সমৃদ্ধ মাটি, পুষ্টিকর খাদ্য, সুস্থ্য মানুষ
এম. এ. সোবহান || Tuesday 05 November 2024 ||সমৃদ্ধ মাটি পরিবেশে অনেক সুবিধা প্রদান করে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব প্রশমিত করে। পানি সংরক্ষণ এবং পানির গুণমান উন্নত করে। মাটি খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ, বায়ু এবং পানি দ্বারা গঠিত একটি মিশ্র পদার্থ। মাটি উদ্ভিদকে জৈবিকভাবে ধারণ করে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দেয়। সমৃদ্ধ মাটিতে উৎপাদিত খাদ্য মানব দেহের জন্য ভাল।
উদ্ভিদ মাটি থেকে প্রয়োজনীয় ১৭টি উপাদানের মধ্যে ১৪টি পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, আয়রন, দস্তা, মলিবডেনাম, বোরন, কপার, ম্যা\ঙ্গানিজ,ক্লোরিন এবং কোবাল্ট। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ণ ইনষ্টিটিউটের (২০২২) মতে ভাল মাটিতে কম পক্ষে ২.৫% জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মাটিতে বৈজ পদার্থের পরিমাণ ১.৫ এর নীচে।
মটি সংরক্ষণের জন্য মাটির ভৌত রাসায়নিক এবং জৈবিক অবস্থা বজায় রাখে বা উন্নত করে এবং মাটির ক্ষয় কমিয়ে দেয় এমন চাষাবাদ ব্যবস্থা নির্বাচন ও প্রয়োগ করা প্রয়োজন।সচেতন কৃষকরা একাধিক মাটি সংরক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যেমন: কম-চাষ, কভার ক্রোপিং বা ঘুর্ণনশীল চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
একজন আধুনিক কৃষক যখন আগাছা নাশক, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, বালাইনাশক প্রয়োগ করেন তখন সুস্থ্য মাটি তৈরি করা বা রক্ষা করা বেশ কঠিন্।উদাহরণ স্বরূপ- আগাছানাশক, গ্লাইফোসেট/রাউন্ডআপ রেডি যখন মাটিতে প্রয়োগ করা হয় তখন মাটিতে বিদ্যমান উপকারী অণুজীবের ক্ষতি হয়। ঠিক একইভাবে মানুষ যখন গ্লাইফোসেট প্রয়োগ করে উৎপাদিত ফল ফসল সেবন করে,তখন তাদের দেহে বিদ্যমান উপকারী অণুজীব একই রকম ক্ষতির সম্মুখিন হয়।
এক প্রতিবেদনে দেখা যায় শুধুমাত্র ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৮৭ মিলিয়ন পাউন্ড গ্লাইফোসেট ফসলের ক্ষেতে ব্যবহার করা হয়েছিল, যা মানুষের খাদ্য, মাটি এবং পানি দূষিত করে যা উপকারী অণুজীবের সংখ্যা হ্রাস করে এবং ক্ষতিকর জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। উপকারী অণুজীব সমৃদ্ধ মাটি মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য আবশ্যক। জৈব উপাদান ব্যবস্থাপনা অনুশীলন, যেমন-কম্পষ্ট, কভার ক্রোপ, এবং বিভিন্ন ফসলের ঘূর্ণন আবাদ উপকারী অণুজীবের কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে।
জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে (২০১৭) বলা হয়েছে যে বালাইনাশক একটি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার উদ্বেগ। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে বালাইনাশকের ব্যবহার কন্সার, আলজেইমার, পারকিনসন, হরমোনের ব্যাঘাত, বিকাশ জনিত ব্যাধি এবং বন্ধ্যাত্বের সাথে যুক্ত রয়েছে। অন্যান্য সম্ভাব্য প্রভাবগুলির মধ্যে আছে হাঁপানি, অ্যালার্জি ইত্যাদি।
সাধারণ ভাবে দেখা যায় যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে উচ্চফলনশীল জাত ও হাইব্রিড ফসলের চাষ প্রবর্তনের পর থেকে ফল, ফসল ও সবজিতে পুষ্টির মাত্রা হ্রাস পেয়েছে।
মানব স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধ মাটির সংযোগ:
মাটির মধ্যে হাজার হাজার অণুজীব রয়েছে যা উদ্ভিদের জন্য পুষ্টি সহজলভ্য করে এবং যা মানুষের খাদ্যকে পুষ্টি সমৃদ্ধ করে। পুষ্টিকর খাদ্য মানুষের শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। যখন মাটির খাদ্য সম্ভার ধ্বংস করা হয় এবং মাটির মধ্যে লক্ষ লক্ষ অণুজীব মেরে ফেলা হয় তখন মানুষের পুষ্টি গ্রহণ প্রভাবিত হয়।
মাটির স্বাস্থ্যের অবনতি মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি:
কৃষি পৃথিবীর উপরিভাগে ৪৬% জমি জুড়ে বিস্তৃত, মানুষ যেভাবে খাদ্য গ্রহণ করে তা হলো প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ট দিক। তবুও বিশ্বজুড়ে আধুনিক কৃষি সক্রিয়ভাবে মাটির খাদ্য ব্যবস্থাকে ধংস করছে এবং মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে।
আধুনিক কৃষি ও মাটির খাদ্য ব্যবস্থা:
মাটি ক্রমাগত চাষে ব্যকটেরিয়া ও ছত্রাক কাঠমো ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ভারী চাষাবাদ যন্ত্রপাতি মাটিকে সংকুচিত করে। ফলে মাটির ক্ষয় হয় মৌলিক উপাদনের ক্ষয় বেড়ে যায় এবং নিস্কাশন কম হয়।বালাইনাশক মাটির মধ্যে কোটি কোটি অণুজীব মেরে ফেলে,রাসায়নিক সার মাটির অণুজীবের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট করে।
আধুনিক কৃষি ও মানব স্বাস্থ্য:
আধুনিক কৃষির ব্যাপক গ্রহণকে ঐতিহাসিক শক্তির দ্বারা আকৃতি দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এর গতিবেগ অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছিলো।রাসায়নিক ও যন্ত্রপাতি শিল্প যেগুলি যুদ্ধের সময় বিষাক্ত গ্যাস ও যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলো তারা যুদ্ধের পরে খামারের ক্ষেত্রগুলিতে নতুন বাজার খুঁজে পেয়েছিল।তারা তাদের কৌশলগুলিকে অন্য ধরনের যুদ্ধে পরিণত করেছিল: কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
এখন পৃথিবীতে ১৪০০ টিরও বেশি বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। ২০২০ সালে ৩৭,৪২২ মেট্রিকটন বালাইনাশক ব্যবহৃত হয়েছিল। ব্যবহার করা বিষের ১% এরও কম লক্ষ জীবের উপর কাজ করে। বাকিটা পরিবেশে ঢুকে পড়ে, জীবনের প্রবাহকে বিপন্ন করে এবং আস্তে আস্তে মানুষের স্বাস্থ্য ধংস করে। মানুষের খাদ্য উৎপাদনের রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারের পর থেকে প্রদাহ, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, এবং স্নায়ুবিক রোগের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে আরো রয়েছে খাদ্য সম্পর্কিত অসুস্থতা যেমন-স্থূলতা, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, অ্যালার্জি এবং ক্যান্সার।
একই আধুনিক কৃষি যা মাটির খাদ্য ব্যবস্থা ক্ষতি করছে তা মানুষের স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলছে। সেই তুলনায় সমৃদ্ধ মাটি পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। মাটি, খাদ্য ও মানুষের মধ্যে এই অন্তর্নিহিত সংযোগকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের খামার, চাষাবাদ এবং খাওয়ার উপায় স্বাস্থ্য সম্মত ভাবে পরিবর্তন করতে হবে।