বিশ্ব অর্থনীতির কর্পোরেট শিশু ও তার মনস্তত্ত্ব
ফরিদা আখতার || Sunday 17 May 2015 ||শিশুকাল বা বাল্যকাল বলে একটি কথা আছে যা আমাদের সবার জীবনের স্মৃতির একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে। যতোই বয়স বাড়ুক না কেন সকলেরই বাল্যকালের স্মৃতি থেকে তার পুরো মনস্তত্ত্ব বোঝা যায়। শিশু কোন ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছে তার পরিচয় পাওয়া যায় তার শিশুকালের বেড়ে ওঠা কেমন ছিল তা জেনে। তার মনস্তত্ত্ব নির্ণয় করা কঠিন হয় না।
আগের যুগে শিশুকালের বেড়ে ওঠা এবং তার মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠার সাথে সরাসরি মা-বাবা, ভাই বোন ছাড়াও চাচা-চাচী, খালা-মামা, নানী-দাদী, নানা-দাদার প্রভাব ছিল কোন না কোন ভাবে। ভাগ্য ভাল হলে শিশু দাদা-নানার আদর ও শাসনে বড় হতে পারে, ভাগ্য ভাল হলে ছোট মেয়েটি তার দাদী বা নানীর লুকায়িত জ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়ে এই জ্ঞানের ধারাবাহিকতার অধিকারী হতে পারে। নাতনীকে সাথে নিয়ে শাক তোলা, ওষুধি গাছ নিয়ে কাজ করা, গল্প বলা, গাছ-পালা পশু পাখী চেনানো – এগুলোই ছিল খেলার অংশ। পাখীর ডাক শুনে নাম বলতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। গাছের পাতার গন্ধ শুঁকে ফলের নাম বলা- এগুলো ছিল খেলার অংশ। গ্রাম ও প্রাকৃতিক পরিবেশে যারা বড় হয়েছে তাদের সাথে শহরে বেড়ে ওঠা মানুষের পার্থক্য খুবই স্পষ্ট।
অবশ্য শহরের শিক্ষিত মানুষেরা গ্রাম ও প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতাকে আধুনিকতা হিশেবে দেখেন। এবং সেটা ইতিবাচক বলেই মনে করেন। তাদের জানার কথা প্রযুক্তি সম্পর্কে, বিশ্বের ধনী দেশের ‘সভ্যতা’ সম্পর্কে। নিজের দেশের ইতিহাস নিয়ে না জানার মধ্যে তারা অগৌরবের কিছু দেখেন না, কিন্তু ইংল্যান্ডের বা আমেরিকার সব কথা একেবারে ঠোটস্থ থাকতে হবে। এটা না জানা খুব লজ্জার বিষয়। যে জানে না সে হীনমন্যতায় ভোগে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখন ঘরের কাছে সব কিছুকে এনে দিয়েছে। এর প্রভাব সকল বয়সের মানুষের ওপর পড়ে, কিন্তু শিশুদের ওপর এর প্রভাব অনেক বেশী। এটাই তার কাছে পৃথিবী চেনা। তার মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে তার সাথে বাইরের পৃথিবীর সম্পর্কের ভিত্তিতেই, এখানে পরিবার তার কাছে সরাসরি গুরুত্ব পায় না। নিজের অজান্তেই তার খেলনা, তার খাদ্য চাহিদা, তার পোষাক সব কিছু বদলে যায়।
পরিবার পরিকল্পনার বদৌলতে এখন পরিবারে সন্তান সংখ্যা সীমিত হয়ে গেছে। মাত্র দুটি সন্তানের পরিবারের সংখ্যাই বেশী। তবে যাদের একটিমাত্র সন্তান রয়েছে তারা তাদের দশ সন্তানের স্নেহ ভালবাসা একটি সন্তানে যখন ঢালতে যায় তখন তার কি অবস্থা হতে পারে তা এখন আমরা ঘরে ঘরেই দেখতে পারছি। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসুচি এসেছিল সুখী পরিবার গড়ার জন্যে, কিন্তু এর বদলে পাওয়া গেছে এক-সন্তানের রাজত্ব।
ছেলে হোক মেয়ে হোক এক সন্তানই যথেষ্ট, এমন শ্লোগান মেনে যাদের একটি বা দুটি সন্তান হয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম নারী পুরুষ বিভাজনের জন্যে কোম্পানির রঙ্গের খপ্পড়ে পড়ে যেতে হয়েছে। মেয়েদের জন্যে সকল খেলনা, খাতা, কলম, জামা কাপড় সব কিছু গোলাপী আর ছেলেদের জন্যে সবই হাল্কা নীল। ছোট বেলা থেকে শিশুরা নিজে এই রঙয়ের পার্থক্য কেন করা হয় বুঝতে না পারলেও এটা বোঝে মেয়ে হলে তার রং হচ্ছে গোলাপী আর ছেলে হলে হবে নীল। দোকানে গেলে মেয়েটি নিজেই গোলাপীর দিকে এগিয়ে যাবে। রংয়ের এই পার্থক্যের ধারণা তার মনে গেঁথে গিয়ে ছেলেটি এক সময় পুরুষ হয়ে ওঠে।
মেয়েটি বড় হলে কেমন দেখতে হবে তা ঠিক করে দেয় বার্বি ডল (পুতুল) নানা ধরণের পোষাক ও সাজ সজ্জা দিয়ে। একটি আমেরিকান কোম্পানি Mattel Inc. ১৯৫৯ সালে শুরু করেছিল। বার্বি খুব লম্বা-পাতলা একটি মেয়ের শরীর, বার্বি ডলের মতো হতে গিয়ে মেয়েরা একটু যখন তার খাওয়া দাওয়া খুব দরকার সে সময় খাওয়া বন্ধ করে দেয়। পাঁচ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা মেয়ের ওজন হবে মাত্র ৩৫ কেজি! এই বার্বি ডল বিশাল ব্যবসা ক্রছে। শুরুতেই ৩ ডলার দামের বার্বি প্রায় ৩৫১,০০০ টি বিক্রি হয়ে যায়। এর মধ্যে হাজার কোতী বার্বি ডল বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ধনী ও মধ্য আয়ের দেশে ৩ থেকে ১০ বছর বয়সী ৯০% মেয়েদের অন্তত একটি বার্বি ডল আছে।
ছেলেদের ক্ষেত্রে আর এক ব্যাবসা। বিশ্বের যেখানেই যান শপিং মল-এ গিয়ে খেলনা কিনলে যুদ্ধের যতো সরঞ্জাম ছেলেদের জন্যে রয়েছে। গাড়ীর নানা মডেল ও ধরণ ছেলেরা খুব ছোট বয়সেই নিজে পছন্দ করে কিনতে শিখে যায়। এই সময় দামটি বাবা-মায়ের সাধ্যের মধ্যে না থাকলে শিশু মন ক্ষুন্ন হয়। কেউ কেউ জেদ ধরে, এবং বাবা-মাকে কিনে দিতে বাধ্য করে।
বর্তমান যুগে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ শুধু মাত্র দিনটিকে শিশুর জন্যে শুভ কামনার জন্যে করা হয় না, বরং করা হ্য়, ঘর কে বিশেষভাবে বেলুন ও রঙ্গীন কগজে সাজানো, মোমবাতি লাগানো কেক কাটা, এবং বিনিময়ে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে ‘গিফট’ নেয়া। আজকাল বাংলায় উপহার শব্দটিও প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, কারণ উপহারের মধ্যে গিফটের চাকচিক্য থাকে না। শিশু তার জন্মদিনের আগে থেকেই মা-বাবার কাছে আগেভাগেই গিফট চায়, এবং নির্দিষ্টভাবে বলে দেয় কোন খেলনাটি তার চাই। সে খবর রাখে বাজারে এখন নতুন খেলনা কি এসেছে।
দেশে খেলনার জাতীয় পর্যায়ের বাজার আজকাল খুব একটা নেই। গরিবের বাচ্চাদের জন্য প্লাস্টিকের খেলনা কিছু আছে, কিন্তু মধ্যবিত্ত ও ধনিদের শিশুরা আন্তর্জাতিক বাজারের খেলনার বড় একটি বাজার। খেলনার মধ্যে ভাগ রয়েছে। সাধারণ খেলনা যেমন এয়কশান ফিগার, বিল্ডিং সেট বা লেগো, পুতুল (বার্বি), পাজল গেম আর নরম তুলতুলে খেলনা, নানা ধরণের গাড়ী, মোটর সাইকেলসহ নানা ধরণের যানবাহন। এই খেলনার বাজার বেশ বড়; যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ২১.২ বিলিয়ন ডলার (২০০৭)। খেলনা কিনতে গিয়ে বয়স অনুযায়ী ভাগ করা থাকে। ছয় মাস বয়স এদিক ওদিক হলেই খেলনার ধরণ পালটে যায়? তখন প্রশ্ন জাগে তারা কি খেলনা ব্যবহারের সাথে শিশুর মন্সতাত্ত্বিক বিকাশের গবেষনা করে দেখেছেন, নাকি ভিন্ন ভিন্ন খেলনার বাজার সম্প্রসারণ করাই উদ্দেশ্য?
দিত্বীয় ধরণের বিশাল খেলনার বাজার হচ্ছে ভিডিও গেমস। এই খেলনার বাজার খুব দ্রুত বাড়ছে প্রায় ১৮.৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আছে ইয়ুথ এলেট্রনিক্স (PS2, X-Box), গেমিং পার্লার (Jammin, TimeZone) ইত্যাদী। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে কেসিনো গেম তো আছেই।
ভারতে বড় বড় ৮০০ কোম্পানি উৎপাদিত খেলনার বাজার প্রায় ২৫০০ কোটি ইন্ডিয়ান রুপী। তবে বড় কোম্পানি পাশাপাশি ছোট বা মাঝারি কোম্পানিও রয়েছে।
শিশুর খাদ্য আর মায়ের হাতে নেই। বাংলাদেশের ঢাকায় একবার এক দেশী পিঠা মেলা করা হয়েছিল। তখন সেখানে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের এনে পিঠা খাওয়া ও নাম বলার প্রতিযোগিতা ছিল। এক পর্যায়ে এক শিশু দুঃখ করে বললো আম্মু ঘরে তো এগুলো বানায় না। সব দোকান থেকে কিনে খাওয়ায়। এই মেলায় যেসব পিঠা ছিল তা সবই মহিলারা বানিয়ে এনেছেন। আধুনিক মায়েরা তাদের বাচ্চাদের জন্য পিঠা বানায় না, বড় জোর কেক, স্যান্ডুইচ, নুডুলস বানিয়ে ঝটপট খাইয়ে দেয়। কিন্তু বাচ্চা যে খাবার পছন্দ করে সেই খাবার তাকে নিজের হাতে বানিয়ে দেন না। এই কথাটি শিশুটি বুঝেছে পিঠা মেলায় এসে। অভিমানের সুরে বলা এই বাক্যটা আমার কাছে একজন বঞ্চিতের সুর হিশেবে কানে গেছে।
এখন বাচ্চাদের খাবার খেতে হবে বিজ্ঞাপন দেখে। টেলিভিশনে শিশুদের প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে যে বিজ্ঞাপন যায় তা খাদ্য কোম্পানির। দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় (৩০ মে, ২০১৪) প্রকাশিত হ্যারী ওয়ালপের একটি লেখায় এই বিজ্ঞাপনের কারসাজীর সুন্দর উদাহরণ আছে। তিনি লিখেছেন এভাবেঃ
‘কয়েক মাস আগে আমার আট বছর বয়সী ছেলেটি তার মিনি-প্যডে খুব ফাস্ট একটি গেম খেলছিল। এই গেমের মধ্যে ছিল সমুদ্রের একটি কাঁকড়া একটি ফুটবল নিয়ে খুব ছোটোছুটি করছে। এটা খুব মজার খেলা। কিন্তু হঠাৎ আমার চোখে পড়লো কাঁকড়াটি একটি দ্বীপে যাবার সময় McDonald রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে চলে গেল, যদিও দৃশ্যটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ছিল কিন্তু ছবিটি যথেষ্ট দৃশ্যমান করে তোলা হয়। জানা গেল “Crabs and Penguins’ নামের এই গেমটি কোকাকোলা ও ম্যাকডোনাল্ডের যৌথভাবে প্রযোজনা করেছিল। গেমের মধ্যে মনে হয়েছিল কাকড়া কিছু কয়েন সংগ্রহ করছে, কিন্তু আসলে সেগুলো ছিল কোকাকোলা বোতলের ছিপি। ” অর্থাৎ গেম খেলার মধ্যে তাকে ম্যাকডনাল্ড ও কোকাকোলা শিখিয়ে দেয়া হোল।
যুক্তরাজ্য সহ ইওরোপে টিভিতে Ofcom নামক সম্প্রচার শিল্পের নিয়ন্ত্রক শিশু স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর খাবারের বিজ্ঞাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। আশ্চর্যজনকভাবে কোকাকোলা, ম্যাকডোনাল্ড, কেলগের মতো কোম্পানি ১২ বছরের কম বয়সের শিশুরা যে টিভি প্রোগ্রাম দেখে তাতে কোন বিজ্ঞাপন দেবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। এর ফলাফল ভালই পাওয়া গিয়েছিল। ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিভাগের একটি জরীপে দেখা যায় শিশুদের মধ্যে মুটীয়ে যাওয়ার হার কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু খুব দ্রুত তারা অন্য কৌশলে বিজ্ঞাপনের কাজটি করতে শুরু করে দেয়।
উঠতি বয়সের শিশুদের পরীক্ষায় ভাল ফল করতে হলে, ভাল ক্রিকেট খেলতে হলে, এবং উল্লেখযোগ্য কিছু হতে হলে হরলিক্স খেতে হবে - এমন বিশ্বাস মায়েদের মধ্যে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে আর অন্যদিকে কমপ্লান খেলে লম্বা হয়ে যাবে, স্বাস্থ্যবান হবে বিশাস করানো হচ্ছে ছোট ছেলেদের। ভারতের বিজ্ঞাপন বাংলা ভাষায় করে বাংলাদেশে সব চ্যানেলগুলোতে চলছে। তাতে কিছু এসে যায় না, কারণ এই পণ্যের কোম্পানী ভারতেরও নয়, বাংলাদেশেরও নয়। হরলিক্স উৎপাদন করে GlaxoSmithKline কোম্পানি, আর কমপ্লান ফুডসও ব্রিটিশ কোম্পানি, মূল কোম্পানি ছিল গ্লাক্সো। তবে তারা যে দেশে তাদের বাজার আছে সেখানেই উৎপাদন করে। মিথ্যে পুষ্টির কথা বলে এই কোম্পানিগুলো শিশু এবং তাদের মা-বাবার কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আর যারা কিনছে তারা বিশ্বাস করছে তাদের সুস্থ থাকার জন্যে এই খাদ্য খুব জরুরী। বাংলাদেশে হরলিক্সের একটি বিজ্ঞাপনে খুব নিষ্ঠুরভাবে এক মাকে অনেকটা বোকা বানিয়ে দেয়। এই মা প্রতিদিন পুষ্টির কথা চিন্তা করে কোন না কোনভাবে তার শিশুকে পুষ্টির যোগান দিয়ে খাবার তৈরি করে দেয় নিজ হাতে। কিন্তু অন্য দুটি মা যারা হরলিক্স খাওয়ান তারা তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে তিনি যতোই চেষ্টা করুন না কেন “রোজ-রোজ” সম্পুর্ণ পুষ্টি দিতে পারবেন না, যা হরলিক্স পারবে। কাজেই তারও উচিত হরলিক্স খাওয়ানো!!
বেবী ফুড বলতে যা বোঝায় তার মূল উৎপাদনকারী সুইজারল্যান্ডের নেসলে কোম্পানি। বাচ্চা ক্লিনিকে জন্ম নিলে গাইনোকোলজিস্ট মায়ের হাতে নেসলের দুধের কৌটা ধরিয়ে দেন। তারপর শিশুটি কয়েকমাস বয়স হলেই সেরেলাক এবং এভাবে নেসলে শিশু হয়ে বড় হয়ে উঠবে। একসময় গ্লাক্সো কোম্পানি বাচ্চাদের দুধের কারবার বেশী করতো। নাদুশ-নুদুশ বাচ্চা দেখলেই বলা হোত গ্লাক্সো-বেবী। গ্লাক্সো কোম্পানি এমন শিশু্র ছবি তুলে দুধের কৌটায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে বাচ্চা আসলে মায়ের বুকের দুধ খেয়েই অমন সুন্দর হয়েছে। কিন্তু গ্লাক্সো কোম্পানি্র সেই বাচ্চাকেই চাই তার পণ্যের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অন্য মাদের আকৃষ্ট করে দুধ বিক্রির জন্যে। ।
খাদ্য ও খেলনা দিয়েই বোঝানো যায় কি করে বর্তমান সময়ের শিশুরা বিশ্ব অর্থনীতির বড় অংশ হয়ে আছে। তাদের নিজের কোন আয় নেই, কিন্তু তাদের জন্যে তাদের মা-বাবার আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে কোম্পানির মুনাফা হয়ে। শিশুর খাদ্যের চাহিদা কোম্পানির সাথে মিলে হয়ে যায়। কোম্পানি যা উৎপাদন করবে শিশু তাই খাবে। তার পছন্দ অপছন্দ, ভাল লাগা সব কিছুই কোম্পানির পণ্যের সাথে মিলে যায়। সে ভিন্ন কিছুর সাথে পরিচিত নয় বলে তার স্বাদটুকু বোঝার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। যে শিশু মায়ের দুধ খেতে পারে না, মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ আলাদা করে চেনে না, সবই ম্যাগী স্বাদ, তাহলে সে শিশু নিশ্চয়ই মায়ের সাথেও কোম্পানির মতোই আচরণ করবে। মা-বাবা তাদের জন্যে কোম্পানির তৈরী খাদ্য, খেলনা, কাপড় সব কিছু এককাট্টা ছাঁচের মধ্যে ফেলে দিয়ে করে দেয়। কৃষিতে যেমন মনোকালচার বা এককাট্টা ফসল করতে গিয়ে নানা জাতের নানা ধরণের ফসল থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি, তেমনি বর্তমান কালের শিশুদের আচার আচরণ চাহিদা, অন্যের সাথে সম্পর্ক সবই কেমন যেন একই রকম হয়ে গেছে।
তবে সবচেয়ে বেশী লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে শিশুরা মা-বাবার আদর ও ভালবাসা পাচ্ছে কোম্পানির মাধ্যমে, সরাসরি নয়। এমন কি ন্যাপীটাও বিশেষ কোম্পানির! শিশুদের খেলার সামগ্রীগুলো এমন যে তাদের একা একা খেললে চলে, সঙ্গীর দরকার হয় না। পরিবারে সন্তান সংখ্যা কম বলেই খেলনা কোম্পানিও সে ধরণের খেলার ব্যবস্থা করে রেখেছে। এমন কি ছেলেরা ব্যডমিনটান বা টেবিল টেনিসের মতো কমপক্ষে দুজন লাগে এমন খেলা একা টেলিভিশনের স্ক্রীনের সাথে খেলতে পারে! দাবা, তাস সবই একা খেলা যায়। আর কি চাই। কারো সাথে তার কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। ঝগড়া তো দুরের কথা!
সবশেষে বলি নতুন বিশ্ব অর্থনীতিতে গড়ে ওঠা এই শিশুরা পুঁজিতন্ত্রের মূল খোরাক। তারাই পুঁজিতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখছে। তাই পুঁজিতন্ত্র তাকে স্বাধীনতার মন্ত্র দেয়। ধারণা দেয় সে স্বাধীনভাবে সিদ্ধ্বান্ত নিচ্ছে সে কি হতে চায়, কি করতে চায় এবং সে যা চায় তা অবশ্যই পায়। মা-বাবার শাসনের বাইরে থাকাটা তার জন্যে স্বাধীন হবার প্রধান দিক।
কিন্তু আসলে কি সে স্বাধীন? মা-বাবা, আত্মীয় স্বজনদের কোন বাধ্য বাধকতায় না থেকে সমাজের নিয়ম কানুন উপেক্ষা করে সে কোম্পানি দেয়া রঙ্গে নিজেকে সাজায়, তার শরীরে তাদেরই খাদ্য ঢোকায় এবং তাদেরই বিনোদনে বড় হয়, ‘শিক্ষিত হয়’।
এই শিশু ব্যক্তিকেন্দ্রিক হতে বাধ্য, কারণ সে ছাড়া তার পাশে আর কেউ নেই।