জনস্বাস্থ্য খাতে অবহেলা ও পরিকল্পনাহীনতার বাজেট, ২০১৭-১৮
সম্পুর্ণ অবহেলা ও পরিকল্পনাহীনতার প্রকাশ ঘটেছে বাজেট ২০১৭-১৮ এর স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দে। স্বাস্থ্য আন্দোলন, তাবিনাজ, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশান, ডাব্লিও বিবি ট্রাস্ট, নিরাপদ ডেভেল্পমেন্ট ফাউন্ডেশান, নারীপক্ষ ও উন্নয়ন ধারা ট্রাস্টের যৌথ আয়োজনে ৬ জুন,২০১৭ সকাল ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলন এই বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদা আখতার।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের পক্ষে মূল বক্তব্য পড়ে শোনান এড.সৈয়দ মাহবুবুল আলম, এবং তাবিনাজের পক্ষে ও সাইদা আখতার ।
সংবাদ সম্মেলনে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন, অধ্যাপক ডা.রশিদ-ই-মাহবুব, সভাপতি, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি, ডা. ফয়জুল হাকিম, প্রফেসর মোজাহেরুল হক, সীমা দাস সীমু, মোঃ আমিনুর রসুল, ইবনুল সাইদ রানা, সৈয়দা অনন্যা রহমান, ড. এম. এ সোবহান, নাজনীন সুলতানা ও রোকেয়া বেগম।
অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, এবারে বাজেটের যে চরিত্র তাতে দেখা যায় গতবার যে বাজেট দিয়েছিল তার চেয়ে সংশোধিত বাজেটে তিন হাজার কোটি টাকা কম পেয়েছে। এই বাজেটে স্বাস্থ্য সেবার জনয়ে কোন বরাদ্দ বাড়েনি, বরং কমেছে। সরকারকে আমরা বিভিন্ন সময়ে এই নিয়ে বলেছি, কিন্তু কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজেট বাড়ার মূল জায়গা হচ্ছে সরকারি কর্মচারিদের বেতন ৫% বাড়বে। ইউটিলিটি বিল বাড়বে,ওষুধের দাম বাড়বে। হাসপাতালে বিছানা কম,খাবারে বরাদ্দ কম এটা বাড়াতে হবে।
ড. মোজাহেরুল হক, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট সব চেয়ে কম। অ-সংক্রামক রোগ বাড়ছে, চিকিৎসা খরচ বহন করতে গিয়ে ৬৪ লক্ষ লোক দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। রোগ প্রতিরোধের জন্যে ক্ষতিকর ও কোমল পানীয়ের যেমন এনার্জি ড্রিংক সহ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্যের ওপর ট্যাক্স বাড়ানো উচিত।
ডা. ফয়জুল হাকিম, এবারের বাজেটে চিকিৎসা খাতকে অবহেলা করা হয়েছে। এবাজেট আমরা প্রত্যাখান করছি।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের বক্তব্যে বলা হয়, জনগণের স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার দায়িত্ব থেকে সরকার মুক্তি পেতে চাইছে।স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার আনন্দে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারের দায়দায়িত্ব আরও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। তারা অবাধ দরজা খুলে দিয়েছে বেসরকারি খাত থেকে সেবা নেয়ার ওপর। ফলে বাজেটে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারের দায়িত্ব কি হবে,তা নিয়ে সরকারের কোন পরিকল্পনা নেই।
তাবিনাজের বক্তব্যে বলা হয় ধোঁয়াবিহীন তামাক স্বাস্থ্যের অত্যন্ত ক্ষতিকর, বিশেষ করে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব নেতিবাচক। ধোঁয়াযুক্ত এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমাবার আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে করারোপ করে তামাক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু তামাক দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি ও উচ্চ হারে করারোপ এর মতো কার্যকর পদক্ষেপ এবারের বাজেটে নেই। অর্থ মন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় নারীরা ব্যবহার করেন এমন তামাক দ্রব্যের (জর্দা, গুল, সাদাপাতা) কোন উল্লেখ নেই। এই বাজেট দরিদ্র ও নারী বিরোধি।
স্বাস্থ্য আন্দোলন সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব করছে গৎবাঁধা স্বাস্থ্য বাজেট সংশোধন করে প্রয়োজনের ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হোক।
১. বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বের প্রেক্ষিতে কমপক্ষে ৭ থেকে ১০% করতে হবে।
২. বাজেট বরাদ্দে উপজেলা পর্যায়ে ৬০%, জেলা পর্যায়ে ৩০% এবং জাতীয় পর্যায়ে ১০% আনুপাতিক হারে বরাদ্দ দিতে হবে।
৩. জীবন যাত্রার ধরণের সাথে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে। তাই বাজেট বরাদ্দ সেই দিক বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
৪. যে সকল হাসপাতাল ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায়, ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় এবং ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে সে সকল হাসপাতালে সার্বিক বরাদ্দ বর্ধিত শয্যা অনুযায়ী হওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তকরণ ।
৫. বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্যে বিশেষ স্বাস্থ্য সুবিধার বাজেট থাকতে হবে।
৬. পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশেষ বরাদ্দ থাকতে হবে।
৭. জনস্বাস্থ্য সেবা বাড়ানো এবং রোগ প্রতিরোধের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি আমরা দেখতে চাই।
৮. নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে পরিকল্পনা তৈরি, লোকবল নিয়োগে অগ্রাধিকার প্রদান ও বরাদ্ধ প্রদান।
৯. বেভারেজ ও সুগারজাতীয় পণ্য, জাঙ্কফুড, চিপস বা অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের উপর বিশেষ স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর আরোপ করা।
১০. শারিরীক ও মানসিক সুস্থ্য রাখতে পার্ক, হাঁটার সুব্যবস্থা, পথচারীদের চলাচলের নিশ্চিত লক্ষ্যে বরাদ্ধ প্রদান।
১১. ইউনিয়ন হতে মহানগর পর্যন্ত পর্যাপ্ত খেলার মাঠ চিহ্নিতকরণ ও বৃদ্ধিতে অগ্রাধিকার বৃদ্ধিতেপর্যাপ্ত বরাদ্ধ প্রদান। স্টেডিয়াম ও থিম পার্ক অপেক্ষা খোলা খেলার মাঠ ও পার্কে বরাদ্ধ প্রদান।
তামাকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিবেচনা করে প্রস্তবনাসমূহ বাস্তবায়নের আমাদের সুপারিশসমূহ-
- সিগারেটের ক্ষেত্রে মূল্যস্তরভিত্তিক কর-প্রথা, বিড়ির ক্ষেত্রে ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা বাতিল করে কার্যকরভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্পেসিফিক এক্সাইজ ট্যাক্স নির্ধারণ করা।
- গুল-জর্দার ক্ষেত্রে এক্স-ফ্যাক্টরি প্রথা প্রভৃতি বাতিল করে প্যাকেট/কৌটা ওজন ও সাইজ অনুযাযী কার্যকরভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্পেসিফিক এক্সাইজ ট্যাক্স নির্ধারণ করা।
জনস্বাস্থ্য, বিশেষ করে নারী স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় রেখে এবারের বাজেটের সংশোধনীতে জর্দা ও গুলের খুচরা মূল্যের ওপর সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করার দাবি জানাচ্ছি।