“বর্তমান সেচ নির্ভর কৃষি বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত”


আদিতে বাংলাদেশের কৃষি ছিল মাটি ও বাতাসের আদ্রতা এবং বৃষ্টি নির্ভর। চাষাবাদ আধুনিকীকরণ তথা সবুজ বিপ্লবের আর্শীবাদে সেচের প্রচলন শুরু হয়। প্রথম দিকে মুক্ত জলাশয় থেকে সেচ দেয়া হত। ফসলের ক্ষেতে ডোবা, নালা, খাল, বিল পানি শূন্য করে সেচ দেয়া হত। নির্বিচারে মাছসহ সকল জলজ প্রাণীর প্রজনন স্থল তথা শেষ আশ্রয়টুকু পর্যন্ত নিঃশেষ করে সেচ দেয়া হয়। ভূ-উপরিভাগের সকল উৎস শেষ করে ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে সেচ দেয়া শুরু হয়। অগভীর নলকূপ এবং গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচ দেয়া হয়। প্রতি বছর সেচের এলাকা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তবে সেচের এলাকা যতই বাড়ছে পানির স্তর ততই নীচে নামছে। পানিতে আর্সেনিকের দূষণ ও বাড়ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলায় পানি আর্সেনিক দূষণে দূষিত। পানীয় জল যেমন দূষিত হয়েছে তেমনই সেচের পানিও দূষিত হয়েছে। আর্সেনিক দূষণে দূষিত পানি দ্বারা উৎপাদিত ফসল ও দূষিত হচ্ছে। ফলে সেচ নির্ভর সব খাদ্য শস্যে আর্সেনিকের অনুপ্রবেশ ঘটছে। ব্যাপক হারে সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে আনার ফলে ভূ-গভীরে শূন্যতা দেখা দিচ্ছে। একদিকে যেমন ভূমি ধ্বসের আশংকা বাড়ছে অন্য দিকে উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভ-ূগভীরে লোনা পানি প্রবেশ করছে। এ অবস্থা অবিরাম ধারায় চলতে থাকলে কালক্রমে দেশের সর্বত্র সাগরের লোনা পানি প্রবেশের আশংকা রয়েছে।

স্বাভাবিক নিয়মে বর্ষাকালে ভূ-গর্ভের পানির স্তর পূর্ণ হবার কথা। কিন্তু ইদানিং কালে কৃষি যান্ত্রিকী করণের ফলে কাঠের লাঙ্গলের স্থলে পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর প্রবর্তন করা হয়েছে। ভারী যন্ত্র দ্বারা চাষ করার ফলে মাটিতে প্রচন্ড চাপ পড়ে। মাটির তলায় শক্ত আস্তরণ পড়ে। তাছাড়া বছরের পর বছর গুচ্ছ মূল বিশিষ্ট ফসল ধান চাষের ফলেও মাটির তলায় আস্তরণ পড়ে। ভূ-গভীরের পানির স্তরের সাথে

ভূ-উপরিভাগের যে সংযোগ ছিদ্র ছিল সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টি বা বন্যার পানি গড়িয়ে নদী দিয়ে সাগরে চলে যায়। কিন্তু ভূ-গভীরে পানির স্তরে প্রবেশ করতে পারে না।

ভূ-উপরিভাগের পানির সাথে ভ-গর্ভস্থ পানির সম্পর্ক

আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় ভূ-উপরি ভাগের পানি এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির ভিন্ন দুটি উৎস। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। আসলে ভূ-গর্ভস্থ পানি এবং ভূ-উপরি ভাগের পানি একই উৎসের পানি এবং একই ধারায় সংযুক্ত। ভূ-উপরি ভাগের জলাশয় এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর এমন ভাবে সংযুক্ত যে যদি উপরিভাগের জলাশয়ের পানির স্তর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের নীচে হয় তা হলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর থেকে পানি ভূ-উপরিভাগের জলাশয়ে চলে আসে। বিপরীত অবস্থা ঘটবে যদি ভূ-উপরি ভাগের জলাশয়ের চেয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নীচে হয়। পানির ধর্ম পানি সব সময় নীচের দিকে গড়ায়। পানি কেটে ভাগ করা যায় না। তাই একই সম্পদ বিবেচনা করে ভূ-গর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার নীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

সেচ নির্ভর কৃষির গোড়ার কথা

সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সেচ নির্ভর কৃষির অগ্রযাত্রা শুরু হয়। সবুজ বিপ্লবের আর্বিভাব ঘটে এমন এক সময় যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। উপনিবেশিক রাহু বলয় থেকে মুক্ত হয়ে বহু দেশ স্বাধীন হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার বহু দেশে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কোথাও আবার লাল পতাকার ছায়ায় উপনিবেশিক শোষণের শিকার সর্বহারারা সমবেত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের উত্তপ্ত লড়াই শেষ হয়ে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছে। এক দিকে গ্রেটবৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স আর অন্য দিকে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোসালিষ্ট রিপাবলিক (ইউ এস এস আর)

এক ঢিলে দুই পাখী মারার কৌশল হিসাবে সবুজ বিপ্লবের আর্বিভাব। এক দিকে আপাতত অধিক ফসল ফলানোর নামে সেচ নির্ভর কৃষি সেই সাথে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের জন্য জমানো রাসায়নিক দ্রব্য বিদেশে চালান দেয়া। নিজ দেশের পরিবেশ বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত রাখা। বালাইনাশক, আগাছা নাশক, রাসায়নিক সার ইত্যাদি রূপে মারাত্বক রাসায়নিক দ্রব্য বাজারজাতকরণ। মুক্তিকামী মানুষকে দুষ্ট চক্রে আবদ্ধ করার জন্য উন্নয়নের নামে ঋণের মাধ্যমে অভিনব মহাজনী মায়াজালে আবদ্ধ করার জন্য বিশ্ব ব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক, আফ্রিকা উন্নয়ন ব্যাংক, আই এম এফ, গ্যাট, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য কনসালটেটিভ গ্রুপ অব ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচার (সিজিআইআর) কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) সহ আরো অনেক আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, কর্পোরেট এবং ব্যক্তিগত সংস্থার জন্ম হয়। পাশা পাশি গজিয়ে ওঠে অনেক বহুজাতিক কোম্পানী। তবে সকলেরই প্রায় অভিন্ন দৃশ্যমান উদ্দেশ্য থাকে মাটিসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদের যথাসাধ্য ব্যবহারের মাধ্যমে মানব জাতীর জীবন মান উন্নয়ন করা। বিশ্বায়ন এবং উন্নয়নের এই প্রবল স্রোতে অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হয়েছে। পরিবেশ ও প্রকৃতিতে আরো অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বৈশ্বিক এ ধাক্কায় বাংলাদেশও আন্দোলিত হয়েছে।

কি হারিয়ে কি পেয়েছি

অনেক হয়েছে। এবার সময় হয়েছে পিছন ফিরে তাকাবার। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে এ দেশে পনের হাজার জাতের ধান ছিল। আর এখন সেখানে হাতে গোনা কয়েকটি জাতের ধান আবাদ হচ্ছে। যদিও এ যাবৎ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ৬২টি উচ্চ ফলনশীল জাত এবং পাঁচটি হাইব্রিড ছাড় করা হয়েছে। বিদেশ থেকে আরো ৮০টি হাইব্রিড ধান আমদানী করা হয়েছে। হাইব্রিড ধান সম্পর্কে প্রথম কথা কৃষকরা বীজ রাখতে পারেন না। দ্বিতীয়ত প্রতি বছরই খবরের কাগজে হাইব্রিড ধানের ফসলহানীর খবর প্রকাশিত হয়। গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে হাইব্রিড ধানের আবাদ কমছে। ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে হাইব্রিড ধানের আবাদ হয় ৮.১৪ লাখ হেক্টরে। ২০১১-২০১২ মৌসুমে আবাদ হয় ৬.৬০ লাখ হেক্টরে। ক্রমেই হাইব্রিড ধানের আবাদ কমছে।

ক্রমে ক্রমে মাঠে ধানের বৈচিত্র্য কমছে। বর্তমানে আমন মৌসুমে মাঠে দেখা যায় বি আর-১১ এবং বোরো মৌসুমে ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯। আউশ ধানের আবাদ তো প্রায় উঠেই গিয়েছে।

ভয়াবহ বাস্তবতা

সেচ নির্ভর কৃষির কারণে বাংলাদেশের কৃষি, জন মানুষের জীবন ও জীবিকা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। খাদ্য সার্বভৌমত্ব অস্থিতিশীল হয়েছে। সাগরের লোনা পানি ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে প্রবেশ করছে। পরিবেশ বিপজ্জনক হুমকির সম্মুখীন।

এখন করণীয়

পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ইরি ধান প্রবর্তনের পূর্ব অবস্থায় কৃষি ব্যবস্থা ও ফসল চক্রে ফিরে যেতে হবে। রবি মৌসুমে ডাল, তৈল বীজ, মসলা, শাক সবজি, ফলমূল ইত্যাদি আবাদের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। খড়াসহিষ্ণু জাতের বিভিন্ন ফসল, দানাদার শস্য যেমন গম, বার্লি ও মিলেট জাতীয় ফসলের আবাদ বাড়াতে হবে।

 


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter