মাটির গুণে মানুষের স্বাস্থ্য


খাদ্য মানব স্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাদ্য নিরাপত্তা অজির্ত হয় তখন যখন সব মানুষের সার্বক্ষণিক ভাবে পর্যাপ্ত, নিরাপদ, পুষ্টি সমৃদ্ধ, সামাজিক ও ঐতিহ্যগতভাবে গ্রহণযোগ্য খাবারের সরবরাহ অর্থনৈতিক ভাবে প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়। একদিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অন্য দিকে বাড়তি জনগণের বাড়ি ঘর, রাস্তা-ঘাট, শিল্প কারখানা নির্মানসহ নানা কাজে আবাদি জমি চলে যাচ্ছে। তাছাড়া যান্ত্রিক চাষাবাদ, রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, ভূগর্ভস্থ পানি দ্বারা সেচের ফলে মাটি বিষাক্ত ও অবক্ষয় হচ্ছে। তাই আজ এবং ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপদ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে কৃষি জমি অ-কৃষি কাজে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। মাটির সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যথেচ্ছ রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, মাটির তলার পানি ব্যবহার করে সেচ, চিংড়ী চাষের জন্য লোনাপানি ভূপরিভাগে তুলে আনাসহ যাবতীয় ভূমিক্ষয় বন্ধ করা প্রয়োজন। আমরা সাবাই জানি যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাটির গুরুত্ব অপরিশিম। তবে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতেও যে মাটির স্বাস্থ্য কত গুরুত্বপূণ সে বিষয় আমরা প্রায় উদাসীন বলা যায়। মানব স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সবকটি মৌলিক উপদানের উৎস মাটি। আবাদি ফসল, অন্যান্য গাছপালা এবং প্রাণীজ উৎস থেকে আমরা এ সব উপাদান পাই।

মাটি আবার নানা ভাবে মানব স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করতে পারে। মাটিতে বিদ্যমান ভারী রাসায়নিক উদার্থ গাছ স্বাভাবিক খাদ্যগ্রহণ প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করে এবং ও গাছের ফলমূল সে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে আত্মস্ত করে। তাছাড়া মাটি ও ধূলার সাথে নানা রকম বিষাক্ত পদার্থ ও রোগজীবানু শ্বাস প্রশ্বাস ও খোলা খাবারের সাথে মানব দেহে প্রবেশ করে স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং মাটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য সাবির্কভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মানব স্বাস্থ্য:

মানব স্বাস্থ্য একটি পরিপূর্ণ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা বুঝায়। যা শুধু মাত্র রোগমুক্ত বা দুর্বলতা মুক্ত অবস্থাই বুঝায় না (ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলি-১৯৪৮)। নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং শরীর চর্চার মাধ্যমে শারীরিক সুস্থতা অর্জন করা যায়।

মানব স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য মাটির উপাদান:

মাটিতে বিদ্যমান ১৪টি মৌলিক পদার্থ যা গাছপালার বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য তার মধ্যে আছে: নাইট্রোজেন, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, সালফার, আয়রণ, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, বোরন, ক্লোরিন, মলিব্ডেনাম এবং সোডিয়াম। এছাড়া আরও পাঁচটি পদার্থ সব গাছপালার জন্য প্রয়োজনীয় নয় তবে কোন কোন গাছের জন্য প্রয়োজন। তার মধ্যে আছে কোবাল্ট, ব্রোমিন, ভ্যানাডিয়াম, সিলিকন এবং নিকেল। মাটিতে বিদ্যমান পদার্থ ছাড়াও বাতাস ও পানি থেকে পাওয়া তিনটি পদার্থ যেমন- হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং কার্বনও গাছ পালার জন্য অপরিহার্য। এ সব পদার্থের অধিকাংশ মানব স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন।

উপরোল্লিখিত পদার্থগুলির মধ্যে ১১টি মানব দেহে প্রাপ্ত পরমানুর ৯৯. ৯% গঠন করে। এ গুলিকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায় যথা-মুখ্য এবং গৌন। চারটি মুখ্য পদার্থ যেমন হাইড্রোজেন, অক্লিজেন, কার্বন এবং নাইট্রোজেন প্রায় ৯৯% শরীর গঠন করে এবং সাতটি গৌণ পদার্থ যথা সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, সালফার এবং ক্লোরিণ প্রায় ০.৯% শরীর গঠন করে।

মুখ্য এবং গৌণ পদার্থগুলি ছাড়া আরও ১৮টি পদার্থ যা মানব দেহের জন্য সামান্য পরিমাণ প্রয়োজন তার মধ্যে আছে লিথিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, ক্রমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রণ, কোবাল্ট, নিকেল, কপার, জিঙ্ক, টাংষ্টেন, মলিব্ডেনাম, সিলিকন, সেলেনিয়াম, ফ্লোরিণ, আয়োডিন, আর্সেনিক, ব্রোমিন এবং টিন। ২৯টি মৌলিক পদার্থ মানব স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। সুতরাং যে মাটি গাছ পালা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক পদার্থ সরবরাহ করে তা পরিনামে মানব দেহের জন্যও প্রয়োজনীয় উপাদান ও সরবরাহ করতে সক্ষম।

মাটির পুষ্টি ভারসাম্যহীনতা ও মানব স্বাস্থ্য:

মাটিতে মৌলিক পদার্থের ঘাটতির ফলে মারাত্মক মানব স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন মাটিতে আয়রণ ঘাটতি থেকে মানব দেহে রক্ত শূন্যতা, আয়োডিন ঘাটতি থেকে গলগন্ড, জিঙ্ক ঘাটতি থেকে স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে বেটে হওয়া (হাইপোগোনাডিজম) এবং সেলেনিয়াম ঘাটতি থেকে ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার

মাটিতে জৈব পদার্থের অভাব থেকে গাছপালায় অনুখাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। পরিণামে মানব দেহে ঘাটতি জনিত রোগ দেখা দেয়। মাটিতে ৪-৫% জৈব পদার্থ থাকা বাঞ্চনীয়। অথচ বাংলাদেশের মাটিতে গড়ে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১% এরও কম। অনুখাদ্যের ঘাটতি সমস্যায় জর্জরিত মাটিতে ফসলের উৎপাদান যেমন কম হচ্ছে তেমনি ফসলে অনুখাদ্যের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অষ্টিওপোরোসিস, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, এনিমিয়া, ডায়োরিয়া, গলগন্ড সহ নানা রকম ঘাটতি জনিত রোগ দেখা দিচ্ছে। মানষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। মানুষের খাদ্য অনুখাদ্যে পরিমাণ বাড়াতে মাটিতে জৈব পদার্থ বাড়াবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি মাটিতে প্রয়োজনীয় ২৯টি মৌলিক পদার্থের সমন্বিত সরবরাহ নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter