কীটপতঙ্গের গান গাওয়া


গান বাজনা কার না ভালো লাগে ? কে না গান ভালোবাসে। গানের অনুভুতি ও প্রভাবের ক্ষেত্রটি মূলত স্নায়ুতন্ত্রের ওপর এটা বিজ্ঞানভিত্তিক।

কান দিয়ে আমরা শুনি। কেউ শুনি মিউজিক। কেউ শুনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। এগুলো সবই শৃঙ্খলিত শব্দতরঙ্গ। এ সব শব্দ লহরী বাতাসের ওপরে ভর করে আমাদের কানের পর্দায় এসে আঘাত করে। তখন আমরা তা শুনে থাকি। তা হলে দেখা যাচ্ছে- শোনার পূর্বশর্ত হলো, কান বা শ্রবণ ইন্দ্রিয় থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, সকল প্রাণির কী কান আছে ? অন্য ভাবে বললে শ্রবণ ইন্দ্রিয় আছে ? উত্তর এক অর্থে আছে আবার অন্য অর্থে নেই। অনুসন্ধানে দেখা গেছে অনেক নিচু শ্রেণীর প্রাণীর শ্রবণ অঙ্গ বা শোনার সুগঠিত অঙ্গ নেই। এখানে স্বাভাবিক ভাবে আর একটি প্রশ্ন এসে যায়। নিচু শ্রেণীর প্রাণি আবার কাকে বলা হবে ? প্রাণীজগতকে দুভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। (জীব জগৎ বললে উদ্ভিদও এসে যায়) যেমন-অমেরুদন্ডী ও মেরুদন্ডী প্রাণী। এ্যামিওবা, কেঁচো, আরশোলা, অক্টোপাস ইত্যাদি অমেরুদন্ডী প্রাণী। অন্যদিকে ইঁদুর, বিড়াল, মানুষ ইত্যাদি মেরুদন্ডী প্রাণী। আমাদের বুঝার সুবিধার্থে অমেরুদন্ডী প্রাণিকে নিচু শ্রেণীর প্রাণি বলতে পারি। এর প্রধান যুক্তি হলো মেরুদন্ডী প্রাণির যেমন একটা পরিণত দেহাকৃতি বা আঙ্গিক (physiological) গঠন আছে অনেক ক্ষেত্রেই অমেরুদন্ডী প্রাণির তেমনটি নেই। অর্থৎ এদের হাত, পা, নাক-কান বা অন্য কোন অঙ্গ-প্রতঙ্গের ‘য সকল সাধারণ আকার আকৃতি বা নির্দিষ্ট অবস্থান থাকে এদের ক্ষেত্রে তা থাকে না। অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয় এসব যেন হেনতেন কিংবা যেমন তেমন করে সাজানো বা বসানো। তাই বলে কোন কার্যকারিতার দিক দিয়ে যে এরা দূর্বল তা কিন্তু মোটেও নয়। এমনকি যে ক্ষেত্রে এদের কান বা শ্রবণ ইন্দিয় নেই বলেছি সেখানেও কিন্তু তাদের শোনার –নিদেন পক্ষে অনুভতির ব্যবস্থা থাকে। এসব বিবেচনায় ‘কীট পতঙ্গ’ নিচু শ্রেণীর প্রাণি। কিন্তু তা হলে কি হবে এদের শোনার অঙ্গ শব্দ করার ব্যবস্থা, অর্থবহ শব্দ ইঙ্গিতের (তা নিয়ম মাফিক সুরেলাও হয়) ধরণ ও তা গ্রহণ বা ধারণ করার যে সব পদ্ধতি রয়েছে তা কিন্তু মোটেও নিচু শ্রেণীর নয়। বরং তা অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ উন্নত। আবার জটিলও।


ঝি ঝি পোকা


তবে এই আলোচনাটা একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। আম কাঁঠালের গরমের দিনে ঝিঝি পোকা গান করে। পিঁপড়া খেটে মরে আর গঙ্গাফড়িং ধানের শাখায় বসে মনের সুখে গান ধরে- এমন কখন কিন্তু ছড়িয়ে আছে আমাদের কবিতা-সাহিত্যের পাতায় পাতায়। কোন কোন ক্ষেত্রে সায়েন্স ফিকসনেও যা সত্যিকার অর্থে মৌলিক গবেষণাপত্র নয়। একটা জিনিস আমরা সহজে সত্য বলে ধরে নিতে পারি যে, কীটপতঙ্গ যে শব্দ করে কোন কোন ক্ষেত্রে সেই শব্দ এমন উচ্চমাত্রায় বা কর্কশ হয় যে, আমাদের কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়, তা নিজের প্রয়োজনে এবং তা বার্তা আদান-প্রদান মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। উঁচু জাতের পশু-পক্ষী তাই তো করে থাকে। এদের খাদ্য পাওয়ার ডাক, ভয়ের ডাক, বন্ধু-সঙ্গীকে ডাকার সঙ্কেত, আগ্রাসী শব্দ, আদর-আহলাদের ডাক ইত্যাদি রয়েছে। সুতরাং কীটপতঙ্গদের এমনটা হবে- তাই স্বাভাবিক। এবং তা বিজ্ঞানসম্মতও বটে। তা এক পরীক্ষিত সত্যও।

এই আলোচনায় আমরা দুটি জিনিস পেলামঃ এক শব্দ শোনার অঙ্গ Auditory Organ) থেকে আমরা সাধারণ ভাবে ‘কান’ বলে জানি। দুই শব্দ সৃষ্টিকারী অঙ্গ বা Stridulatory Organ) মানুষ ও উঁচু শ্রেণীর প্রাণির বেলায় কন্ঠনালী নামে পরিচিত।

কীটপতঙ্গের শব্দ অঙ্গ অডিওটরি অরর্গান আমাদের মতো সুনির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ তা নির্দিষ্ট আকার আকৃতির এবং একই স্থানে অবস্থিত নয়। কীটপতঙ্গ প্রধানত দুই উপায়ে নিজেদের দলের বা পারিপার্শিক শব্দ শোনে বা গ্রহণ করে থাকে। যথাঃ------

ক. শ্রবণ অঙ্গ (অডিওটরি অরর্গান- Auditory Organ)

খ. শ্রবণ লোম (অডিওটরি লোম- Auditory Hairs) শ্রবণ লোম কীটপতঙ্গের মাথা/ শুঙ্গ বা সম্মুখভাগে থাকলেও শ্রবণ অঙ্গ কিন্তু মাথা বা মাথার দিকে হয়ে থাকে। আবার সব কীটপতঙ্গের তা থাকতেই হবে এমন কথাও নেই। তবে যে গুলোর শ্রবণ অঙ্গ রয়েছে এর মধ্যে প্রজাপতি, গাঙ্গফড়িং, ঘাসফড়িং জাতীয় কীটপতঙ্গ উল্লেখযোগ্য। এসব কীটপতঙ্গের শ্রবণ অঙ্গ বা কানের পর্দা যাকে Tympanum বলে তা সাধারণত এদের বুকের দু‘পাশ হতে দেখা যায়। কোন কোন মথের বেলায় তা বুকের উপরে হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও যথেষ্ঠ দেখা যায়। কিছুটা আশ্চর্যজনক হলেও Gryllidac পরিবারের কীটপতঙ্গের এই শোনার পর্দা পায়ের মধ্য পর্যায় (সম্মুখ টিবিয়া) হয়ে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই শ্রবণ অঙ্গ/শোনার পর্দা Eardrum বা Trympanum -এর অবস্থান কীটপতঙ্গ শ্রেণীর সদস্যদের মধ্য স্থান নির্দিষ্ট নয়। বিভিন্ন জাত বা গোষ্ঠীতে এগুলোর অবস্থিতি এদের দেহের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। অর্থাৎ মাথা থেকে নিয়ে পা পর্যন্ত যে কোন জায়গায় তা হতে পারে। কেন এমন হয় এর উত্তর দেয়া খুব সহজ নয়। তবে এই নির্দিষ্ট শাখার গবেষকদের কাছে এর উত্তর কম বেশী জানা আছে। এবং সামগ্রিক ভাবে প্রাণীবিদ্যার এই শব্দটি ‘ অঙ্গাদি বিবর্তনতত্ত্ব বা Evolution of organ নামে পরিচিত।

কিছু কিছু ঘাসফড়িং জাতীয় সদস্যের শোনার সীমা মানুষের চেয়ে বেশী। যেমন মানুষের কান প্রতি সেকেন্ডে ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ স্পন্দন বা Vibrations পর্যন্ত ধরতে পারে। অন্যদিকে এই ফড়িং জাতীয় প্রাণিগুলো ৯০,০০০-এর মতো উচ্চমাত্রা বা High Frequency -তে শুনতে সক্ষম। এই বিবেচনায় এই কীটপতঙ্গ জাত মানুষের চেয়ে অনেক সংবেদনশীল

আমরা আমাদের চারপাশের পরিচিত উচ্চ পর্যায়ের প্রণিকুল মুখদিয়ে কথা বলে হৈ চৈ করে চিৎকার বা নানা ধারনের শব্দ করে থাকে। আমাদের সুরেলা সঙ্গীতও মুখেরই এক অবদান। এখানে আমরা মুখ বলতে কষ্ঠনালী বা Vocal cord -কে বুঝে থাকি। কিন্তু কীট পতঙ্গের বেলায় এই ব্যাপারটি একেবারেই অনির্দিষ্ট। অর্থাৎ কীটপতঙ্গ যে শব্দ করে তা মুখ/কণ্ঠনালী দিয়ে তো নয়ই বরং তা সৃষ্টির তেমন কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিই নেই। তবে এদর শব্দ সৃষ্টির যে যে পন্থা বা পদ্ধতি রয়েছে এর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো উল্লেখযোগ্য।

ক. দেহের কোন অংশকে অন্য কোন বস্তুর সঙ্গে আঘাত করেঃ কিছু বিটল পোকা কাঠের গর্তের প্রাচীরের সঙ্গে মাথা ঠুকে শব্দ তোলে।

খ. দেহের এক অংশকে অন্য অন্য অংশের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলেঃ

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কীটপতঙ্গ এভাবে শব্দ সৃষ্টি করে। ঘাসফড়িং / পঙ্গপালের পিছন পায়ের ফেমার এর Femur ভিতরের যে এক সারি গোজ বা চবম বহন করে দেহে তা ঘর্ষণের ফলে শব্দ সৃষ্টি করে। তা ছাড়া এগুলো সামনের বা পিছনের পাখার পরস্পর ঘর্ষণ, পা ও পাখার মধ্যে ঘর্ষণ, বুকের প্রাচীরের দু‘টি অংশের ঘষাঘষি করেও নানা ধরণের আওয়াজ করতে সক্ষম।

গ. দেহের কোন বিশেষ ঝিল্লি পেশী কাঁপিয়ে:

ঝি ঝি পোকার পেটের গোড়ার দিকে বায়ুথলি ও এক ধরণের জটিল ও শক্তিশালী পেশীর দ্বারা কম্পনের সাহায্যে শব্দ সৃষ্টি করে।

এ ছাড়া ফলের মাছি শুধু পাখা ঝাপিয়ে উড়ন্ত অবস্থায় শব্দ করতে পারে। সামগ্রিক ভাবে কীটপতঙ্গের জগত বিশাল। এ জগত জানার অংশের চেয়ে অজানার অংশ বেশি। আর এদের এই অধ্যায় আরও অজানা। অনেক কীটপতঙ্গই নানা ধরনের শব্দ করে। কোন কোনটি যথেষ্ট মিষ্টি-সরেলা। আবার তা বিরক্তিকর এবং কর্কশও হয়ে থাকে। কিন্তু এদের শ্রবণ-অঙ্গের স্বরূপ ও এদের শব্দ-সৃষ্টির কৌশল অনেক ক্ষেত্রে অজানা ও রহস্যময়। অজানার প্রতি মানব মনের সহজাত আকর্ষণ থাকে। সেই আকর্ষণই আমাদের টেনে নিয়ে চলে সিড়ি বেয়ে জানার এক সোপান থেকে অন্য সোপানে। আর জ্ঞানভান্ডার ক্রমে ক্রমে পূর্ণ হতে থাকে।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter