নয় জাতের বেগুনের বীজ হাতছাড়া


বিটিবেগুন বাংলাদেশে শুধু ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্যে আসে নি। এটা বলে জনগণকে ধোকা দেয়া হচ্ছে মাত্র। এর মাধ্যমে বহুজাতিক কম্পানি মনসান্তো এবং তার সহযোগী ভারতের মাহিকো কোম্পানি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এ দেশের বেগুনের জাতে নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। বিটিবেগুন নিয়ে আমরা যারা প্রতিবাদ করছি তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হচ্ছে যে আমরা নাকি আধুনিক বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে এবং কীটনাশক ব্যবহার কমে যাবে বলে কীটনাশক কম্পানির পক্ষে কাজ করছি। এসব ডাহা মিথ্যা প্রচারের মুল কারণ হচ্ছে আসলে এই ফাঁকে তারা বেগুনের জাতের ওপর যে কারিগরি করা হয়েছে তার ওপর তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্যে। নীচে সকালের খববের সাংবাদিক দেলোওয়ার জাহানের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরছি। এই লেখাটি পড়ে দেখুন, সব পরিস্কার বোঝা যাবে। একই ধরণের খবর দ্যা ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস ও ডেইলী সান -এ প্রকাশিত হয়েছে।   

 

নয় জাতের বেগুন বীজের মালিকানা হাতছাড়া

দেলোয়ার জাহান

মার্কিন ও ভারতীয় কোম্পানি মনস্যান্টো-মাহিকোর কাছে জনপ্রিয় নয়টি বেগুন বীজের মালিকানা হারিয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৫ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), মার্কিন বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনস্যান্টোর পক্ষে ভারতীয় কোম্পানি মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিড কোম্পানি লিমিটেড (মাহিকো) ও ভারতীয় কোম্পানি সাতগুরু ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সাব- লাইসেন্স চুক্তি অনুসারে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে উত্পাদিত বিটি বেগুনের মেধাস্বত্ব মনস্যান্টো ও মাহিকো কোম্পানির হাতে চলে গেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকার সময় সম্পাদিত ওই চুক্তিটি এতদিন পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে।

বারি ও সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হচ্ছে, বীজের মালিকানা বাংলাদেশের থাকছে। কিন্তু চুক্তিটির আর্টিকেল ১.১৯ ধারায় বলা হয়েছে, বিটি বেগুন বীজের মেধাস্বত্ব মনস্যান্টো-মাহিকো কোম্পানির। আর্টিকেল ১.৬ ধারায় বলা হয়েছে, বিটি বেগুনের বীজ কোম্পানির কাছ থেকে কিনে নিতে হবে। এই চুক্তির আর্টিকেল ৯.২(গ) অনুসারে বিটি বেগুন বীজের বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকার মনস্যান্টো-মাহিকো কোম্পানির। বিটি বেগুন বীজের এবং প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এই চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে।

বারি মহাপরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বিটি বেগুনের বীজের মালিকানা বারির থাকবে দাবি করে বলেন, বিটি জিন ও প্রযুক্তির মালিকানা মনস্যান্টো ও মাহিকোর কোম্পানির। নতুন কোনো জাতে বিটি জিন সংযোগ করতে হলে মাহিকো কোম্পানির কাছ থেকে নতুন করে অনুমোদন নিতে হবে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব চুক্তি বিশেষজ্ঞ জোবায়ের আল-মাহমুদ বারি মহাপরিচালকের দাবিকে ভিত্তিহীন বলেছেন। তিনি বলেন, চুক্তির ১.১৯ ও ১.৬ ধারা অনুসারে, বাংলাদেশের নিজস্ব জাতের ৯টি বেগুন যেগুলোতে বিটি জিন সংযুক্ত করা হয়েছে সেগুলোর মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যাবে। আর্টিকেল ৯.২(গ)-এ বলা হয়েছে, বিটি বেগুন বীজের ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক এবং মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এই চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী প্রমাণিত হচ্ছে, বাংলাদেশের বেগুন বীজের মালিকানা চলে যাবে মার্কিন-ভারতীয় কোম্পানি মনস্যান্টো-মাহিকোর কাছেই। এটি বায়োপাইরেসি ছাড়া আর কিছুই নয়। দেশি-বিদেশি কোম্পানির মুনাফা লাভের বলি হবে এদেশের নিজস্ব বেগুন জাত। তিনি বলেন, বিটি বেগুনের মধ্যে থাকা বিটি টক্সিন প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে বেগুনের পোকা। ফলে বিটি বেগুন চাষের মূল লক্ষ্য ডগা ও ফলছিদ্র প্রতিরোধই ভেস্তে যেতে পারে। মাহিকো কোম্পানির সঙ্গে বারির সাব-লাইসেন্স চুক্তির ৯.২(ই) ধারায়ও বলা হয়েছে, বারি এই চুক্তি বাতিল করতে পারবে যদি পোকা এই বিটি বেগুনের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। বারি দাবি করছে, বিটি বেগুনের বীজের নিরাপত্তা ও মালিকানা কৃষকের হাতেই থাকবে-চুক্তি অনুসারে বারির এই দাবির কোনো বৈধতা নেই। চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ফসল ও সবজির ওপর কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের হাজার বছরের নিজস্ব কৃষিজ সম্পদের ওপর বহুজাতিক কোম্পানির এই আগ্রাসন এ দেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে যে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। তিনি বলেন, বিটি বেগুন বীজের বিতরণ, সংরক্ষণ যে কত কঠোরভাবে বহুজাতিক অ্যাগ্রো করপোরেশন ও তাদের দেশীয় এজেন্সিগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে তার আরেকটি প্রমাণ সাব-লাইসেন্স চুক্তির ৯.৬ ধারা, যেখানে বলা হয়েছে চুক্তি বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে বারিকে বাংলাদেশে এই বিটি বেগুন বীজ বিতরণ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করতে হবে এবং সব বীজ ধ্বংস করে ফেলতে হবে। এমনকি বারিকে জিএম বেগুনের সব বীজ কোম্পানির প্রতিনিধির সামনে ধ্বংস করতে হবে এবং ওই প্রতিনিধি এ ব্যাপারে লিখিতভাবে কোম্পানির কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

বিটি বেগুনের মালিকানা কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ার পাশাপাশি চুক্তিটির ফলে আইনগত প্রশ্ন ও ফাঁক তৈরি হয়েছে বলে জানান প্রাণ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ । তিনি বলেন, বিটি প্যাটেন্ট জিন ও প্রযুক্তির মালিকানা মনস্যান্টো ও মাহিকোর। দেশি বেগুনের প্যাটেন্ট বিটি জিন বেগুনে প্রবেশের ফলে কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি বেগুনের মেধাস্বত্ব দাবি করা স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, বেগুন পরাগায়ন হওয়ায় বিটি বেগুনের বাইরে জিনটি বাংলাদেশের নিজস্ব অন্য জাতের বেগুনে প্রবেশ করলে তার মালিকানা কোম্পানি দাবি করতে পারে, যা খুবই ভয়াবহ। ফলে বাংলাদেশের নিজস্ব জাতের সব বেগুনের ওপর কোম্পানির মেধাস্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সব কিছুর মালিকানা জনগণের। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রাণ সম্পদের ওপর কোম্পানির মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার আগে দেশে কৃষকদের স্বার্থে পরামর্শ ও আইন তৈরি করার প্রয়োজন ছিল। সেগুলো না করায় চুক্তিটি ভয়াবহ আইনগত জটিলতা তৈরি করবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বিটি জিন প্রয়োগ করা ৯টি জাত হল : উত্তরা, কাজলা, নয়নতারা, সিংনাথ, চেগা, ইসলামপুরী, দোহাজারী ও আইএসডি ০০৬। গত ২৯ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত বিটি বেগুন সম্পর্কিত এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে ব্যাপকভাবে বিটি বেগুনের চাষ কৃষক পর্যায় দেওয়ার এক বছরের মধ্যে স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কি না সেটি যাচাই করার জন্য নির্দেশ দেন। বিটি বেগুন মানবদেহ, পরিবেশ, কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অভিযোগ করে কৃষক ও পরিবেশবাদীরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। গত ২২ জানুয়ারি সরকার ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাবনা, জামালপুর, রংপুর ও গাজীপুর জেলার ২০ জন কৃষকের হাতে বিটি বেগুনের চারা তুলে দেয়। চুক্তি অনুযায়ী, চারা থেকে উত্পাদিত বীজ কৃষক সংক্ষরণ করতে পারবেন, তবে বিক্রি বা বাণিজ্যিক ব্যবহার করতে পারবেন না। বিক্রি করতে পারবে কেবল মনস্যান্টো-মাহিকো। বারিকেও কিনতে হবে মনস্যান্টো-মাহিকোর কাছ থেকে।

উল্লেখ্য, ভারত ও ফিলিপাইনের আদালত দেশ দুটিতে বিটি বেগুন পরীক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

http://www.thefinancialexpress-bd.com/2014/02/23/20090
http://www.daily-sun.com/details_yes_22-02-2014_Bt...
http://unbconnect.com/bt-brinjal/#&panel1-1
http://www.shokalerkhabor.com/2014/02/23/156668.html

 


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter