মোরগ- মুরগীও পরিবারের সদস্য
ড. এম. এ. সোবহান || Wednesday 11 May 2016 ||স্মরণনাতীত কাল থেকে গ্রাম বাংলায় ঘরের পিছনে মোরগ- মুরগী লালন পালন চলে আসছে। এখনও প্রায় ৭০% পরিবার মোরগ- মুরগী লালন পালনের সাথে যুক্ত। বর্তমানে এ দেশে মোরগ- মুরগী লালন পালন দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন, ক্ষুদ্র পরিসরে বাড়ীর আঙ্গনায় খোলা যায়গায় চড়ে বেড়ানো মোরগ-মুরগী এবং ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পোলট্রি খামারে লালন পালন করা মোরগ-মুরগী। সনাতন পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র পরিবারে সীমিত সংখ্যক মোরগ -মুরগী লালন পালন করা প্রায় প্রতিটি পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ সব মোরগ -মুরগীর জন্য তেমন কোন তৈরি খাবারেরও প্রয়োজন হয় না। তবে এ সব মোরগ- মুরগী লালন করে পরিবারের ডিম ও মাংসের চাহিদা পূরণ করে বাজারে বিক্রি করে কিছু বাড়তি আয়েরও সুযোগ হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের মহিলারাই এ সব মোরগ- মুরগী লালন পালনের সাথে যুক্ত থাকেন। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে লালন পালন করা মোরগ- মুরগীর জন্য আলাদা ঘরের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে উন্নত জাত ও খাবারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। পারিবারিক ও ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পরিচালিত মোরগ- মুরগীর মাধ্যমে দেশজ ডিমের চাহিদা ৫০:৫০ এবং মাংসের চাহিদা ৪০:৬০ পূরণ হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট মোরগ-মুরগীর সংখ্যা ২৬১.৭৭০ মিলিয়ন (ডিএই ২০১৪-১৫)। এ দেশের মানুষের আমিষের সিংহভাব চাহিদা পূরণ হয় মোরগ-মুরগীর মাধ্যমে। সীমিত পরিমাণ জমির উপর গড়ে উঠেছে মোরগ- মুরগীর খামার। উৎপাদিত ডিম ও মাংস বেশীরভাগই স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে। মোরগ -মুরগীর রোগ বালাই প্রতিরোধের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পরিচালিত পোলট্রি ফার্মগুলিতে পৃথক ভাবে ডিমের জন্য (লেয়ার) এবং মাংসের জন্য (ব্রয়লার) আলাদা জাত লালন পালন করা হয়। তবে এসব মোরগ- মুরগী মারাত্বক রোগ বালাই এর ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ সব মোরগ-মুরগীকে ব্যাপক ভাবে হরমোন, এনজায়েম এবং এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয। সবসময় এ সেক্টরে একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। যেমন ২০০৭ সালে বাংলাদেশে ১,১৫,০০০ মোরগ- মুরগীর খামার ছিল। বার্ডফ্লু রোগের মারাত্বক আক্রমনের ফলে বহু মোরগ- মুরগী মারা যায়। অনেক খামারী সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে যায়। এক ধাক্কায় খামারের সংখ্যা ২০১৩ সালে ৫৫,০০০ নেমে আসে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মতে বাংলাদেশের মানুষের বাৎসরিক মাথা পিছু মাংসের ব্যবহার ১৫.২৩ কেজি। যদিও চাহিদা রয়েছে মাথা পিছু ৪৩.৮ কেজি অর্থাৎ ঘাটতি রয়েছে ৬৫.২৩। গড়ে বাংলাদেশের মানুষ বৎসরে ৩.৬৩ কেজি মোরগ- মুরগীর মাংস সেবন করে। তবে এ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে হবে মাথা পিছু ১২ কেজি। বর্তমানে মাথা পিছু ডিমের চাহিদা বছরে ৪১ টি। যা বেড়ে ২০২১ সালে হবে মাথা পিছু ১০৪ টি। অর্থাৎ ঘাটতি হবে ৬০.৫৮%।
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে উৎপাদন বাড়নোর জন্য মোরগ- মুরগীকে নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ খাবার দেয়া হয়। যার প্রতিক্রিয়া মানব দেহ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। আমরা কি ভেবে দেখেছি ৩০-৪৫ দিনের জীবন কালে কি পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য ব্রয়লার চিকেন কে দেয়া হয়? কি ভাবে এ স্বল্প সময় একটি বাচ্চার ওজন ১.৫-২.০ কেজি হয়। ব্রয়লার চিকেন এ জন্য বলছি যে, এ বাচ্চাতো মোরগ ও নয় মরুগীও নয়। এক খন্ড মাংসপিন্ড। মোরগ- মুরগীর মাংস মনে করে ব্রয়লার চিকেন খাওয়া যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না, কারণ:
- দ্রুত বাড়ন্ত এবং মাংস উৎপাদনের জন্য ব্রয়লার চিকেনকে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য খাওয়ানো হয়।
- পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে ব্রয়লার চিকেনের মাংস বিশেষ করে কলিজা খেলে প্রজনন ক্ষমতা লোপা পায়।
- রাসায়নিক ইনজেকশন ও হরমোনের প্রভাবে ব্যয়লার চিকেন সাধারণ মোরগ- মুরগীর চেয়ে তিনগুণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তবে এ সব রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ মানব দেহে ক্ষতিকর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
- সালমোনেলা, ক্যামপাইলোব্যাক্টর, ই-কোলাই এবং অন্যান্য রোগজীবানুর কারণে মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
- ট্যানারি বর্জ ব্যবহার করে ব্রয়লার চিকেনের খাবার তৈরী হয়। ট্যানারি বর্জের মধ্যে রয়েছে ক্রমিয়াম, শিশা, আর্সেনিক, নিকেল, কপার ইত্যাদি। এ সব বিষাক্ত রাসায়নিকের কারনে মানুষ শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, গ্যাসট্রো ইনটেসটাইনাল, হেমাটোলোজিকাল, হেপাটিক, রেনাল এবং নিউরোলোজিকাল সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
- আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে সয়াবিন ও ভুট্টা আমদানি করে মুরগীর খাবার তৈয়ার করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে সয়াবিন ও ভুট্টা উৎপাদন হয় তা শতভাগ জেনেটিকালি মডিফাইড (জি এম)। এসব জিএম ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আগাছা নাশক হিসাবে মনসান্টো কোম্পনির রাউন্ডআপা রেডি (গ্লাইফোসেট) ব্যবহার হয়। গ্লাইফোসেটের বিষক্রিয়া মুরগীর খাবারের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করতে পারে। খাদ্যে গ্লাইফোসেটের উপস্থিতির সাথে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া জেনেটিকালি মডিফাইড খাদ্য বিভিন্ন প্রাণী ও মানবদেহে মারাত্বক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে (www.responsibletechnology.org; www.seedsofdeception.com; russia-insider.com> Russia officially Slams Door Shut on American GMO-Ru...)
- পোলট্রি চিকেনে ৫০% অধিক চর্বি থাকে। এ মাংস রান্নার সময় ক্রিয়েটিন, এমিনো এসিড এবং চিনির মিশ্রনে হিটারোসাইক্লিক এমাইনস (এইচসিএ) তৈরি হয় যা কার্সিনোজেন হিসাবে মলাশয় ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
- ব্রয়লার চিকেন টিউমার অথবা ক্যান্সার আক্রান্ত হতে পারে। ক্যান্সার আক্রান্ত ব্রয়লার চিকেন থেকে মানব দেহে ক্যান্সার হতে পারে।
- পোলট্রি চিকেন লালন পালন করতে অনেক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এন্টিবায়োটিক যুক্ত পোলট্রি চিকেন সেবনের ফলে মানব দেহে এন্টিবায়োটিক রেজিষ্টান্স তৈরি হয়। ইদানিং যেসব এন্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; টেরামাইসিন, টেট্টাসাইক্লিন, অকসিটেট্টাসাইক্লিন, নিউ মাইসিন, এবং ট্রায় অক্সিসাইক্লিন।
পক্ষান্তরে স্থানীয় জাতের মোরগ-মুরগী যেমন গলাছিলা, ব্ওায়াইলা ঝোপা, দেশী মোরগ, লাল জংলী মোরগ, আচিল, ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে রোগ বালাই ও অন্যান্য পরিবেশ প্রতিকুলতার মধ্যে টিকে আছে। এখনও স্থানীয় জাতের মোরগ- মুরগী দেশজ মোট চাহিদার প্রায় ৫০% পূরণ করে। তবে অধিক লাভের আশায় সংকীর্ণ কৌলিক উৎসের ব্রয়লার চিকেন প্রবর্তনের ফলে স্থানীয় জাতের মোরগ- মুরগীর বংশ বিলুপ্ত হতে পারে। তাই স্থানীয় জাতের মোরগ- মুরগীর জাত রক্ষার জন্য জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। হতে পারে স্থানীয় জাতের মোরগ-মুরগীর উৎপাদন কম। তবে সামান্য খাবার, পানীয় জল এবং সামান্য সেবা যত্নেই তারা বেড়ে ওঠে। সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনার অবিচ্ছেদ্য অংশ, মান সম্মত আমিষের উৎস, পরিবারের আপদকালীন জরুরী আর্থিক সঙ্কটে পরম বন্ধু এবং গ্রামীণ আর্থসামাজিক পরিবেশে স্থানীয় জাতের মোরগ-মুরগী একটি নির্ভশীল নিরাপত্তার প্রতীক হিসাবে অবদান রাখছে। যদিও স্থানীয় জাতের মোরগ- মুরগীর খুব আস্তে আস্তে বড় হয়। কম ডিম দেয়। ডিমের আকারও খুব ছোট। তবে ডিমে তা দেয়, বাচ্চা ফুটায়, বাচ্চার সেবা যত্ন করে, কাক, চিল, বেজি, এবং অন্যান্য শক্রুর হাত থেকে বাচ্চার সুরক্ষা দেয় এবং প্রাকৃতিক নিয়মে বংশ বিস্তার করে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বহিরাগত যে কোন প্রতিকুলতার মধ্যে মোরগ-মুরগীর বংশ রক্ষার জন্য স্থানীয় জাতের ব্যাপক ভিত্তিক কৌলিক সম্পদ রক্ষা করা প্রয়োজন। এ জনপদের সকলের তথা মানব জাতির স্বার্থে স্থানীয় জাতের মোরগ- মুরগীর বৈচিত্র্য রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।