দেশে কী বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য পাওয়া যায়!
দেরীতে হলেও এটা আশার কথা যে সরকার মানতে বাধ্য হচ্ছেন বাংলাদেশে বিষ মুক্ত খাদ্য পাওয়া এবং খাওয়া দুটোই বেশ শক্ত। নজির হচ্ছে ডেইলী স্টার, ২৮ এপ্রিল ২০১৪ প্রকাশিত সংবাদ শিরোনাম “৪০% খাদ্য বিষাক্ত”। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এফএও এর আর্থিক সহায়তায় সরকারী ল্যাবোরেটরিতে খাদ্য শস্যের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে খাদ্য শস্যে বিষাক্ত পেস্টিসাইডের মাত্রা বেশি থাকায় খাদ্য বিষাক্ত। খাদ্য বিষাক্ততার মান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিরাপদ খাদ্য মানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। পরীক্ষিত খাদ্য নমুনায় যে সব খাদ্যে বিষাক্ততা চিহ্নিত হয়েছে, তারমধ্যে রয়েছেÑ দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য, ফল, সবজি, শুটকি মাছ। পেস্টিসাইডে বিষাক্ত খাদ্যের মধ্যে ৫০% সবজি, ৩৫% ফল খাদ্য হিসেবে নিরাপদ নয়। আম এবং চিংড়ি মাছে উচ্চ পর্যায়ে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে-গাজর, সীম, টমেটো, লেটুস, মরিচ, আপেল, কলা, আনারস এবং আমে মারাত্মক পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-খাদ্য মধ্যে যেসব পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয়েছে সেসব পেস্টিসাইড; গত দশকে বাতিল কৃত (Band Pesticide)। বাতিল পেস্টিসাইড সবজি, ফল, এবং শুটকি মাছে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাতিল পেস্টিসাইডের মধ্যে রয়েছে-ডিডিটি, এলড্রিন, ক্লোরডেন, এবং হেপ্টাক্লোর।
পেস্টিসাইড বা কীটনাশক কখনই কোনো মানুষ বা প্রাণীর ক্ষতি ছাড়া বিন্দু মাত্র উপকার করে না। এছাড়া আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, কৃষির সাথে পেস্টিসাইডের কোনই সম্পর্ক ছিলো না এবং বর্তমানেও নেই। সরকারের বিভ্রান্তিকর নীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং মানুষের মানবিক গুণাবলীকে রাসায়নিক কৃষির প্রবর্তনের মাধ্যমে ধ্বংস করেই কৃষিতে পেস্টিসাইড প্রবর্তন করা হয়েছে। ভাবুন তো! এটা কি করে সম্ভব একজন মানুষ তার উৎপাদিত বিষাক্ত খাদ্যশস্য অর্থের বিনিময়ে আরেক’জন মানুষের হতে তুলে দিচ্ছে, এতে তার কোনো অপরাধ বোধ কাজ করছে না। বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। কেননা এর প্রধান কারণ মুক্তবাজার অর্থব্যবস্থা মানুষের মানবিক গুনাবলীকে একেবারে ধ্বংস করেছে, ফলে সবার চাই মুনাফা।
কৃষিতে পেস্টিসাইড ব্যবহৃত হবে কি, হবেনা, সেটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে বীজ এবং বৈচিত্রপূর্ণ চাষাবাদের ওপর। যদি আপনি স্থানীয় নিজ সংরক্ষিত বীজ চাষাবাদে ব্যবহার করেন তাহলে শস্য ফলাতে কোনো পেস্টিসাইডের প্রয়োজন হবে না। যদি হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করেন তহলে অবশ্যই পেস্টিসাইড ব্যবহার করতে হবে। তবে এখানে একটু আশ্চর্য হতে হচ্ছে যে, উল্লেখিত প্রতিবেদনে বাতিলকৃত পেস্টিসাইডের ঘাড়ে সব দোষ চাপানো হয়েছে। এর অর্থ এই নয়কি অনুমদিত পেস্টিসাইড ভালো এবং খাদ্য শস্যে রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করার জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে-না কি?
বাংলাদেশে খাদ্য বিষের ক্ষতির চিত্র যদি দেখতে চান তাহলে দয়াকরে যেকোনো হাসপাতালে গেলে দেখতে পাবেন, নানান ধরণের রোগির সংখ্যা কত! তারা কিন্তু সবাই খাদ্যের মাধ্যমে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আর কৃষিতে পেস্টিসাইড ব্যবহারের সুবাদে ডাক্তার’রা জমজমাট ব্যবসা ফেদে বসেছেন।
অপরদিকে যদি কোনো কৃষককে প্রশ্ন করেন, ফসলে পেস্টিসাইড ব্যবহার করেন কেন? তিনি বলবেন, পেস্টিসাইড ছাড়া কি কোনো ফসল উৎপাদন করা সম্ভব? অর্থাৎ রাসায়নিক কৃষি এদেশের কৃষকদের মাথা ধোলাই করে ফেলেছে।
বাংলাদেশে পেস্টিসাইড কেমন করে স্থান করে নিলোঃ
বাংলাদেশে রাসায়নিক বিষ প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত কৃষিতে বা কোনো খাদ্য দ্রবে বিন্দুমাত্র রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের কথা ভাবায় যেতো না। রাসায়নিক কৃষিতে হাইব্রিড বীজ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে রাসায়নিক বিষ শক্ত আসন করে নেয়। কেননা হাইব্রিড বীজ থেকে পেস্টিসাইড ব্যতিত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব নয়।
১৯৭৪ সালে সরকারী ভাবে রাসায়নিক বিষের ওপর ১০০% ভর্তুকী প্রদানের মাধ্যমে এ দেশে রাসায়নিক বিষ চালু করা হয়। ১৯৭৮ এ এসে রাসায়নিক সারের উপর থেকে ৫০% ভর্তুকি কুমিয়ে দেয়া হয়। ১৯৭৯ থেকে সরকার রাসায়নিক বিষের ওপর থেকে সকল রকম ভর্তুকী বাতিল করে এবং রাসায়নিক বিষ আমদানী ও বিতরণের সকল দায়িত্ব বেসরকারী খাতে (Private Sector) ছেড়ে দেন। বর্তমানে রাসায়নিক বিষ ও হাইব্রিড বীজ কোম্পানিগুলো সরকারী ছত্রছায়ায় নিজেরাই জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
খাদ্য শস্যে পেস্টিসাইড ব্যবহারের প্রকৃত তথ্যঃ
ডেইলী স্টারের রিপোর্টে ৪০% খাদ্য শস্য পেস্টিসাইডে আক্রান্ত দাবী করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য তথ্য হচ্ছে বাংলাদেশের এমন কোনো স্থান নেই এমন কোনো শস্য নেই যেখানে পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয় না। মাঠ পর্যায়ে সরাসরি কৃষকের সাথে কথা বলে জেনেছি যে-মরিচ, বেগুন, কচু, ভুট্টা, ধান, গম, কলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গোলআলু, পিয়াজ, হলুদ, রসুন, আদা, পুঁইশাক, পটল, মূলা, শসা, ক্ষিরা, তরমুজ,সরিষা, বরবটি, ঝিঙ্গা, চিচিংগা, গাজর, সীম, টমেটো আখ ইত্যাদিতে অবশ্যই পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয়। এমনকি পান এবং সুপারিতে ব্যপক পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং দিন দিন পেস্টিসাইডের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
শুধু কি বাতিল পেস্টিসাইডগুলো বিষাক্ত?
বাতিল পেস্টিসাইডগুলোর তথ্য প্রদানের মধ্যে একটু ভেলকি বাজি রয়েছে। ডেইলী স্টারের রিপোর্টে যেসব পেস্টিসাইডকে মারাত্মক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ডিডিটি, এলড্রিন, ক্লোরডেন, এবং হেপ্টাক্লোর। এসব পেস্টিসাইড নাছোড় বিষাক্ত (চবৎংরংঃবহঃ ঙৎমধহরপ চড়ষষঁঃধহঃং- চঙচং) প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক ভাবে বাতিলকৃত পেস্টিসাইড। এসব পেস্টিসাইড বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক বাতিল করা হয় গত দশকে ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন, কৃষি অধিদপ্তর এর উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং কর্তৃক ২০১০ এ, ১০৭ বালাইনাশক বাতিল করা হয়েছে ( টেবিল দেখুন)। সে সব বালাইনাশক বাজারে ব্যাপক বিক্রয় হচ্ছে। সে সম্পর্কে কোনো কিছু বলা হয় নাই।
পেস্টিসাইড মানেই হচ্ছে পেস্টিসাইড। মারত্মক আর অ-মারাত্মক বলে কোনো যক্তি খাটে না। এদের কাজ হলো প্রাণ হরণ করা। সেসব করেও তাই। মারাত্মক আর কম মারাত্মক এই শব্দগুলো বহুজাতিক বীজ ও পেস্টিসাইড কোম্পানির ভাষা। যখন যার গ্রহণ যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে তখন তাকে মারাত্মক উপাধি দিয়ে আউট করা হয়।
কৃষিতে রাসায়নিক বিষ ব্যবহার বাড়লো কেন?
বর্তমান জামানায় আমাদের সবারই ধৈর্য-সহিষ্ণুতা যথেষ্ঠ পরিমাণে কমে গেছে। কোনো কিছু হতে গেলে বা করতে গেলে কিছুটা সময় লাগে, আমরা সেই সময়টা দিতে চাই না। সবাই নগদ লাভ খুঁজি ফলে যা হবার তাই হয়েছে। বর্তমানে শস্যে, কীট-পতঙ্গ, রোগ বালাই অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। অল্প কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে স্থানীয় শস্যের বীজ এবং প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার ব্যাপক চর্চা ছিলো। তখন মানুষের প্রাচুর্য না থাকলেও শান্তি ছিলো, এখনকার মতো এতো জটিল জীবন ব্যবস্থা ছিলো না। প্রচুর্য আছে শান্তি নেই। সব সময় যেন অস্থিরতা এখন করা হচ্ছে হাইব্রিড বীজ এবং এককাট্টা ফসলের চাষাবাদ। এককাট্টা ফসলের চাষাবাদ করা হলে কীট-পতঙ্গ, রোগ-বালাই দ্বারা ফসল ব্যাপক ভাবে আক্রান্ত হবে এটা একজন শিশুও জানে। এরজন্য কৃষিবিজ্ঞান পড়ার প্রয়োজন পড়ে না। এককাট্টা ফসলের চাষাবাদ করবেন আর পেস্টিসাইড মুক্ত নিরাপদ খাদ্য খাবেন এটা বোকার দেশের স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
পেস্টিসাইড মুক্ত খাদ্য শস্য কি উৎপাদন করা সম্ভব?
অবশ্যই সম্ভব। দেশের এবং বিদেশের আনেকেই জানেন নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা সকল রকমের রাসায়নিক বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করা তাদের দৈনন্দিন কাজ। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা নিজেরা রাসায়নিক বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করেন, নিজেরা খান, আত্মীয় স্বজনদের সাথে বিনিময় করেন এবং বাজারে বিক্রিও করেন। দেশে ৩ লক্ষের অধিক নয়াকৃষির কৃষকরা স্থানীয় জাতের বীজ, মাটির পরিবেশ চক্র ব্যবস্থাপনার মাধ্যম সুস্থ সবল পুষ্টিমান সম্মত ফসল উৎপাদন, বিতরণ ও বিক্রয় করে থাকেন। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা কোনো অবস্থায় রাসায়নিক সার বা বিষ ব্যবহার করেন না। তারা জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন স্থানীয় নিজস্ব পরিবেশ সম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তার মধ্যে রয়েছে -বিভিন্ন ধরণের কম্পোষ্ট ব্যবহার, জৈবসার, গোবরসার ব্যবহার, পর্যায়ক্রমিক ফসল চাষাবাদ, জাবরা ব্যবহার ইত্যাদি। তার সঙ্গে অবশ্য স্থানীয় উন্নত জাতের বীজ রয়েছে।
আপনি যদি পেস্টিসাইড মুক্ত নিরাপদ খাদ্য পেতে চান তাহলে নয়াকৃষির পথ অনুসরণ করতে হবে। শর্ট-কাট কোনো পথ নেই। প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে।
প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিদন্দিতা করে কখনোই সফল হবেন না, অতীতেও কেউ হয়নি। বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা ব্যবসা-বণিজ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য কখনো জীবন চেনে না, সে চেনে মুনাফা।