স্বল্পনাড়ু গ্রামের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতিঃ
এবারের বন্যা কিভাবে কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থার ক্ষতি করছে তা নিজেরা স্বল্পনাড়ু ও বাবুপুর গ্রামে সরেজমিন দেখে এসে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছি। তথ্য সংগ্রহে সঙ্গে ছিলেন ফাহিমা খাতুন লিজা।
টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার লাউহাটি ইউনিয়নের স্বল্পনাড়ু– গ্রাম। এই গ্রামের পূর্বে লাউহাটি, পশ্চিমে ডামখন্ড, উত্তরে কাতুলী, দক্ষিণে পাঁচুরিয়া গ্রাম। ধলেশ্বরী নদীর কোল ঘেষে স্বল্পনাড়ু– গ্রাম। এই নদী ভরাট হয়ে পাঁচুরিয়া, স্বল্পনাড়–, ডামখন্ড, বরুটিয়া, তাঁতশ্রী গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে এবং নদীর প্রবল স্রোতের ফলে নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে, ইতি মধ্যে বেশ কয়েক জনের বাড়িঘরসহ আবাদি জমি নদীর পেটে চলে গেছে। আর নদীর কোল ঘেঁষা কৃষকদের ফসলী জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। গত ৮/১০ দিন ধরে পানি আসা শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই প্রায় পানি বাড়ছে। এর মধ্যে বাড়িঘর, ফসলী জমি তলিয়ে গেছে। বাড়ির উঠান পানিতে ডুবে গেছে। বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ায় মালামালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘরের মালামাল নৌকায় করে আত্নীয়ের বাড়িতে সরিয়ে নিতে হচ্ছে। পানির কারনে মালামাল সরাতেও কষ্ট হচ্ছে। ঘরের ডোয়া ভেঙে গেছে। রান্নার চুলা ডুবে যাওয়ায় রান্না করে খেতে পারছে না। এর পরিবর্তে উচুঁ স্থানে ইট দিয়ে চুলা তৈরী করে রান্না করছে। পানির স্রোত বেশি থাকায় রাস্তার পাড় ভেঙে রাস্তার মাটি সরে গতের্র সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মানুষের চলাচলের কষ্ট হচ্ছে। যাতায়াতের রাস্তায় কোমর পানি থাকায় ডামখন্ড, পাঁচুরিয়া গ্রামের মানুষ নৌকায় করে যাতায়াত করছে। অনেকে কলার ভেলায় করে চলাচল করছেন। কারো প্রয়োজন হলে টাকা দিয়ে নৌকায় করে লাউহাটি বাজারে আসতে পারছেন। টাকা না থাকলে প্রয়োজন হলেও বাজারে আসতে পারছেন না অনেকেই। বাড়ির পালানে লাগানো সবজী মূলা, ডাঁটা, মরিচ, সীম, বেগুন, লাউ ঢেঁড়স, মিষ্টিকুমড়া, পেঁপে গাছ, উছতাসহ পানিতে ডুবে যাওয়া বিভিন্ন গাছ পঁচে মারা যাচ্ছে।
কৃষকদের লেবু বাগানের লেবু, লেবুর ফুল পঁচে নষ্ট হচ্ছে। সাহেব আলু গাছের গোড়া পঁচে মারা যাচ্ছে। কৃষক আফাজ ব্যাপারীর পালানের ৮ ডিসিমাল জায়গায় লাগানো ডাঁটা, মূলা, ডুবে গেছে। ওসমান মিয়ার ১০ ডিসিমাল জায়গায় লাগানো মূলা, বেগুন, উছতা পানির নিচে তলিযে গেছে। জিন্নাহ মোল্লা, জামাল মিয়ার ১৬ ডিসিমাল জায়গার ঢেপর ধান ঘোলা পানিতে ধানের পাতা ভারী হয়ে তলিয়ে গেছে। কৃষক আলফু মিয়া বলেন, আমার ১৫০ ডিসিমাল জায়গায় লাগানো ঢেপর ধানের গুছি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানির সাথে কাদা না থাকলে ধান পানির নিচে ১০দিন থাকলেও কোন ক্ষতি হতো না। কিন্তু পানির সাথে কাদা থাকার কারনে ধান গাছের পাতা ভারী হয়ে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। আর ২ দিনের মধ্যে পানি সরে গেলেই ধান কিছুটা রক্ষা পাবে। কৃষক ফারুক মিয়ার ৫০ ডেসিমেল জায়গায় লাগানো বি আর-১১, আফাজ ব্যাপারীর চামারা ও দিঘা ধান তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, কাদার কারনে পানি সরলেও গাছ বাঁচবে না। ধানের শিষ পঁচে গেছে। কৃষক ফজল মোল্লা, নুরু মোল্লা, কনা বেগম, সুফিয়া বেগম, শফিকুল ইসলাম, রশিদ মিয়া, তোতা মিয়া, তরিকুল ইসলামের ধানের গোছা পানির নিচে। ধান গাছের মাথা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। যতদুর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। আমন ধান পানি ভাঙে, অর্থাৎ পানিতে হয়। কিন্তু কাদা পানির কারনে ধানের অনেক ক্ষতি হবে। নদীর পানির স্রোতে আশ-পাশের ক্ষেতের ফসল বেশি ক্ষতি হচ্ছে। স্রোতের বিপরীতে যেসব ক্ষেত তার ২/১ টি ক্ষতি হয়েছে। গোখাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। গরু, ছাগল ঘর থেকে বের করা যাচ্ছে না। মাঠে পানি থাকায় হাঁস-মুরগী, গরু, ছাগলের খাবারের কষ্ট হচ্ছে। গরু-ছাগলকে গ্রামের মানুষ কচুরীপানা, পাটপাতা, কলাগাছ, কাঁঠাল পাতা, আম পাতা খাওয়াচ্ছেন। বন্যার পানিতে সব তলিয়ে যাওয়ায় সাপ, পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে গেছে। বাড়ির আশপাশে সর্বত্র পানি থাকায় মানুষের ঠান্ডা, কাশি, জ্বর, চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে। কৃষক জাহানারা বেগম, কাদের মিয়া, জুলু মিয়া বলেন, পানি কমার কোন লক্ষণ দেখছি না। এখন বন্যা হওয়ার সময় নয়। নাবিতে বন্যা হবে আমরা কেউ বুঝতে পারি নাই। বৃষ্টির পানি পেয়ে অনেক কৃষক আমন ধান চাষ করেছেন। এভাবে ১০/১২দিন থাকলে কৃষকের ফসলের কিছুই থাকবে না। কৃষকরা কোন বীজ হাতে রাখতে পারবেন না। ফলে পরবর্তী মৌসুমে বাজার থেকে ধানের বীজ কিনে চাষ করতে হবে।
এবার বন্যার পানিতে তেমন কোন মাছ দেখা যাচ্ছে না। যেগুলো দেখা যাচ্ছে তা গুড়া মাছ, খলসা, পুটি, মলা, টাকি, ভেদা, বাইম, চেং, চাঁন্দাসহ অন্যান্য গুড়া মাছ। বন্যা হওয়ার কারণে নদীতে ও খালে-বিলে রুই, কাতল, বোয়াল, শোল দেখা যাওয়ার কথা, তা এখনো চোখে পড়েনি। তাছাড়া কীটনাশকের ব্যবহারের কারনে মাছের বেঁচে থাকাই কঠিন। পানি কমতে শুরু করলে নদীতে অনেক কুড়িয়ে পাওয়া মাছ ধরা পড়ার কথা। তখন গ্রামের মানুষ আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ এই তিন মাস মাছ ধরে খেতে পারে। প্রাণ পরিবেশ সম্মত কৃষি করা গেলে এটা নিশ্চিত করা যেতো। এখন সেটা আর নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
আবার অনেক কৃষক বাজারেও মাছ বিক্রি করবেন। কৃষকরা বলেন, বন্যার পানি শুকিয়ে গেলে জমিতে পলি পড়বে। ফলে এর পরবর্তী ফসল গম, পায়রা, কাওন, আলু, খেসারী, মাসকালাই ভাল হবে।
বাবুপুর গ্রামের বন্যাঃ
টাঙ্গাইল জেলার দেউলী ইউনিয়নের বাবুপুর গ্রাম। এই গ্রামের উত্তরে পাকুল্লা, পশ্চিমে গালুটিয়া, আত্রাব, আলালপুর, ঝুনকাই গ্রাম। পূর্বে ছিলিমপুর, দক্ষিণে মাইঠান গ্রাম। ২দিন আগেও এই গ্রামের মাঠে শুধু সবুজের সমারোহ দেখা যেত। কিন্তু গত ২দিন ধরে গ্রামে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। কৃষক মংলা মিয়া, জিন্নত আলী, মেনহাজ মিয়া বলেন, যমুনার পানি ধলেশ্বরী নদীতে মিশেছে। আর ধলেশ্বরীর পানি আমাদের গ্রামে ঢুকছে। পূর্বে ছিলিমপুর বাজারে যেতে এলেংজানী নদী পড়ে। এই নদীর পানিও তার কাছাকাছি মাঠের ফসল ডুবিয়ে দিয়েছে। মাঠে চাষাবাদ করা ধানের মধ্যে রয়েছে ঢেপা, পাটজাগ, ময়নাগিরি, পাতিশাইল, বিআর-১১, বিআর-২৯, কালিজিরা, চামারাদিঘা, নাজিরশাইল। বন্যার পানিতে বিআর-১১, বিআর-২৯ আগেই মারা যাবে। দেশি জাতের সঙ্গে আধুনিক জাতের এখানেই পার্থক্য। বাংলাদেশের কৃষকরা আভাওয়া ও নদীর আচরণ খেয়ালে রেখে ধানের জাত আবিষ্কার করেছে, আর বিজ্ঞানীরা করেছেন ল্যাবরেটরিতে। দেশী জাত নদীর টানা পানি এলে ১০দিন পরেও ভাল থাকবে। কিন্তু পানির সাথে কাদা থাকলে ধান টিকবে না। ঘোলা পানি নদীমুখে গেলে ধান নষ্ট হবে না। আউশ ধান পানিতে তলিয়ে গেলে টিকবে না। বৃষ্টি দেখে অনেক কৃষক আনাচে কোনাচে সব জায়গায় ধান রোপন করেছে। কিন্তু বন্যা হবে বুঝে নাই। কৃষক এনছাদ আলীর ৫০ ডিসিমাল জমির বেগুন, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটা কোমড় পানি পর্যন্ত ডুবে গেছে। কৃষক লালমিয়ার ৩০ ডিসিমাল জমির লালশাক, ডাঁটা ক্ষতি হয়েছে। কৃষক ময়েনউদ্দিনের ২৪ ডিসিমাল জায়গার মূলা নষ্ট হয়েছে। কৃষক জিন্নত আলীর ১০ ডিসিমাল জমির বেগুন, সীম পানিতে তলিয়ে গেছে। নদীর পাড় ভেঙে যাওয়ায় পানি এসে বাড়ির পালানে চাষ করা লাউ, সীম, মরিচ, বেগুন, ঢেঁড়স, মিষ্টিকুমড়া, বাঙ্গি, ডাঁটা ডুবিয়ে দিয়েছে। গত বছর বেশি পানি হয় নাই বলে এই বছরও তাইধবে ভেবে কৃষকরা বাড়ি, ক্ষেতের আইলে লাউ, বেগুন, চালকুমড়া, মরিচ রোপন করেছেন্ কিন্তু ভারী বৃষ্টি এবং বন্যার পানি এসব তলিয়ে দিয়েছে। এরকম পানি গ্রামে ঢুকবে কৃষকরা বুঝতে পারে নাই। এক ডিসিমাল জমি চাষ দিতে ৩০ টাকা লাগে। এরকম কৃষকদের হাজার হাজার টাকার ফসল নষ্ট হওয়ার পথে। কৃষক ইনছান মিয়ার ১০ডিসিমাল জায়গার মিষ্টিকুমড়া পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষক মংলা মিয়ার ১২০ ডিসিমাল জায়গার নাজিরশাইল, ময়নাগিরি ধান ক্ষেত পানিতে ডুবে যাওয়ায় সমস্ত ক্ষেত মনে হচ্ছে সাদা হয়ে গেছে। কৃষক সুরিয়া বেগমের ৬০ ডিসিমাল জমির কালিজিরা, ময়নাগিরি পানির নিচে। কৃষক সরাজ মিয়ার ৫০ ডিসিমাল জমির পাতিশাইল, ময়নাগিরি ধানও পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষক কহিনুর বেগমের ৮০ ডিসিমাল জমির ময়নাগিরি, ঢেপা, মেনহাজ মিয়ার ৫০ ডিসিমাল জমিন ময়নাগিরি ধান ডুবে গেছে। মাঠে চাষ করা কৃষকদের বেগুন, মরিচ, পুঁইশাক, ডাঁটা, মূলা, সীম ডুবে গেছে। কৃষকরা বলেন, আগামী ১০দিনের মধ্যে পানি না সরলে কোন ফসলের বীজ রাখা সম্ভব হবে না। বীজের সংকট হবে। বাবুপুর গ্রামের পাশের গ্রাম আত্রাব, আলালপুর, ঝুনকাই, বেঙরাইল গ্রাম এখন পানিবন্দী। বাড়ি থেকে কেউ বের হতে পারছে না। চলার জন্য নৌকাও নাই। নিরুপায় হয়ে গ্রামের মানুষ কলার ভেলায় করে যাতায়াত করছেন। পানির তীব্র স্রোতে আলালপুর গ্রামের রাস্তা ভেঙে গেছে। দেউলী গ্রামের সুইজগেটের পাশ ভেঙ্গে পানির স্রোত ছুটছে। সরকারীভাবে ২ বার মেরামতের কাজ করেছে তবু ঠিক রাখতে পারছে না। অনেক কৃষকের ধান পাকা শুরু হয়েছে কিন্তু পানি না সরলে এই ধানের বীজ হবে না। যেসব কৃষকরা আগর মূলা, পুঁইশাক বপন করেছেন তাদের বীজ সংকট হবে। কৃষকদের বীজ হাতছাড়া হয়ে যাবে। যেভাবে পানি আসা শুরু হয়েছে এভাবে আসলে পানি গলা পর্যন্ত হবে। গরু, ছাগল নিয়ে গ্রামের মানুষ বিপাকে পড়েছেন।
গোখাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সড়ক ছাড়া গরু, ছাগল নিচে নামানোর উপায় নাই। কোন উপায় না পেয়ে গরু-ছাগলকে আম পাতা, কাঁছঠাল পাতা, পাটপাতা খাওয়াতে হচ্ছে। হাঁস-মুরগীর ঝিমুনী রোগ দেখা দিয়েছে। মানুষের জ্বর, সর্দ্বি-কাশি রোগ দেখা দিয়েছে। কৃষক আঃ জব্বার, মেনহাজ মিয়া বলেন, তবে বন্যার পানিতে মাছের সংখ্যা বাড়ছে। ধান ক্ষেতে খৈলসা, দারকিনা, পুঁটি, টাকি, বাইম, কৈ, টেংরা, চিংড়ি চান্দা মাছ ধরা পড়ছে। বন্যার পানি নামলে বড় বড় রুই, কাতল, বোয়াল, শৈল মাছ ধরা পড়বে। কৃষকরা বলেন, প্রবল বৃষ্টি আর বন্যায় ধানের যে ক্ষতি হবে তা আর রক্ষার কোন উপায় নাই। কৃষকদের হাতে ধানের বীজ আর নাই। আর ধান লাগানোরও সময় আর নাই। ২/১জন কৃষকের হাতে সীম বীজ আছে তারা মাটির পাতিলে করে চারা তৈরী করছেন পানি কমে যাওয়ার পর রোপন করবেন। পানি কমে গেলে জমিতে পলি পড়বে তখন সরিষা, মাসকালাই, খেসারী লাগালে ফলন ভাল হবে।