দূর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন: কৃষকের চাষাবাদ ব্যবস্থা ও অভিজ্ঞতা


দূর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রেক্ষাপট

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রাণসম্পদে সমৃদ্ব দেশ বাংলাদেশ। সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিতে মাঝে মাঝে প্রকৃতির ছন্দপতন যেমন: অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ঘনকুায়াশা ইত্যাদি বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এই প্রতিকূল আবহাওয়াকে গতানুগতিক ভাষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন বলে অভিহিত করা হয়। এমনি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবারের বন্যা। প্রায় দশ দিন ব্যাপী এই বন্যার স্থিতিকাল ছিল ১০ই ভাদ্র ১৪২১বাংলা থেকে ২০ভাদ্র ১৪২১বাংলা। বাংলাদেশের উত্তরে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশিচম বংগের মালদহ অঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতের পানি উজান থেকে নেমে এসে বাংলাদেশের ভারি বৃষ্টিপাতের সাথে মিশে এবারের বন্যার তীব্রতা বাড়ায়। অসময়ে হঠাৎ এবং দ্রুত পানি বৃদ্বির কারণে বন্যার সংগে সহবস্থানের ক্ষেত্রে বানভাসি মানুষরা কিছটা বিপাকে পড়ে। প্রকৃতির এই খামখেয়ালীপনা ও বানভাসী মানুষর ভোগান্তি নিছকই প্রৃকৃতির নিজস্ব কারণে ঘটেনি। এর সাথে যুক্ত রয়েছে বৈষিক উষ্ণতা বৃদ্বি, বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ, অপরিকল্পিত সড়ক, নগরায়ন, কালবার্ট, ব্রীজ, স্লুইসগেটসহ তথাকথিত কিছু উন্নয়ন অবকাঠামোর নেতিবাচক প্রভাব। ফলে সংগত কারণেই বন্যা তার সহজাত স্বভাবসিদ্ব রূপ থেকে ছিটকে গিয়ে কৃত্রিমতার স্বীকার হয়।

হিমালয় ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশের ক্রমোধগতি ভারসাম্যহীনতা কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, ভারত, নেপাল, ভূটান এমনকি চীনের একাংশের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা নদীর জলস্রোতের মাধ্যমে বাহিত বিপুল পরিমান পানি একদিকে যেমন অববাহিকা অঞ্চলের জমির উর্বরতা বাড়ায়, তেমনি পলি জমি নদীর তলদেশ ভরাট করে নদীগুলোর পয়নিস্কাসন ক্ষমতা হ্রাস করে। গড়ে বছরে ০.৭৭ বিলিয়ন মেট্রিক টন পরিমান পলি প্রধান এই তিনটি নদীর মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সমুদ্রে পতিত হয়। নব্যতা হারিয়ে নদীনালা ও খালবিল, হাওর উজানের পানি বহন তো বটেই দেশের অভ্যন্তরের বাড়তি বৃষ্টিপাতের পানিও বহন করতে পারছে না। পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা নদীর মাধ্যমে ১.৭২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার পানি নিষ্কাষিত হয়। অথচ এরমাত্র ৭ ভাগ এলাকা বাংলাদেশে অবস্থিত। বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত পানির ৯০ শতাংশই আসে উজানের দেশগুলোর মাধ্যমে। একারণে বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রন এবং পানি ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদী ও সামগ্রীক কোন পরিকল্পনা রুপায়নে অববাহিকা অঞ্চলের দেশগুলোর পারষ্পরিক সহযোগিতা আবশ্যক। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সামগ্রীক ও আঞ্চলিক পরিকল্পনার জন্য স্থানীয় উদ্যোগ থেমে নেই। দূর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহন ও অনুশীলন হচ্ছে।

দূর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় স্থানীয় উদ্যোগ

টাংগ্ইালের দেলদুয়ার উপজেলার উবিনীগ রিদয়পুর বিদ্যাঘরে ১৫ সেপটেম্বর, ২০১৪ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতি মোকাবেলা ও রক্ষায় কৃষকের জ্ঞান ব্যবহার ও সামাজিক কর্মকৌশল বিষয়ক দিন ব্যাপী একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, কৃষক ও উন্নয়ন সংগঠনসহ মোট ৪৭জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। দূর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রসংগে সাম্প্রতিক বন্যার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। নয়াকৃষি (প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা) কৃষকরা জানান, এবারের বন্যা শুরু হয় ১০ই ভাদ্র এবং বন্যা শেষ হয় ২০ভাদ্র ১৪২১বাংলা। বর্ষাকালের পর শরৎকালের অসময়ের এই বন্যা কৃষকসহ সকলের নিকট ছিল সংগতকারণেই অপ্রত্যাশিত। ফলে বন্যা কবলিত এলাকায় আবাদী জমির ফসল ও বসতভিটার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কমবেশী সকলের।

টাংগাইল কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এবারের বন্যায় টাংগাইলে মোট ২৭,৪৫৪ হেক্টর আবাদী জমির ফসল হয়েছে। এর মধ্যে আমন ধান ২০,৩৮০ হেক্টর, আউশ ১০৭০ হেক্টর, আমন ধানের চারা ৬৫৩.৫ হেক্টর, শাকসব্জি ২০২ হ্ক্টের, কলা ৭১ হেক্টর, লেবু ২২.৫ হেক্টর এবং ৪৫ হেক্টর।

কৃষকদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী মাঠের ফসলের মধ্যে প্রধানত ছিল আমন ধান, আউশ ধান, শাকসব্জি, পাট ও লেবু। অসময়ের বন্যা সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে স্থানীয় জাতের আমন ধানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কম। এরমধ্যে চামারাদিঘার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মাত্র ৫ -১০%, হিজলদীঘার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০%, পাটজাগ, ময়নাগিরি, বরন, ঢেপা জাতের আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে গড়ে ৫০%। স্থানীয় জাতের আউশ ধান যেমন: কালামানিক, ভাতুরী, ষাইটা, কালাবকরী, ভইরার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০%। কৃষকারা জানান মাসখানিক আগে এই বন্যা হলে স্থানীয় আমন ধানের কোন ক্ষতিই হতো না। কারণ এই স্থানীয় জাতের আমন ধানগুলো বন্যা সহনশীল। অসময়ের এই বন্যার সময় স্থানীয় জাতের আমন ধানগুলোর শীষে ফুল আসছিল বলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বেশী হয়েছে। পক্ষান্তরে প্রবর্তনকৃত জাত যেমন বিআর ১১ও বিআর ৩৯ জাতের ধান ১০০ % ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্ষাকাল শেষ হওয়ার কারণে কৃষকরা ভাদ্রমাসের শুরুতে আগাম শাকসব্জি আবাদ করেছিল এবং আবাদী জমির এই শাকসব্জির প্রায় শতভাগই নষ্ট হয়েছে। তবে বসতবাড়ীতে লাগানো শাকসব্জির প্রায় ৮০ ভাগই টিকে গেছে।

বন্যায় কৃষকদের মাঠের ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হলেও ঘরে সংরক্ষিত বীজভান্ডার তারা সযতেœ রেখেছিলেন সমুন্নত ও সমৃদ্ব। ফলে বন্যার অব্যবহিত পরর্পই কৃষকরা তাদের বীজভান্ডারে সংরক্ষিত বীজ দিয়ে পরবর্তী চাষের পরিকল্পনায় নেমে পড়েছেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কৃষকরা নিজেদের মধ্যে বীজ বিনিময়ের অনুশীলনও করছেন। কৃষকরা জানালেন, ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে আউশ ও আমন ধানের মৌসুম শেষ হওয়ার কারণে দানাদার খাদ্যের ঘাটতি মিটানোর জন্য বোরো ধান, গম, কাওন ও মিাষ্ট আলুর চাষ তারা বেশী করে করার পরিকলপনা করেছেন। শাকসব্জির বীজ এরই মধ্যে তারা জমিতে দিয়েছেন এবং কেউ কেউ শাক তুলতেও শুরু করেছেন। বন্যার এবারের ক্ষয়ক্ষতি ও অভিজ্ঞতা আমাদের আবারো শিখাল যে কোন দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় স্থানীয় জাত ও কৃষকের জ্ঞান কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

নয়াকৃষির কৃষকরা জানালেন, তারা তাদের সুদীর্ঘ দুই দশকের নয়াকৃষি অনুশীলন ও অভিজ্ঞতার আলোকে স্থানীয় জাতের অনেক ফসল সংরক্ষন ও পুনরুদ্বার করে তাদের চাষের আওতায় নিয়ে এসেছেন। একই সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বন্যা, খরা, অতি কুয়াশা ইত্যাদি দুর্যোগে খাপ খাওয়ানো স্থানীয় জাতের ফসল নির্বাচন করে নয়াকৃষি পদ্বতিতে করছেন।

বন্যা সহিষ্ণু ধানের জাতগুলোর মধ্যে প্রধানত রয়েছে চামারাদিঘা, হরিংগাদিঘা, লালঢেপা, ঝুলধান, সাদাঢেপা, বরন, কইতরমনি, শামুভাঙ্গা, পাটজাগ, সাদা বরন, সাদা দিঘা, নলজ, হিয়ালী বরন ইত্যাদি।

খরা সহিষ্ণু ধানের জাতগুলোর মধ্যে কৃষকদের চাষের আওতায় রয়েছে ময়নাগিরি, পাটজাগ, কাইকা, মানিকদিঘা, পাতিশাইল, কালামানিক, ভাতুরী, লোহাচুর, করচামুড়ি ইত্যাদি। এছাড়া তিল, তিষি, আদা, হলুদও খরায় ভাল হয় বলে কৃষকরা জানান।

হাজার বছর ধরে বাংলাদেশর গ্রামীণ জনগোষ্ঠি বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির সাথে সহবস্থানের মধ্য দিয়ে এলাকার সাথে খাপ খাওয়ানো বিভিন্ন জাতের ফসল বাছাই করেছেন। সুদীর্ঘকালের পরীক্ষা নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদেরকে দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের পবিবর্তিত অবস্থার সাথে অবস্থান করাই ইতিবাচক হবে।

 


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter