পাঁচবাড়িয়া গ্রামের কৃষক পাট চাষে খুশি


এখন বর্ষা মৌসুম। শ্রাবণ মাস। অনেকে বলছে এবারের বৃষ্টি সারা বাংলাদেশে বেশী হচ্ছে। বর্তমানে ধান চাষের আমন মৌসুম চলছে। গ্রামের অনেক এলাকায় কৃষকেরা চিন্তিত। নীচু এলাকায় ধান লাগাতে পারছে না অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে। উচু জমিতে ধান লাগান হয়ে গেছে। ধানের জমিতে এখনও অনেক পানি। যে সব নীচু জমিতে ধান বোনা হয়েছিল তা এখন পানির নিচে। আবার এর বিপরীত দৃশ্যও গ্রামে আছে। এবারে পাট চাষীদের ‘পাট জাগ’ দেওয়া নিয়ে কোন দুঃচিন্তা নাই। অনেক এলাকার পাট চাষীরা বেশ খুশি। বৃষ্টি হওয়াতে।

এখন পাট কাটার মৌসুম

এবারে পাটের লীলা খেলা হচ্ছে” বললেন, পাঁচবাড়িয়া গ্রামের রাজিয়া বেগম। বয়স প্রায় ৫০ এর কোঠায়। পাটের আঁশ তোলার কাজে অতি ব্যস্ত রাজিয়া। দাপুনিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম পাঁচবাড়িয়া। উপজেলা, পাবনা সদর। জেলা পাবনা। এখন পাঁচবাড়িয়া গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বাড়ির মহিলারা পাটের আঁশ তোলার কাজে ব্যস্ত। এই কাজকে এলাকায় বলে ‘কোষ্টা ছুলা’। যেখানেই পাট জাক দেওয়া হয়েছে সেখানেই একটু শুকনা জায়গায় মহিলারা আঁশ তুলতে বসে গেছে।


পাট


পাট আঁশ তোলার হিসাব

মহিলারা কুড়ি আঁটি (প্রায় ৫০-৬০টি পাট গাছ নিয়ে একটি আঁটি হয়) পাট ছুললে ১০০ টাকা পায়। পাট শলা নিবে মালিকেরা। আর ছুলা পাট ধুয়ে দেয় পুরুষেরা। ছুলা পাট ধুতে পুরুষেরা দিনে মজুরী নেয় ৩০০-৩৫০ টাকা। পুরুষেরা সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ছুলা পাট ধোয়ার কাজ করে। পুরুষেরা পাট তুলে যদি ধুয়ে দেয় তাহলে মজুরী বেশী নেয়। আর মহিলাদের দ্বারা পাট ছুলার কাজ করলে কৃষকদের খরচ কম পরে। সাধারণত মহিলারা পাটের আঁশ তুলতে যায় সংসারের কাজ শেষ করে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১:০০টা পর্যন্ত পাট তোলার কাজ করে। তারপর আবার সংসারের কাজ। এই ৪-৫ ঘন্টায় তারা পাট ছুলতে পারে ২৫-৩০ আঁটি। তারা মনে করে সংসারের কাজও হলো, আবার কিছু বাড়তি আয়ও হলো। কিন্তু ছেলের বউয়ের থেকে শাশুড়ী পরিমাণে বেশী পাট ছুলতে পারে। শাশুড়ীর সংসারের কাজ তেমন করতে হয় না। তাই তারা সকাল ৭টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত পাট ছুলার কাজ করে থাকে। পাট ছুলার কাজ বেশ কঠিন। যদি অভিজ্ঞতা না থাকে। পাটের লম্বা আঁশ ঠিকভাবে তুলতে হবে যেন জড়িয়ে না যায়। পাট ছুলতে ছিঁড়ে ফেললে মজুরী পাওয়া যাবে না।


পাট


ভাগীতে পাট ছুলা

বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে গরু-ছাগল- আধি, বর্গা বা ভাগীতে গ্রামের মানুষ লালন-পালন করে। আধি মানে অর্ধেক অর্ধেক। যে লালন-পালন করে তার অর্ধেক, যার গরু বা ছাগল তার অর্ধেক। পাঁচবাড়িয়া গ্রামে পাট ছুলার ক্ষেত্রেও মহিলারা অনেকে ভাগীতে পাট ছুলে। যত পাট ছুলতে পারবে তার অর্ধেক শলা বা পাটকাঠি মালিক পাবে বাকি অর্ধেক পাবে যে ছুলছে সে। মহিলারা বলে, ‘ভাগীতে পাট ছুললে লাভ বেশী। বাজারে পাট শলার দাম আছে। ঘরের বেড়া দেওয়া যায়। জ¦লানো যায়। এখন সীমের ক্ষেত করবে চাষীরা। সীম গাছের জাংলা দিতে লাগবে। পাট শলা যার নাই আমাদের কাছ থেকেই কিনতে হবে তাদের। এক আঁটি (১০-১৫টা) পাট শলার দাম ২০ টাকা।’

গত বছর পাটের দাম ভাল পাওয়াতে এবারে গ্রামের সব চাষীরা পাট চাষ করেছে। আর পাট জাক দেওয়ার জন্য পানির অভাব নাই। কৃষকেরা পাট কেটে নিজ জমিতেই জাক দিচ্ছে। পাট জাক দেওয়ার জন্য টাকা খরচ করে দূরে নিতে হচ্ছে না। কাছেই পানি। এবারে পাটের ফলন হয়েছে ভাল। এই এলাকায় সবাই তেষা পাটের আবাদ করেছে। মিষ্টি পাট। সবজি হিসাবে খাওয়াও যায়। ছাঁচি (দেশী পাট) পাটের উৎপাদন এখানে নাই। তোষা পাটের শলা শক্ত হয়। ঘরের বেড়া ভাল হয়। তোষা পাটের চাহিদা এখানে বেশী।

পাটের বাজার দর


পাট


পাটের বাজার দর সবসময় এক রকম থাকে না। এবারে সরকারের নির্ধারিত বাজার দর ছিল তোষা পাট মণ প্রতি ২২০০.০০ টাকা। কিন্তু বাজারে এখন সবচেয়ে ভাল তোষা পাটের দাম চলছে মণ প্রতি ১৫০০.০০ টাকা। পাটের মূল্য নির্ধারণে সরকারের নির্ধারিত বাজার দর বেশীরভাগ সময় কার্যকরী হয় না। কিছু ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্যভোগী রয়েছে যারা পাটের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এরা কৃষক নয়। এদের নিজস্ব কোন জমি নাই। এরা এক এলাকা থেকে পাট কিনে অন্য জায়গায় বিক্রি করে। গ্রামের বিভিন্ন পাটের বাজারে এদের বিচরণ এবং আধিপত্ত। এরা ব্যবসায়িক স্বার্থ চরির্থাত করার জন্য কৃষকদের বঞ্চিত করে। এই ব্যবসায়ী নামধারী মধ্যস্বত্যভোগীদের র্নিমূল করতে পারলে প্রকৃত পাট উৎপাদনকারী কৃষকেরা তাদের ন্যায্য পাওনা ফিরে পাবে। কৃষককের পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কার্যকর ভূমিকার প্রয়োজন। সরকারী ক্রয় কেন্দ্রে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পাট ক্রয়ের ব্যবস্থা করা অতি জরুরী।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter