পাটের মধ্যে আউশ ধানের আবাদ করে সফল কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষকেরা
নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের খলিসাডাঙা নদীর পার দিয়েই কৃষ্ণপুর গ্রামের অবস্থান। কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষকেরা কৃষি শুরু থেকে পাটের আবাদ করে আসছে।তবে পাটের দর বাজারে কম থাকায় এবং খরচ বেশি হওয়ায় এবং পাট কেটে জাগ দিতে না পারায় আস্তে আস্তে পাট চাষের উপর আগ্রহ কমে আসছিল।উবিনীগ, প্রাণবৈচিত্র্যে সামাজিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্প অত্র এলাকায় কাজ করার ফলে সামাজিকভাবে পরিবেশ,প্রাণবৈচিত্র্যে বৃদ্ধি হওয়ায় কৃষকরা বর্তমানে স্থানীয় জাতের অনেক চাষাবাদই এখন ফিরে পেয়েছে। কৃষকরা এখন দূর্যোগ মোকাবেলা সক্ষম বিভিন্ন মৌসুমের বীজও নির্বাচিত করতে পেরেছে।যারফলে পাটের মধ্যে দেশি,তোষা এবং আউশ ধানের মধ্যে ৯টি খড়া সহি্ষ্ণু (কালাবকরি,শনি, সাইটা,খড়াজামড়ি,মুলকে আউশ, ভইরা,ভাতুরি,শঙ্খপটি এবং কালো মানিক) জাত নির্বাচন করে আবাদ করতে পারছে। গত ৩ বছর যাবৎ কৃষকরা পাটের মধ্যে আউশ ধান ছিটিয়ে পাট এবং আউশ ধানের ভালো ফলন পেয়েছে পাশাপাশি পাট এবং আউশের জাতগুলোও সংগ্রহ করতেও পারছে।আউশ ধানের ভাত খেতে খুবই সুস্বাদু এবং খড় গরু খেতে বেশি পছন্দ করে। কৃষকরা মনে করেন আউশের পান্তা ভাত খেয়ে রোঁদে পুড়ে বেশি কাজ করা যায়।
কৃষকরা চৈত্র মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পাট রোপন করেন । আর পাট কাটার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে কোন রকম চাষ ছাড়ায় পাটের জমির মধ্যে আউশ বীজ ছিটিয়ে দেয় ।আউশ ধান ঘন থাকলে পাট কাটার পর তুলে খালি স্থানে রোপন করা হয় এবং ঘাস পরিষ্কার করা হয়। কাজ এতটুকুই।
প্রতিটি কৃষক ৩৩ শতক জমিতে ১০ মন পাট পায় যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০.০০০/= টাকা এবং পাটের সুলা বিক্রয় করে আয় হয় ৩০০০ টাকা। আর ৩৩ শতক জমিতে পাট করতে খরচ হয়েছে মাত্র ৩০০০ টাকা।খরচ বাদ দিয়ে ৩৩ শতক জমি থেকে পাট বাবদই লাভ পায় ২০.০০০/= টাকা।
আর একই পাটের জমি থেকে আউশ ধান সর্বনিম্ম পাওয়া যায় ৮ মন যার সম্ভাব্য মূল্য ৫৬০০/= টাকা এবং খড় পাওয়া যাবে ১৫ মন যার মূল্য প্রায় ৩২০০ টাকা।আর খরচের মধ্যে শুধু ধান কাটা এবং মাড়াই করতে ৪টি শ্রমিক লাগে, শ্রমিকের খরচ বাবদ ১২০০ টাকা।আউশ ধান কাটার উপযোগি হয় কার্তিকের মধ্যে। খরচ বাদ দিয়ে আউশ ধানের একই জমি থেকে লাভ হয় আরো ৭৬০০/=টাকা। পাট এবং আউশ ধানের সব খরচ বাদ দিয়ে মোট লাভ হয় ২৭৬০০/= টাকা। এই পদ্ধতিতে কৃষকরা এখন সফল ।
আমাদের দেশে পাটকে সোনালি আঁশ বলা হয় কারণ পাটের আশেঁর রঙ সোনালি এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ২৫ শতাংশ আসে এ থেকে। পাট থেকে বিভিন্ন প্রকার পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন হয়ে থাকে। যেমন-সুতা,থলি ,চট,দড়ি,সুতলি।পাট দ্বারা বিভিন্ন প্রকার পর্দা,কার্পেট, জায়নামাজ,ত্রিপল, গালিচা,গদি,শিঁকা,আসন, পাটখড়ি, কাগজ, হার্ডবোর্ড তৈরি করা হয়।পাট উৎপাদনে বিশ্বে এশিয়া মহাদেশই প্রথম।বিশ্বে ৯৫ শতাংশ পাট এশিয়ায় জন্মে।পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম।
তোষা পাট প্রধানত উঁচু জমিতে ভালো জন্মে তবে দেশি পাট নিচু,মধ্যম ও উঁচু সব প্রকার জমিতে জন্মাতে পারে।আর সব পাটের থেকে তোষা পাটের আঁশ সবচেয়ে সুক্ষ্ণ,মসৃন এবং শক্ত হয়।পাট থেকে কাপড় এবং পাটজাত দ্রব্য তৈরিতে তোষা পাট সবচেয়ে ভালো হওয়ায় সব পাটের থেকে দামও অনেক বেশি পায় কৃষক।
এছাড়াও পাট যেহেতু শিকড় লম্বা হয় যার ফলে মাটির অনেক ভিতরে যায় শিকড় তোলার সময় এবং আউশ ধান কাটার পর ধানের শিকড় (নাড়া) তোলার সময় জমির মাটি নিচের মাটি উপরে এবং উপরের মাটি নিচে মিশ্রিত হয় কৃষকের মতে এই পদ্ধতি হলো প্রাকৃতিক চাষ আর চাষের পর জমিতে খুব একটা চাষ করতে হয় না ঠিক তখনি কৃষকরা জমিতে রসুন রোপন করেন। রসুন রোপন করার পর রসুনের উপরে আউশের খর এবং অবশিষ্ট অংশ (নাড়া) দিয়ে মালচিং করতে পারেন এবং এই পদ্ধতিতে কম খরচে বেশি ফলন পাওয়া যায়।আরেকটি গুরত্বপূর্ন বিষয় হলো পাট জমিতে থাকা কালিন সময় পাটের পাতা পচেঁ জমিতে মেশার ফলে জমির উর্বরতা এবং পোকা-মাকড়ের আক্রমন একেবারেই কমে যায়।নয়াকৃষি কৃষকের নিজ চেষ্টায় এবং নিজেদের লোকায়েত জ্ঞানের সফল একটি পদ্ধতি কম খরচে পাটের মধ্যে আউশ ধানের আবাদ (একরে মধ্যে দুই ফসল) করা।এবং এই আবাদটি কৃষকের বড় একটি অর্জন।
আমরা নিজেদের মধ্যে এবং নিজেদের পরিচীতদের মধ্যে এই জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়ে আমরা এখনো পারি দেশের হারিয়ে যাওয়া সোনালী আঁশ আবার ফিরে পেতে।