বিশ্বায়নের প্রভাবে খাদ্য অনিরাপদ হচ্ছে


খাদ্যে ভেজাল একটি প্রাচীন সমস্যা। বহুকাল থেকে চলে আসছে। কিছু কাল আগেও পাটীগণিতে অংক ছিল একমণ দুধে পাঁচ সের পানি মিশিয়ে ক্রয় মূল্যে বিক্রি করলে সের প্রতি কত লাভ হবে? তবে সময়ের সাথে ভেজালের ধরণ পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা ভাষায় সব ধরণের অবাঞ্চিত মিশ্রণকে ভেজাল বলা হয়। তবে ভেজাল বুঝাতে ইংরেজিতে দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয় যেমন: Adulteration (ভেজাল বা স্থুল ভেজাল ) এবং Contamnination (সূক্ষ্ম ভেজাল)। পূরাতন পদ্ধতির ভেজাল যেমন দুধের মধ্যে পানি, গরুর গোশতে পানি ছিটানো ইত্যাদি এখনও চালু আছে। তবে বিশ্বায়নের প্রভাবে সূক্ষ্ম ভেজালের পরিধি বেড়েছে। যেমন ২০০৮ সালে চীনে দুধে মেলা মাইন ভেজালের ফলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার শিশু হাসপাতালে ভর্তি এবং অনেকের অকাল মৃত্যু ও হয়েছিল। বিশ্বায়নের ফলে দুধে মেলামাইনের ভয়াবহতা শুধু চীনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দক্ষিন এশিয়া তথা সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছিল।

সূক্ষ্ম ভেজাল বা কন্টামিনেশনের সাথে বিশ্বায়নের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। সূক্ষ্ম ভেজালের মূল উপাদান তিনটি যেমন লবন, চিনি এবং চর্বি। এ তিন উপাদানে তৈরী খাবার দীর্ঘ সময় সংরক্ষণে সহায়তা কারে, স্বাদ বাড়ায়, প্রক্রিয়াজাত করণের খরচ কমায় এবং বাজারজাত করণে সুবিধা হয়। বাজার প্রসারিত হয় এবং লাভ বেশী হয়। খাদ্য দ্রব্য দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের ক্ষেত্রে লবন এবং চিনির ব্যবহার বহু পূরানো। তবে বিশ্বায়ন তথা বিশ্ব বাণিজ্য প্রসারের ফলে শিল্প ভিত্তিক উৎপাদন বহুগুন বেড়েছে।

সুপার মার্কেট চেইনে জাঙ্ক ফুড বা ফাষ্ট ফুড তালিকায় উল্লেখযোগ্য তৈরী খাবার যেমন পোষ্ট্রি, কেক, হট ডগ, বার্গার, পিজা, বিস্কুট, কুকি, ক্যান্ডি, ডোনাট, বাটারবন, পাউরুটি, বন, পানকেক, পটেটো চিপস, কর্ন চিপস, পাপকর্ন, ইন্সট্যান্ট নুডল, চকলেট বার, ইত্যাদিতে আছে কার্বোহাইড্রেট, চর্বি, চিনি এবং লবন। আছে উচ্চ মাত্রায় কেলোরি। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য আমিষ, খনিজ লবন, আঁশ ও ভিটামিন। বোতলজাত ফলের রস যেমন আপেলজুস, ম্যাঙ্গোজুস, কমলালেবুর রস, ট্যাং এবং অন্যান্য ফলের রস, নাম সর্বস্ব এসব বোতলে মূলতঃ আছে চিনি, মিষ্টিজাতীয় আরো কিছু রাসায়নিক এবং বিশেষ বিশেষ ফলের কৃত্রিম সুগন্ধি। এ সব রংয়ের বেশির ভাগই কাপড়ে রং করার জন্য ব্যবহৃত রং। মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক বিষ। আইসক্রিম, দই এবং দুগ্ধজাত অন্যান্য খাবারের মধ্যেও অতি মাত্রয় চর্বি এবং চিনি রয়েছে। কোমল পানীয় হিসাবে বোতল জাত যেসব সুদর্শন আইটেম পাওয়া যায় এর মধ্যেও আছে পোড়া চিনি, প্রিজারভেটিভ এবং রং। কোমল পানীয়, ফলের রস, আইসক্রিম ইত্যদির মধ্যে বিশেষ বিশেষ সুগন্ধি যেমন ভ্যানিলা, ষ্ট্রবেরি, ডুরিয়ান, আম, আনারস, আপেল, কলা ইত্যাদির অবিকল কৃক্রিম রাসায়নিক সুগন্ধি ব্যবহার করা হয়। এ সব রাসায়নিকের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে এমাইলএসিটেট, বুটাইরিক এসিড, ইথাইল নাইট্রেট, নেরোলিন, ইত্যাদি।

এ সব কৃত্রিম খাবারের মূল উৎপাদান হচ্ছে চিনি, চর্বি, লবন এবং রাসায়নিক সুগন্ধি। এসব উপাদান উচ্চ মাত্রায় ক্যালোরি যুক্ত খাবারের প্রতি মানুষের প্রবল নেশা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে চিনি এবং চর্বি ক্ষুধা বৃদ্ধি করে। বিশেষ খাবারের প্রতি প্রবল নেশা সৃষ্টি করে। স্বভাবের পরিবর্তন ঘটায়। সে কারণে বহু ডায়াবেটিক রোগী আপন জনের অগোচরে নিজ ঘরের খাদ্য ভান্ডার থেকে চুরি করে লুকিয়ে লুকিয়ে মিষ্ঠি, দধি, আইসক্রিম, চকলেট ইত্যাদি খায়। চিনি, চর্বি, এবং লবনের সুবাস খাবারের স্বাদ বাড়ায় এবং তৃপ্তি প্রদান করে। আরো খাবার আগ্রহ জাগায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মানুষের এসব সূক্ষ্ম অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বাহারি বিজ্ঞাপন পূঁজি করে ভেজাল খাদ্যের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আলোর ফাঁদে যেমন পতঙ্গ ঝাপিয়ে পড়ে তেমনি সাধারন মানুষ কোম্পানির প্রতারনা মূলক বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে ভেজালের জালে আটকে পড়ছে। পরিণামে অবিসিটি, উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এবং অন্যান্য অসংক্রামক রোগের শিকার হচ্ছে। মজার ব্যপার হচ্ছে এ সব বহুজাতিক কোম্পানি ভেজাল খাদ্য যেমন বিক্রি করছে তেমনই রোগ বালাই হলে তা চিকিৎসার জন্য ওষুধ ও বিক্রি করছে। বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে।

বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থা মানুষের পুষ্টি চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ প্রায় একশত কোটি মানুষ রাতে অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। অন্যদিকে দুইশ কোটি মানুষ অতিরিক্ত ওজনে ভারাক্রান্ত। তবে উভয় শেণীই অপুষ্টির শিকার। অর্থাাৎ পৃথিবীর মোট জন সাংখ্যার প্রায় অর্ধেকই অপুষ্টির শিকার। এটা গোটা পৃথিবীর সকল মানুষের লজ্জার বিষয়। বৈশ্বিক জন সমষ্টির এ ব্যর্থতার দায়ভার কার? দেখার কি কেউ নেই? স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন হতে পারে। বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থা কে নিয়ন্ত্রণ করছে? এর সহজ উত্তর বহুজাতি কোম্পানি। নানাভাবে বহুনামে শুধু খাদ্য নয় সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রায় সব কিছুই রিমোট কন্ট্রোলে তারা নিয়ন্ত্রন করছে। এ ক্ষেত্রে আরো লক্ষণীয় যে বহুজাতিক কোম্পানি যা খাওয়াতে চায়, মানুষ তাই খায়। বাংলাদেশও এর ব্যক্রিম নয়। বাংলাদেশের মানুষও আজ ঐতিহ্যগত পুষ্টি সমৃদ্ধ স্থানীয় খাবারের চেয়ে প্যাকেটজাত খাবার এবং পানীয় দ্রব্যের দিকে ঝুঁকছে। রান্না করা মুরগি ছেড়ে ভাজা মুরগির (ফ্রাইড চিকেন) প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। বিশ্বের বড় একটি দেশের কোন একটি প্রদেশের/ স্টেটের নামে পরিচিত মুরগি ভাজা এ দেশে বেশ জন প্রিয়। তেমনি আলু ভর্তার চেয়ে ইউরোপের একটি ফ্যাশন ধন্য দেশের নামে ভাজা আলুও তেমনই জনপ্রিয়। তবে ভেবে দেখা প্রয়োজন মুরগি ও আলু ভাজতে যে তেল ব্যবহার হচ্ছে তাকি স্বভাবিক না জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ( বিকৃত)। তরুণ তরুণীরা ডিম ভাজার চেয়ে ডিম পোজ (Sunny Side Up) বেশী পছন্দ করছে। তবে খাবারের মাধ্যমে রোগ জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য রান্না মুরগি, ভাজা /রান্না ডিম এবং আলু ভর্তা বেশি নিরাপদ। সার্বিক ভাবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত রন্ধন প্রণালী তথা কথিত আধুনিক পদ্ধতির চেয়ে নিরাপদ।

অনিরাপদ খাদ্যের সাথে রোগ বিস্তারের একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। ইদানীং বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, ক্রণিক রেসপ্রিটরি ডিজিজ, ক্যান্সার,কিডনি ডিজিজ, অষ্টিওপোরোসিস, আলঝাইমার, ক্যাটারাক্ট, অটোইমিউন ডিজিজ, ষ্ট্রোক, ইত্যাদির প্রকোপ বাড়ছে। অসংক্রামক এবং সাংক্রামক, উভয় প্রকার রোগের প্রাদূর্ভাব কমানোর জন্য নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা অত্যন্ত জরুরী। নিরাপদ খাদ্যের মাধ্যমে খাদ্য বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। খাদ্য উৎপাদান থেকে প্রক্রিয়া করণ, প্যাকিং, বিতরণ, পরিবহন, সংরক্ষণ, প্রস্তুত করণ এবং সেবন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নিরাপদতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter