দেশী মাছ চাষ? নয়াকৃষি করুন


বাংলাদেশ নদী প্রধান দেশ, খাল বিলের দেশ। বাংলাদেশ মাছের দেশ। কিন্তু বর্তমানে মাছের বাজারে স্থানীয় জাতের মাছ পাওয়া যায় না। চাষের মাছে বাজার ভর্তি। বাজারে অল্প বিস্তর স্থানীয় মাছের দেখা মিললে কি হবে দাম আকাশ ছোঁয়। এ রকম অবস্থায় সাধারণ ক্রেতা স্থানীয় মাছের ধারে কাছে ভিড়তেই পারে না। আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা, সারা ইউরোপ মহাদেশে যে পরিমাণ মাছের জাত রয়েছে তার তুলনায় অনেক বেশি মাছের জাত বাংলাদেশে রয়েছে; যদিও বর্তমানে স্থানীয় জাতের বহু মাছ বিলুপ্তির পথে। স্থানীয় মাছের মধ্যে ছোট মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। স্থানীয় ছোট মাছের মধ্যে রয়েছে- পুঁটি, মলা, বাতাশী, চান্দা, দারকিনা, খলিশা, বৌমাছ, আনজু, বাঁশপাতা, টেংরা, ইত্যাদি। এসব ছোটমাছ পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় সাধারণত ৬.২৫ সে.মি. আকারের হয়ে থাকে। ছোট মাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। পুষ্টিমানের দিক থেকে ছোট মাছের অবদান উল্লেখযোগ্য। চোখের জন্য তো ছোট মাছ খুবই উপকারী।


টাংরা মাছ


ছোট মাছ ছাড়াও অন্যান্য স্থানীয় মাছের মধ্যে রয়েছে- পাবদা, শিং, কৈ, বাচা, সোল, টাকি, বাইলা, বাইম গুতম, গুচি, একঠোটা, চেলা ইত্যাদি। বর্তমানে এসব স্থানীয় মাছের যে দূর্দশা এবং এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামিতে স্থানীয় মাছ পাওয়া যাবে কিনা বলা মশকিল। এ দূর্দশা অনেকেই মনে করছেন স্থানীয় মাছের, প্রকৃত অর্থে এ দূর্দশা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল মানুষের। কেননা, প্রাণবৈচিত্র্যই হচ্ছে মানুষের টিকে থাকার একমাত্র উপায়। এর বিকল্প নেই। প্রাণবৈচিত্রের মধ্যে বাংলাদেশের মিঠা পানির স্থানীয় মাছ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। বর্তমানে সারা দেশব্যাপী স্থানীয় তথা ছোট মাছের যে সংকট ও দূরবস্থা বিরাজ করছে; এর থেকে পরিত্রাণের হয়তো অনেক পথের কথা বলা যেতে পারে। তবে পরিবেশ-প্রতিবেশ প্রকৃতি মানুষের জীবন-জীবিকা তথা স্থিতিশীল খাদ্য-সার্বোভৌমত্বেও দৃষ্টিকোণ থেকে একমাত্র নয়াকৃষি পদ্ধতিতেই স্থানীয় প্রজাতির মাছসহ সকল জলজ-স্থলজ সকল সম্পদ রক্ষা ও বিকাশত করা অনায়াসে সম্ভব।

স্থানীয় জাতের মাছ হারিয়ে যাবার কারণঃ

বাংলাদেশে স্থানীয় জাতের মাছের সংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনেক কারণের কথা উল্লেখ করা যায়। এখানে স্থানীয় জাছের সংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কারণ পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতে সমাধান করা হলে অবশ্যই বাংলাদেশে স্থানীয় মাছের সংকট থাকবে না। উপরন্ত বাংলাদেশ থেকে স্থানীয় জাতের মাছ রপ্তানী করা সম্ভব হবে। স্থানীয় জাতের মাছের সংকট সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট কারণগুলো হচ্ছে-

১। কৃষিতে ব্যাপক হারে রাসায়নিক বিষ ও সার ব্যবহার।

২। কৃষিতে একাট্টা ফসল চাষাবাদের আগ্রাসণ।

৩। বিদেশী হাইব্রিড এবং উফশী মাছের বাণিজ্যিক চাষাবাদ।

৪। অবকাঠামো (রাস্তাঘাট, ইমারত) নির্মাণের নামে দেশের সর্বত্র নদী, নালা, খাল-বিল ইত্যাদি ভরাট করার কারণে পানিশূন্য করা হয়েছে।

৫। প্রাণবৈচিত্র্যের দৃষ্টিকোণ থেকে স্থানীয় মাছের প্রতি কম গুরুত্ব দেয়া।

৬। জলজ প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করা।

৭। স্থানীয় মাছ সম্পর্কে জনগণের অসচেতনতা।

স্থানী জাতের মাছ ও নয়াকৃষিঃ

গত মার্চ মাসে আমি নয়াকৃষি আন্দোলনের কাজে টাঙ্গাইল জেলার কান্দাপাড়া ও মৌশাকাঠালিয়া গ্রামের নয়াকৃষির কৃষকদের এক আলোচনা সভা বসি। প্রসঙ্গক্রমে সেখানে স্থানীয় মাছের কথা ওঠে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, আপনাদেও গ্রামে কি স্থানীয় জাতের মাছ পাওয়া যায়? উত্তরে কৃষক হালেমা বেগম, শেফালী বেগম, রাবেয়া বেগম, নূরজাহান বেগম, রহিমা খাতুন, হাবিবুর রহমানসহ উপস্থিত কৃষকরা জানান যে, কয়েক বছর পূর্বে যখন গ্রামে রাসায়নিক কৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হতো তখন গ্রাম থেকে স্থানীয় জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছিলো। তখন বর্ষা মৌসুমে বা ঢলের পানিতে তেমন কোন মাছই পাওয়া যেত না। এটা বলছি ১৫/১৬ বছর পূর্বের কথা। আমরা যখন নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করলাম, আমরা ক্ষেতে রাসায়নিক বিষ, রাসায়নিক সার দেয়া একেবারে বন্ধ করে দিলাম। আস্তে আস্তে গ্রামে নয়াকৃষির কৃষকদের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো, এখন আমাদের গ্রামে সিংহভাগ কৃষক নয়াকৃষির সাথে যুক্ত। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের গ্রাম থেকে হারিয়ে যাওয়া স্থানীয় জাতের মাছগুলো ফিরে আসে। আমরা এটা দেখে প্রথমে আবাক হয়েছিলাম। তবে আজ এটা বাস্তব, এদেশে প্রবাদ আছে ‘মাছে ভাতে বাঙ্গালী’। নয়াকৃষির বাদৌলতে আমরা আজ মাছে ভাতে বাঙ্গালী।


খৈলসা


আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মাছে ভাতে বাঙ্গালী’ মানে বুঝতে পারলাম না! তখন নয়াকৃষির কৃষকরা বলেন, আমাদের গ্রামে কৃষিকাজে কোনো রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করা হয় না ফলে, বর্ষা মৌসুমে পানিতে মাছ খেলে। তখন আমাদের মাছ ধরার আনন্দ পেয়ে বসে। গ্রামের নারী-পুরুষ সকলেই কম-বেশি মাছ ধরে খাই। জ্যৈষ্ঠ মাসের বৃষ্টিতে ডোবা, পাগার, খালে পানি জমে, সেখানে আপনা থেকেই চাটা, ইছা, দারকিনা, তিতপুঁটি, চান্দা, খলিশা এসব মাছ পাওয়া যায়, সেসব ধরে খাই। আবার জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ থেকে আষাঢ় মাসে দেখা যায় মলা, ঢেলা, খলশা, চেলা, ডেবরী চেলা, চান্দা, ইছা, বাইলা টাকি, টেংরা ইত্যাদি। আবার মাসের শেষে ঢল নামলে, তখন প্রচুর মাছ পাওয়া যায়, তখন অতিরিক্ত মাছ শুঁটকি বানিয়ে রাখি। এভাবে আমরা বিনা পয়সায় অগ্রহাষণ মাস পর্যন্ত মাছ খেয়ে থাকি। আমরা যাতে অন্যান্য মাসেও মাছ খেতে পারি সেজন্য আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির পাশের খাল, ডোবা, পাগার, যেটাই থাকুক সেখানে মাছসহ পানি সংরক্ষণ কওে রাখি। প্রয়োজন মতো আমরা মাছ ধরে খাই। তাহলে এখন বলুন তো! নয়াকৃষির কৃষকরা কি “মাছে-ভাতে বাঙ্গালী নয়?

স্থানীয় মাছের প্রতি নয়াকৃষির কৃষকদের আগ্রহের কারণঃ

নয়াকৃষির কৃষকদের জীবন ব্যবস্থা, তাদের কৃষি পদ্ধতি, পরিকল্পনা ও কাজের ধরণ যিনি দেখেন নাই তার উপলব্ধিতে আসা কষ্টকর। নয়াকৃষির কৃষকরা শুধু শস্য চাষাবাদ রিয়েই ব্যস্ত থাকেন না। তারা তাদেও দৈনন্দিন কাজের ভেতর দিয়েই সকল প্রাণসম্পদের প্রতিপালন, রক্ষণাবেক্ষণ কওে থাকেন। সে কারণে নয়াকৃষির কৃষকরা শস্যের পাশাপাশি মাছসহ সকল জলজ ও স্থলজ প্রাণসম্পদের প্রতি তাদের নিয়মিত মনোযোগ রয়েছে।


বৌ মাছ


এসব ছাড়াও নয়াকৃষির কৃষকরা যেসব সুনির্দিষ্ট কারণে স্থানীয় ও ছোট মাছের প্রতি আগ্রহী সে সব হচ্ছে-(১) স্থানীয় প্রজাতির মাছ প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশে নিজেদের বংশ বিস্তার করে। ফলে প্রতি বছর পুকুরে বা জলাশয়ে মাছের পোনা ছাড়তে হয় না, ফলে আর্থিক সাশ্রয় হয়। (২) স্থানীয় প্রজাতির ছোট মাছ সব ধরণের জলাশয়ে অল্প সময়ে প্রতিপালন করা সহজ এবং সম্ভব। (৩) এসব মাছ প্রতিপালনের জন্য তেমন কোনো যত্ন পরিচর্যা এবং আলাদা করে খাদ্য দেয়ার প্রয়োজন পরে না। (৪) ছোট মাছে রয়েছে যথেষ্ঠ পরিমাণে আমিষ ও দেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান এ্যমাইনো এসিড। (৫) মলা, পুঁটি মাছে রয়েছে, অধিক পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’। ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। (৬) গর্ভবতী মা ও দুগ্ধ প্রদানকারী মায়েদেও রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে ছোট মাছের অবদান সবচেয়ে বেশি। (৭) ছোট মাছে, রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস ও আয়োডিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। (৮) এসব মাছের বাজার মূল্য এবং চাহিদা সবচেয়ে বেশি। (৯) পানির অল্প গভীরতায় অর্থাৎ এক থেকে দেড় মিটার পারি গভীরতায় ছোট মাছ অনায়াসে প্রতিপালন করা যায়। (১০) প্রতি ৩ থেকে ৪ মাস অন্তর জলাশয় থেকে মাছ তুলে বিক্রয় করা বা নিজে খাওয়া যায়। (১১) গ্রামে গরীব মানুষের পুষ্টি সমস্যার সহজে সমাধান করা যায়। (১২) বর্ষা মৌসুমে যখন ঢলের পানিতে গ্রামের সবাই মিলে একসঙ্গে মাছ ধরার কারণে সামাজিক সুস্পর্ক বৃদ্ধি পায়।

পরিশেষে আমাদেও সবাইকে বুঝতে হবে যে, স্থানীয় জাতের মাছ পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য, জীবন-জীবিকা এবং দেশের খাদ্য সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যিক ভাবে মাছ চাষ করে, মাছের খানিকটা ব্যবসা কওে মুনাফা কামানো যেতে পারে কিন্তু মাছের যে অভাব তার সঙ্গে প্রাণবৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ চক্রের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, সে ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হবে না। এর ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার কোনো না কোনো ভাবে বাংলাদেশের মানুষেরই হবে। এ ব্যাপারে শুধু কৃষক বা জেলেদের সচেতন হলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না, সমাজের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সবার জেনে রাখা দরকার, আমাদের অজ্ঞতা ও অহংঙ্কারকে মহাজাগিতিক শক্তি বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter