দুঃখিত, ঈদ মোবারক বলতে পরছি না


আমাদের দেশে ঈদ হয়ে গেল গতকাল(২৯ জুলাই), ২৯ রোজা শেষ করে। ঈদ আসলেই আনন্দ হবে, এটা স্বাভাবিক। সারা মাস রোজা রেখে ঈদের আনন্দ অনুভব করা অন্য যে কোন উৎসবের চেয়ে বেশী। কারণ দীর্ঘ একমাস সারা দিন প্রায় ১৪-১৫ ঘন্টা না খেয়ে নিজের মধ্যে একধরণের সিয়াম সাধনা করে এই আনন্দ নিজে পাচ্ছে এবং পরিবারের মধ্যে বন্টন করছে। কেন জানি ঈদ মানুষকে কাছে টানে, দূরে রাখতে দেয় না। সে কারণে ঈদ আমাদের কাছে অনেক আকর্ষণ সৃষ্টি করে। প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে করে নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে প্রমাণ করে ঢাকা শহর তাদের আপন নয়। আপনজন যেখানে থাকে, সে গ্রামে তাদের যেতে হয়। সেখানেই এখনো মানুষের আনন্দ রয়ে গেছে। ফাঁকা ঢাকা শহর সেই হিশাবে কারো জন্যেই আনন্দের নয়। ঢাকা শহর আপন নয়।

আজ সকালে (৩০ জুলাই) বিবিসিতে শুনলাম, ঈদের দিনে এবং পরের দিন চিড়িয়াখানায় লোক সমাগম বাড়ে। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে হয় দিনে ৫ থেকে ১০ হাজার সেখানে ঈদের দিনে হয় ৫০,০০০ থেকে ১ লাখ!! জিরাফ, জেব্রা, সিংহ এরা অনেক বেশী আনন্দ দিতে পারে শিশুদের! তারা আর যাবেই বা কোথায়?

কিন্তু এবার আসলে কি আমরা আনন্দ করতে পেরেছি? কিংবা যারা করেছেন তাঁরা কি দেখেন নাই ঈদের দিন ফিলিস্তিনে কি হয়েছে? শাওয়ালের চাঁদ ফিলিস্তিনেও উঠেছিল, তারাও রমজানের রোজা রেখেছিল। কিন্তু তাদের জন্যে রোজার মাসেও ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত ছিল। জুলাই মাসের ৮ তারিখ থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত ১২৪২ জন বোমা হামলায় নিহত হয়েছে। শুধু ঈদের দিনেই মারা গেছে ১০০ জনের বেশী। সংখ্যা শুনে বোঝা যাবে না যে এর মধ্যে ছোট মাসুম শিশু ছিল শতাধিক। ঈদের দিনে এক ঘন্টার জন্যেও ইসরায়েলের বোমা বর্ষণ থামেনি। বোমা হামলায় বিধ্বস্থ ঘরের মধ্যে এক গর্ভবতী মা মারা যায়, কিন্তু তার পেট থেকে অপারেশান করে জীবিত শিশু বের করা হয়। মরা মা শিশুর জন্ম দিল!  অবুজ শিশুরা এই বোমাবাজির মধ্যেও ঈদ করতে গিয়ে ঘরে ফিরেছে লাশ হয়ে। কিংবা বাড়ী ফিরে দেখেছে মা-বাবা ভাই বা বোন মারা গেছে। বড়রা যারা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য একে অপরের বাড়ীতে গেছে সেটা ছিল শোকের মাতম করার জন্যে, দুঃখ ভাগাভাগি করার জন্যে, আনন্দের জন্য নয়।

প্রায় ৭০২০ জন আহত হয়েছে, ছবিতে দেখেছি এদের কারো হাত নেই, কারো পা নেই, মাথায় আঘাত, পেটে স্প্লিন্টারের আঘাত, পিঠে আঘাত, রক্তে ভরা জামা কাপড়। ঈদের রঙ্গিন জামা হয়েছে রক্তের লাল রংয়ে। এখানে আর কোন রং নেই, একটি মাত্র রং, রক্ত লাল! প্রায় ২,৪০,০০০ মানুষ ঘরবাড়ী হারিয়ে রিফিউজী হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। এখানে পানির সংকট, খাদ্য সংকট, মানবেতর জীবন। এদের জন্যে ঈদ বলে কি কিছু আছে? বাংলাদেশে কিছু ফিলিস্তিনি ছাত্র উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। একটি টিভি চ্যানেল তাদের তিনজনের সাক্ষাতকার নিয়েছিল ঈদের দিনে। তারা বললো আমাদের কোন ঈদ নেই। আমরা শুধু দোয়া করছি আমাদের মানুষরা যেন ভাল থাকে, আমাদের পরিবার যেন নিরাপদে থাকে। একজন বললো, আমি গত কয়েকদিন মায়ের সাথে যখনই কথা বলেছি, তখনই বোমার শব্দ পেয়েছি। মা বলেছে, এটাই তোমার সাথে শেষ কথা হতে পারে। রাতে আল-জাজিরায় দেখেছি ফিলিস্তিনীদের বিশাল মিছিল, সেখানে ছোট শিশুদের লাশ কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে আর বড়দের লাশ খাটিয়ায়। এই দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়, তবুও অবাক হয়ে দেখেছি ফিলিস্তিনীদের চোখে মুখের দৃঢ়তা ওরা লড়াই করে যাবেই।

দেশেও কি সবাই আনন্দে ঈদ করেছে? ঈদের দিনেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে কমপক্ষে ১৩ জন, আহত হয়েছে অনেকে। দুর্বৃত্তের হাতেও মারা গেছে বলে টভি স্ক্রলে লেখা দেখেছি। আরও কষ্ট পেয়েছি রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় তুবা গ্রুপের গার্মেন্টসের সামনে সহস্রাধিক শ্রমিক ঈদের আগের দিন থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছেন, এবং তা ঈদের দিনেও অব্যাহত রাখেন। তিন মাসের বেতন বকেয়া আছে তাদের, বোনাসের দাবীও ছিল। জানতে চাই এই গার্মেন্টের মালিকের পরিবারে ঈদ কেমন ছিল? লজ্জা পেয়েছি, ঈদের কাপড় কেনাকাটায় ভারতীয় সিরিয়ালের চরিত্রের নামে কাপড় কিনতে না পেরে আত্মহত্যা ও তালাকের ঘটনার খবর পড়ে। শুনেছি শাড়ীর বিক্রি ৫০% কমে গেছে, তার মানে শাড়ী যারা পরতো তারা শালোয়ার-কামিজ বা অন্য পোষাক পরছেন। আর অনেক দোকানদার গর্ব (?) করে বলেন আমরা বাংলাদেশের কাপড় রাখি না!

এই পরিস্থিতিতে ঈদ মোবারক বলতে পারলাম না, সরি। তবুও সকলে ভাল থাকুন। আনন্দ করেন আসুবিধা নাই, কিন্তু ফিলিস্তিনীদের কথা আর দুঃখী মানুষের কথা মনে রাখবেন।  


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter