য ছিল যে, মাছের জন্য পানিতে নামা যেত না। গ্রামের মানুষ বেড়া জাল, ধর্মজাল, পাতা জাল, ঠেলা জাল, ইত্যাদি দিয়ে মাছ ধরত। মানুষ মাছ খেতে খেতে বিমুখ হয়ে যেত। ভাদ্র থেকে মাঘ মাস প্রর্যন্ত মাছ শুটকি করে সংরক্ষণ করা হতো। মাংসাশী প্রাণীর মধ্যে মেছো বাঘ, শিয়াল, বেজি, ভোদর, সাপ, কচ্ছপ, গুইসাপ ইত্যাদি প্রাণী নিয়মিত এসব খেত। পাখিদের মধ্যে পানকৌড়ি, মাছরাঙা, গাংচিল, বক, চিল ইত্যাদি হাওর- বাওড় থেকে মাছ খেত। ছোট মাছের বিলুপ্তির অর্থ হচ্ছে এই সকল মাংসাশী প্রাণীরও বিলুপ্তি।
প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে খাদ্য চক্রের সম্পর্ক খুব নিবিড়। একই ভাবে যুক্ত রয়েছে জীবিকা আর জ্ঞানচর্চা। যতো বড় পাণ্ডিত্য থাকুক মাছ সম্পর্কে জেলেরা তাদের পেশা ও অভিজ্ঞতার কারণে যা জানে তা অন্য কোন জ্ঞানচর্চায় পুষিয়ে তোলা অসম্ভব। মাছের আচার, বাসাভ্যাস কিম্বা জলাভূমিতে তাদের বেড়ে ওঠার তথ্য এখন রূপকথার গল্পের মত শোনায়। নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিল, ঝিলের গভীরতা কমে যাওয়া, নদী-খাল দখল করে ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থল ডোবা নালা মুক্ত জলাশয় পুরোপুরি পানি সেচে মাছ ধরা, কৃষিতে কীটনাশকেরো ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, বিদেশী আগ্রাসী বা রাক্ষুসে মাছের চাষ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি কারণে মাছের দেশীয় জাত ও প্রজাতির বিলুপ্তির কারন।