মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ


উবিনীগের আয়োজনে টাংগাইল রিদয়পুর বিদ্যাঘরে, মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ প্রকল্পের কাজের চলতি তিন বছর সফলতা অর্জনে সবার অংশগ্রহণে এক পরিকল্পনা সভার আয়োজন করা হয় ১৭-২০ আগস্ট, ২০১৪। সভায় ১৫ টি জেলা থেকে আগত অংশগ্রহণকারী সদস্য ছিল ৫৫ জন। এরা হলেন মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন দল এবং এদের সহযোগী কর্মী ও দাইমা। জেলাগুলো হলো টাংগাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, কুষ্টিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নেত্রকোনা, যশোর, বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, সিলেট, কুড়িগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান।


Dai Ma Meeting


পরিকল্পনা সভার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ভোধন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:১৫ মিনিটে। দৈন্য গানের মাধ্যমে উদ্বোধনের কাজ শুরু হয়। নিয়মিত দৈন্য গানের অনুষ্ঠান ফকির লালন সাঁইজির ‘ধর চরণ ছেড় না দয়াল নিতাই কারও ফেলে যাবে না’ এই গানের মধ্য দিয়ে পরিকল্পনা সভার প্রথম দিনের কাজ শুরু হয়। প্রতিদিন সকালে গোষ্ট গান ও সন্ধ্যায় দৈন্য গান পরিবেশন করা হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত অংশগ্রহণকারীরা বৈচিত্র্যময় গানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। বিশেষ করে পুরোনো দিনের রহিম বাদশা ও রূপবান এর গান -

‘বাড়িরও না দক্ষিণ পাশে গো ও

দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো

আমার দাইমা দাইমাগো’

এই গান যেন সবাইকে সেই পুরোন দিনের রূপবান পালার কথা মনে করিয়ে দেয়।

প্রতিদিন ‘দাইমা বার্তা’ দুই পাতা পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। ‘দাইমা বার্তা’ প্রকাশের জন্য সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করেন হারুন অর রশিদ, ডলি ভদ্র ও আঁখি আক্তার।

পরিকল্পনা সভার শুরুতে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ কার্যক্রমের পরিচালক ফরিদা আখতার ব্যানারে লিখিত পুরো বিষয়টা প্রশ্ন পর্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। তিনি প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে যখন থেকে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে সেই সময় অনুযায়ী তিনটি দলে ভাগ করে ২০১২ সালের জন্য হলুদ, ২০১৩ সালের নীল ও ২০১৪ সালের জন্য গোলাপী রঙ্গের কার্ড দেন। এই কার্ডে সভা থেকে ‘তাদের প্রত্যাশা কি’ তা ১৮ আগষ্ট, ২০১৪ সকালে লিখে জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সকল কার্ডের সারমর্ম করলে দেখা যায় সকলের প্রত্যাশার মধ্যে ‘দাইঘরের স্থায়িত্বের' বিষয়টাই বেশী গুরুত্ব পেয়েছে। দাইঘরের সাথে নয়াকৃষি, নয়াকৃষির সাথে দাইঘর অর্থাৎ দাইঘর, বীজঘর এবং নয়াকৃষি-একই সুত্রে গাঁথা।


Dai Ma


পুষ্টি সংক্রান্ত আলোচনা: পরিকল্পনা সভার মূল আলোচনার বিষয় ছিল পুষ্টি সংক্রান্ত আলোচনা। এ আলোচনার প্রধান দুটি বিষয় যথাক্রমে ‘পুষ্টি পিরামিড’ও 'পুষ্টি থালা' নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ‘পুষ্টি পিরামিড’ শিশুর জন্য, গর্ভবর্তীর জন্য, মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা হতে পারে। পুষ্টি পিরামিড তৈরীর সময় তিনটি দলে ভাগ হয়ে এলাকা ভিত্তিক পুষ্টি থালা সাজানো হয়। পুষ্টি পিরামিড তৈরীর সময় লক্ষ্য রাখতে হবে স্বাদের ভিন্নতা। যেমন তিতা, মিষ্টি, টক, পানসে, ঝাল, নোনা, কষ্টা, বিজল ও আঁশজাতীয় খাদ্য। পুষ্টি সংক্রান্ত আলোচনায় পুষ্টি পিরামিড অনেক গুরুত্ব পায়। পুষ্টি পিরামিড সাজানোর সময় মৌসুম ভিত্তিক শাকসবজি ও ফলের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। একই সাথে বাংলাদেশের কোন এলাকায় কোন মৌসুমে কি শাক সব্জি পাওয়া যায় সে বিষয়টি খেয়াল করতে হবে। এছাড়া অংশগ্রহণ কারীরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে খাদ্যের তালিকা তৈরী করেন।


Pusti Piramid


বয়স, শারীরিক অসুস্থতা, এবং খাদ্যের প্রাপ্ততা বিচার করে পুষ্টিগুন সম্পন্ন খাদ্য ও পথ্য তালিকা তৈরির জন্য অংশগ্রহণকারীদের তিনটি দলে ভাগ করা হয়। 

প্রথম দল আর্থ সামাজিক অবস্থা অনুসারে খাদ্যের তালিকা করা।

দ্বিতীয় দল ছিল দাইমাদের পুষ্টির দিক থেকে বয়স ও বিশে অবস্থায় খাদ্যের তালিকা।

তৃতীয় দল পুষ্টির দিক থেকে কোন রোগ থাকলে খাদ্যের ভাগ।

পরিকল্পনা সভার মূল আকর্শন ছিল দাই সংলাপ। প্রতিদিন রাতে দাই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

প্রথম দিনের বিষয় ছিল, দাইঘরের সেবা, সংলাপের সঞ্চালক ছিলেন রবিউল ইসলাম চুন্নু, প্যানেলে ছিলেন কাউসার পারভীন, বরিশাল, ডলিভদ্র কুষ্টিয়া, রোকেয়া খানম টুলু, টাংগাইল, মির্জা তাহমিনা আক্তার, যশোর।

দ্বিতীয় দিনের বিষয় ছিল দাইঘর স্থাপন। প্যানেল আলোচক ছিলেন মির্জা তাহমিনা আক্তার, যশোর, রুবেল মিয়া, চিলমারী, মেহেরুন নেছা মমতাজ, কক্সবাজার, সাইদা ইয়াসমিন, কুড়িগ্রাম।

ভিডিও প্রদর্শন: অনুষ্ঠানের মধ্যে সোমালিয়া, লাইবেরিয়া, বাংলাদেশ ও নেপালের ৪টি মায়ের স্বাস্থ্যের উপর ভিডিও দেখানো হয়। এই ভিডিও প্রদর্শন উপস্থিত সকলের জন্য গুরুত্ব বহন করে। আমাদের দাই ঘরের সেবা দানের সাথে সোমালিয়া, লাইবেরিয়া ও নেপালের ভিডিও এর মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন-

১. দাইমাদের সেবা

২. গর্ভবতী নারীর ৫টি ঝুঁকি চেনা

৩. রোগীর সাথে দাইমাদের অন্তরঙ্গতা

৪. নয়াকৃষি / প্রাণবৈচিত্র্য

৫. আমাদের দাইঘরে বিশেষভাবে আছে যেমন-ভ্যান এ্যাম্বুলেন্স, নৌকা এ্যাম্বুলেন্স, দাইদের নির্দিষ্ট বসার স্থান, দাইদের সেবা প্রদানের ডকুমেন্টটেশন।

দাইঘরের সফলতা: দেশের ১৩টি জেলায় মোট ২৫টি দাইঘর গত দুই বছরে প্রায় ২লক্ষ এর উপর নারী ও শিশুকে স্বাস্থ্য সেবা, খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে পরামর্শ প্রদান করেছে। এর মধ্যে থেকে ৩ হাজারের উপর নারী ও শিশুকে নিকটবর্তী সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রেফার করা হয়েছে।

বিভিন্ন দাইঘরের কাজের সফলতা ও সেবার পরিসংখ্যান ফ্লিপচাটে করে পরিকল্পনা সভার চারিদিকে লাগান হয়। অংশগ্রহণকারীরা ৭টি দলে ভাগ হয়ে গত ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চলমান সেবার ক্ষেত্রে নাম্বার এর মাধ্যমে মূল্যায়ন করেন। এই মূল্যায়নে ১০ এর মধ্যে ৯ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থানে আছে পাবনা ও নাটোর জেলার দাইঘর। আট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে বান্দরবান, কুষ্টিয়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দাইঘর। সাত নম্বর পেয়ে তৃতীয় স্থানে আছে কক্সবাজার, টাংগাইল এবং কুড়িগ্রাম জেলার দাইঘর।

মূল্যায়নের মানদণ্ড ছিল-

১. ভাল সেবা (সেবার সংখ্যা)

২. এলাকায় কমিউনিটি মিটিং ও মায়েদের সভা

৩. দাইঘরের আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠার চেষ্টা।

সভার তৃতীয়দিন

সভার তৃতীয়দিনে উবিনীগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিশিষ্ট লেখক ও কলামিষ্ট ফরহাদ মজহার পরিকল্পনা সভায় উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের বাংলাদেশের নারী ও শিশু স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে নিরলস ভাবে কাজ করে যাবার জন্য অভিন্দন যানান। তিনি একই সংেগ আধুনিক শিক্ষা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের দাইমাদের লোকায়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রতি অস্বীকৃতি, অবহেলা ও অসম্মানকে তীব্র সমালোচনা করেন।

ফরহাদ মজহার দাইমাদের উদ্দেশ্যে গুরুত্ব সহকারে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন তা হলো

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা মানুষের শরীর চুরি করে। দাইমাদের কাজ হচ্ছে চোর ধরা--এর মাধ্যমে তিনি বলেন যে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষের শরীর কোনো অবস্থাতেই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষের অনুভুতি, ভালোলাগা কিম্বা মন্দ লাগার কোনো মূল্য নেই। শরীর হয়ে পড়ে কেবলই ওষুধ ও প্যাথলজি নির্ভর। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় ডাক্তারা বলে তোমার শরীর তুমি বুঝ না। এ প্রসং্গে ফরহাদ মজহার সভার উদ্দেশ্যে বলেন,

১. আমরা জানি আর দাইমারা জানে না এই যে ব্যবধান সেটা দুর করতে হবে,

২. কোন সমস্যায় পড়লে সরল ভাবে আলোচনা করতে হবে,

৩. প্রয়োজনের উপলব্ধি করাটা অতি জরুরী,

৩. সাংগঠনিক কাজ বাড়ানো।

৪. দাইমাদের জ্ঞানকে আরো বৃদ্ধি করা অতি প্রজনীয় কাজ,

৫. দাইমাদের সঙ্গে দাইমাদের সম্পর্ক মজবুত করা।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter