টাঙ্গাইলরে বিষ্ণুপুর গ্রামে 'নিরাপদ খাদ্য মেলা' অনুষ্ঠিত
উবিনীগ, বীজবিস্তার ফাউনডেশান, দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা আয়োজিত টাঙ্গাইল জেলার পাথরাইল ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামে সারাদিনব্যাপী 'নিরাপদ খাদ্য মেলা' অনুষ্ঠিত হয় ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭ । মেলায় বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন ড. রোকেয়া খানম, ন্যাশনাল এ্যাডভাইজার, ফুড এ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন ফুড সেফটি প্রোগ্রাম। সাবিনা ইয়াসমিন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল, ভাইস চেয়ারম্যান রেবেকা পারভীন, দেলদুয়ার উপজেলা পরিষদ, টাঙ্গাইল। এছাড়াও হানিফুজ্জামান লিটন চেয়ারম্যান, পাথরাইল ইউনিয়ন পরিষদ, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল। জাহাঙ্গীর আলম জনি পরিচালক, উবিনীগ, টাঙ্গাইল কেন্দ্রের সমন্বক রবিউল ইসলঅম চুন্নু, হারুন-অর-রশিদ সমন্বক, ঈশ্বরদী, পাবনা, টাঙ্গাইল কেন্দ্রের কর্মী রজব আলী, যোয়াকিম মাংসাং, জাকির হোসেন, রনি সরকার, লাবণী আকতার, বরকত হোসেন, মোঃ মিরাজ খান এবং দেলদুয়ার উপজেলার ১৩টি গ্রামের প্রায় ৬৭০জন নয়াকৃষির কৃষক এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত বিভিন্ন পেশার লোকজনসহ প্রায় ২ হাজারের উপরে উপস্থিত ছিলেন। নিরাপদ খাদ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ফাহিমা খাতুন লিজা।
নিরাপদ খাদ্য মেলায় ৬টি ষ্টল ছিল
১. নিরাপদ সবজী -কাঁচকলা, গইজা আলু, চালকুমড়া, লেবু, দেশী লাউ, ফুলকপি, মিষ্টিকুমড়া, কাঞ্জাল, লাইশাক, ধনিয়া পাতা, সাহেব আলু, পেঁপে, সীম, লালশাক, বেগুন, করলা।
২. কুড়িয়ে পাওয়া শাক - নেটাপেটা শাক, কানাই শাক, কলমি শাক, গুমা শাক, ঢেঁকিশাক, তেলাকুচা, খেতা শাক, হেলেঞ্চা, পিঁপুল, মোরগ শাক, হেঞ্চি, কচুশাক
৩. স্থানীয় জাতের বীজ- কুসুমফুল, তিল, চটকা সীম, তক্তা সীম, বাইমা সীম, বথুয়া, পেঁপে, ভুট্রা, কালিজিরা, টমেটো, বেগুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, পালংশাক, ডাঁটা, গম, পায়রা, ঝিঙ্গা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা।
৪. উবিনীগ প্রকাশনা
৫. শস্য প্রবর্তনা-উৎপাদিত নিরাপদ খাবার
৬. পিঠার ষ্টল-কৃষকরা পিঠা তৈরী করে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানঃ
শুরুতে উদ্বোধনী গান পরিবেশন করেন নয়াকৃষির কৃষক মোঃ আক্কাছ আলী। গানের কথা-
“ও বোন শুনছোনি
তোমরা জানছোনি
নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার ৫টি মূলনীতি”।।।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাহাঙ্গীর আলম জনি। তিনি বলেন, দেলদুয়ার বিশ্বের মানচিত্রে ঘোষিত উপজেলা আকারে পরিচিত। প্রচার মাধ্যম আপনারা ওয়েবসাইটে দেখতে পারেন। দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা ৫টি সংগঠন সমন্বয়ে পরিগঠিত নেটওয়ার্ক ২০১৫সাল থেকে দেলদুয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষনা উপজেলা প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতার লক্ষ্যে স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে ৪টি কর্মশালা করেছি। কিছু কিছু স্বাস্থ্যের অনুশীলন বাচ্চারা এখন করছে। কৃষকদের নিয়ে কাজ করছি। নিরাপদ খাদ্যের সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পথ খাবার বিক্রেতার মাঝে ভ্যানগাড়ি দিয়েছি। তারা পরিবহনে করে নিরাপদ খাদ্য বিক্রি করছে। বাস্তবায়নের জন্য মেলার মাধ্যমে সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি আমরা গ্রহণ করেছি। দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা সকলের কাছে নিয়ে যাব। নেটওয়ার্কের আরো ৩টি সংগঠন অনুপ্রানিত হয়ে নিজ নিজ এলাকায় নিরাপদ খাদ্য এলাকা ঘোষনা করেছে। খাদ্য বলতে নিরাপদ খাদ্য বলা হয় না। খাদ্য যেটা খাচ্ছি খাদ্য নয়। কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করি। অনেকগুলো কারনে খাদ্য দুষণ হচ্ছে। আমরা সুস্থ থাকব। ১ লক্ষ কৃষক সম্পৃক্ত। তারা খাদ্য উৎপাদনের বিষয় জানে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
লাউহাটি ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জাহানারা বেগম বলেন, দেশ বাঁচানোর কাজ উবিনীগ করছে। এখন সরকারও এই কাজে যুক্ত হয়েছে। গ্রামের মানুষকে দেখি ফজরের নামায পড়ে রাস্তায় হাটে। ছোটবেলায় দেখছি আগে ৮/১০জন কলেরায় মারা যেত। এখন মরে না। কিন্তু সার-কেমিক্যাল ব্যবহার করা খাবার খেয়ে মানুষ ষ্ট্রোক, ক্যান্সার হয়ে মারা যাচ্ছে। বাইরের খাবারে কেমিক্যাল , রং ব্যবহার করে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, জমি বাড়ে না। সার-বিষ ব্যবহার করে নিজে নিজে মারা যাচ্ছি। আসুন সবাই সচেতন হই। নিরাপদ খাদ্য খাই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে দেহ-মন ভাল থাকবে। হাঁস-মুরগী পালন, কম্পোষ্ট দিয়ে জমি চাষ করি।
কৃষক রপসী বেগম বলেন, আলাদা ব্যাগে মাছ-মাংস বাজার করলে নিরাপদ। উৎপাদন থেকে শুরু করে রান্না পর্যন্ত নিরাপদ খাদ্য খাই। থালা-বাসন ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে। বটি,দা ধুয়ে শুকাতে হবে। উপজেলা চেয়ারম্যান নিরাপদ খাদ্য উপজেলা ঘোষনা করেছেন। এ রকম প্রত্যেক উপজেলা ঘোষনা হওয়া চাই।
কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ডিম, দুধ, কলা খাই দেহ উন্নত জন্য। বাজার থেকে কিনে খাইলে যাচাই করে কিনতে হবে। নিরাপদ পুষ্টিকর খাবার খেতে সকলকে সচেতন হতে হবে।
ড. রোকেয়া খানম বলেন, দেলদুয়ারে আসলে ভাল লাগে। মনে হয় আপনারা আমার অনেক পরিচিত। আমাদের নেতৃত্বে আপনারা কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আপনাদের কথা শুনে আমি অভিভূত। আমার এখানে আসা স্বার্থক। দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করব। চেয়ারম্যানের ঘোষনা বলিষ্ঠ সাহসী পদক্ষেপ ছিল। আপনারা প্রচারের কাজ করছেন। আক্কাছ আলী তার গানে ৫টি কথা সুন্দর বলেছেন। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করলে হবে না। খাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিরাপদ থাকতে হবে। কোন সার-কীটনাশক দিলেন না রান্না করার সময় নোংরা পরিবেশে রান্না করলে খাওয়ার আগ পর্যন্ত পরিশ্রম নষ্ট হয়ে যাবে। নিরাপদ খাদ্য জটিল ব্যপার। রাস্তা-ঘাট চাইলে করতে পারব না। বাড়ির খাবার নিরাপদ করতে পারবেন। ফর্মালিন, পেষ্টিসাইড ভেজালযুক্ত খাবার খেয়ে জটিল রোগ হচ্ছে। কৃষক উৎপন্ন করে। আপনাদের ২০০স্কুলে শিক্ষার্থীদের লিফলেট দিয়েছি। আপনারা গর্ব করে বলতে পারেন আপনারা নিরাপদ খাদ্য এলাকায় আছেন। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কাজ করছেন। আপনাদের সাথে আছি দেলদুয়ারের চেহারা বদলে দিয়েছেন। বছরে ৩/৪টি সভা করলে কাজ শেষ হয় না। চলতে থাকবে। অন্য জায়গায় নিরাপদ খাদ্য কি বলতে পারবে না। এফএও বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য ব্যবহার এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাফল্য কামনা করি। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ুক।
ইউপি চেয়ারম্যান হানিফুজ্জামান লিটন বলেন, নিরাপদ খাদ্য বলতে আমরা বুঝি বাস্তবে করি না। উৎপাদনে যা যা করা প্রয়োজন চেষ্টা করছে। শাক-সবজী সার ছাড়া কিছু হয় না। গুমা শাক নিরাপদ । বথুয়া শাক এখন চাষ হয়। দেলদুয়ার নিরাপদ খাদ্য উপজেলা ঘোষনা করা হয়েছে। সংসারে মায়েদের নেতৃত্ব বেশি।
ভাইস চেয়ারম্যান রেবেকা পারভীন বলেন, নিরাপদ খাদ্য পেতে সার-বিষ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। উবিনীগের উছিলায় আমরা উপরে আলোচনা করি আর আপনারা বাড়ি বাড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। মায়েরা সিজার করে। সরকার এখন বলছে আর নয়“ সিজারিয়ান শিশু, নর্মাল ডেলিভারী”। মায়েদের উৎসাহিত করবেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আমি এই প্রথম এ ধরনের মেলায় অংশগ্রহণ করছি। টাঙ্গাইল দেলদুয়ার উপজেলা নিরাপদ খাদ্য উপজেলা ঘোষনা করে কাজ করছে। আপনার আমার গর্বের বিষয়। চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সার-কীনাশকের ক্ষতির বিষয়ে সকলকে সচেতন করুন। জনগনের মাঝে ছড়িয়ে দেন।
সভাপ্রধান এস. এম. ফেরদৌস আহম্মেদ বলেন, আমরা যে আন্দোলনে নেমেছি, এই আন্দোলন চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের দেলদুয়ার ইতিহাস, ঐতিহ্যে ভরা। নিরাপদ খাদ্য মানুষের জীবনে বেশি প্রয়োজন। অসুখ হলে কিছু ভাল লাগে না। নিরাপদ খাদ্য নিজ, দেশ সকলের জন্য প্রয়োজন। আমরা এগিয়ে যেতে চাই। আলসা গ্রামে ২০০একর জমিতে বিষমুক্ত সবজী উৎপাদন করে। নিরাপদ খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে। অন্যান্য সবজীর চেয়ে ৫টাকা দাম বেশী। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করছি তাদের ভাষায় প্রমাণিত। উৎপাদন থেকে শুরু করে মুখে তুলা পর্যন্ত নিরাপদ হতে হবে এর ১টি ব্যত্যয় হলে অসুস্থ হবেন। সকল দিক থেকে সচেতন হতে হবে। হাত যেন পরিষ্কার, পানিও নিরাপদ হতে হবে। টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করে খেতে হবে। স্কুলে উন্মুক্ত জায়গায় খোলা খাবার বিক্রি করে। নিরাপদ খাদ্য বিক্রির লক্ষ্যে ৮টি ইউনিয়নে ৮টি ভ্যান দিয়েছি। আপনাদের প্রতিবেশীদের সচেতন করবেন। যারা উপস্থিত হতে পারেন নাই তাদের মাঝে ছড়িয়ে দেবেন। মা-বোনেরা খেয়াল করবেন। নর্মাল ডেলিভালরি জন্য উৎসাহিত করবেন। বাল্য বিয়ে সামাজিক ব্যাধি। বাল্যবিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। দেলদুয়ার বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষনা করব।
দ্বিতীয় অধিবেশনঃ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন রবিউল ইসলাম চুন্নু, সমন্বক, টাঙ্গাইল।
প্রথমে পাথরাইল স্কুলের শিশু শ্রেণীর ছাত্রী নীলিমা আকতার একটি শিশু নৃত্য পরিবেশন করে। এরপর নিরাপদ খাদ্যের উপর নয়াকৃষির কৃষকেরা ১টি নাটিকা পরিবেশন করেন। এরপর নয়াকৃষির কৃষক আরফান আলী, আক্কাছ আলী, হাবিবুর রহমান । তাৎক্ষনিকভাবে স্থানীয় শিল্পীরা নিরাপদ খাদ্য, নয়াকৃষির উপর গান তৈরী করে পরিবেশন করেন। তাদের গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়।