দাই মা সম্মেলন-২০১৪ দাইমাদের স্বীকৃতি দিন
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের মগনামা পাড়া নোনাবাড়ি বিদ্যাঘরে উবিনীগের আয়োজনে ‘নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষায় দাইমাদের স্বীকৃতি দিন, শীষর্ক এক দাই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখে সকাল ১০ টায়।
শিখিপড়ি বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা তাদের আঞ্চলিক ভাষায় একটি দেশের গান দিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
গানের কথা
মারে আরন পেলাইচ চোখর পানি
মুছি ফেল মা আচঁল টানি।
দেশের লাগি যুদ্ধ গরি জীবন করলাম শেষ
তার বদলে দিলাম তোর এককান স্বাধীন দেশ।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ছিল দাইমা এবং সরকারী পর্যায়ের কর্মকর্তা। দাইমাসহ মোট অংশগ্রহণকারী ছিল ৭০ জন। দুইটি জেলা এবং তিনটি উপজেলার দাইমারা এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।জেলা দুটি হচ্ছে কক্সবাজার ও বান্দরবান। উপজেলা হচ্ছে লামা, মহেশখালী, চকরিয়া। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সাবেক ইউপি সদস্য ও নয়াকৃষি আন্দোলনের নেত্রী শাকেরা বেগম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাফিয়া বেগম সম্পা, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, চকরিয়া, কক্সবাজার। বিশেষ অতিথি: হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. মর্তুজা বেগম রানু ও হাবিবা জামান, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, চকরিয়া।
আরো উপস্থিত ছিলেন লামা পৌরসভার কাউন্সিলর, জোসনা বেগম, বদরখালী ইউপি সদস্য আনোয়ারা হাকিম, মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুর ইউপি সদস্য মনোয়ারা বেগম। ফরিদা ইয়াসমিন, সহকারী শিক্ষক, বদরখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাশেদা বেগম, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা,বদরখালী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।
সকাল থেকে ৪ টি দাইঘরের দাইমারা যখন দলে দলে সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করেন এবং একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করেন। তখন এক সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সম্মেলন কক্ষটি সাজানো হয়েছিল চারিদিকে সাদা কাপড় দিয়ে। টেবিলে বিছানো ছিল নীল রংগের টেবিলক্লথ। ফুল না থাকায় ফুল দানিতে সাজানো হয়েছিল বিলাতি ধনিয়ার ফুল দিয়ে। অপূর্ব সুন্দর লাগছিল এই সম্মেলন ক্ষটি।
সম্মেলনে সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ প্রকল্পের পি এফ এইটি সদস্য সারথী রানী দাস।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন উবিনীগের কক্সবাজারের আঞ্চলিক সমন্বক রফিকুল হক টিটো। মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ প্রকল্পের পক্ষ থেকে প্রাথমিক বক্তব্য রাখেন রোকেয়া বেগম, স্বাস্থ্য গবেষক, উবিনীগ, ঢাকা।
চারটি দাইঘরের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন: মা অং মার্মা, বান্দরবান, লামা, আনছারা বেগম, উত্তর নতুন ঘোনা, ফরাস খাতুন, পশ্চিমপাড়া, মমতাজ বেগম, মগনামা পাড়া।
দাইমারা বলেন মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু রোধ করার জন্য দাইঘরের মাধ্যমে আমরা কাজ করছি। গর্ভবস্থায় ৪ বার চেকআপ করানোর পরামর্শ দেই। টিকা দিতে বলি। জন্মের পর বাচ্চাকে শাল দুধ খাওয়াতে বলি। আমরা ৫টি ঝুঁকি চিনে রেফার করি। পুষ্টি পরামর্শ দেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা ওজন মাপি, প্রেসার মাপি। প্রশিক্ষণ থেকে তথ্য নিয়ে কাজে ব্যবহার করি। কোন জটিল সমস্যা হলে আমরা রোগীকে সরকারি হাসপাতালে পাঠাই। প্রয়োজনে আমরা রোগীর সাথে সরকারি হাসপাতালে যাই। বান্দরবান থেকে আসা দাইমা মা অং মার্মা বলেন আমাদের ওখানে কোন সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র নাই। দাইঘর হওয়ায় আমাদের এলাকার জনগণের অনেক উপকার হয়েছে। ঝুঁকি চিনে দাইমারা হাসপাতালে রেফার করতে পারছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করার জন্য মহিলাদের নিয়ে আলোচনা সভা করে থাকি। বাল্যবিয়ের খবর পেলে এলাকার চেয়ারম্যানকে জানাই।
সম্মেলনে বক্তারা বলেন প্রসবকালীন সময়ে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দাইমাদের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দাইমায়েরাই পারে একজন নতুন অতিথিকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখাতে। অভিজ্ঞ ও দক্ষতা ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব না ধাত্রীকাজ করা। দাইমাদের বক্তব্য শুনে গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. মর্তুজা বেগম রানু বলেন আমি আপনাদেরই একজন। আপনারা শুধু দাই না আপনারা দাই মা। আমি আপনাদের সালাম জানাই। কারণ আমি হাসপাতালে কাজ করি আপনারা গ্রামে কাজ করেন। আপনারা যদি না থাকতেন তাহলে এদের বিপদে আপদে এদের পাশে কে থাকত? আমি তো শুধু বাচ্চা বের করে দিয়েই খালাস। আপনারাতো গর্ভবাবস্থা থেকে শুরু করে প্রসবের পর পর্যন্ত তাদের খোজ খবর রাখেন। আমি আশা করবো আপনারা প্রসবকালীন সময়ে আরো যতœ ও দায়িত্ব সহকারে কাজ করবেন। কোন সমস্যা হলে আপনারা আমার কাছে যাবেন আমি আপনাদের সহযোগিতা করবো। ক্লিনিকে নিবেন না তা হলে গরিবের সহায়তা হবে না। সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা পাবে। আমার জন্ম দাইয়ের হাতে। আপনারা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাই আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।
জোৎস্না বেগম কাউন্সিলর, লামা পৌরসভা। দাইমারা মা ও শিশুর জীবন রক্ষা করার কাজ করছেন। কিন্ত্র তামাকের যে ক্ষতির দিক তা খুব ভয়াবহ। আমাদের এলাকায় মহিলারা তামাক চাষের সাথে জড়িত। তারা সব সময় অসুস্থ থাকে। ক্যান্সার, কিডনী নষ্ট হওয়া, শ্বাসকষ্ট, নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। গর্ভাবস্থায় মহিলারা যদি তামাক পুড়ানোর কাজ করে তা হলে অনেকের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। দাইমাদের কাছে আমার দাবি তামাকের ক্ষতির হাত থেকে মা ও শিশুদের রক্ষা করতে হবে।
হাবিবা জাহান, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা চকরিয়া। গর্ভবতী মায়েরা গর্ভবস্থায় যেন নির্যাতনের স্বীকার না হয়। আপনারা সে দিকে খেয়াল রাখবেন। নির্যাতন হলে আমার অফিসে গেলে আমি তাদের সহযোগিতা করবো। বাল্যবিয়ে যাতে না হয় সে দিকেও আপনারা খেয়াল রাখবেন। বাল্যবিয়ে হলে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যাবে। মাতৃত্বভাতা, ভিজিডি কার্ড থেকে গরিব মায়েরা যেন বাদ না পড়ে সেদিকে আপনারা খেয়াল রাখবেন।
ফরিদা ইয়াসমিন, শিক্ষক বদরখালী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। নেপোলিয়ান বলে ছিলেন আমাকে একটি সুস্থ মা দাও। আমি একটি সুস্থ জাতি উপহার দেবো। অল্প বয়সে বিয়ে হলে সে মা ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে বাল্যবিয়ে বন্ধ করার জন্য কাজ করি।
সাফিয়া বেগম, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, চকরিয়া। দাই সম্মেলনে আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করার জন্য দাইমাদের কাছে দাবি জানান। নির্যাতন প্রতিরোধ করার জন্য কাজ করার দাবি জানান। দাইঘরের জন্য সহযোগিতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
সভাপ্রধান সাকেরা বেগম, সাবেক ইউপি সদস্য ও নয়াকৃষি আন্দোলনের নেত্রী। ভাইস চেয়ারম্যানকে দেখে আমরা খুশী হয়েছি। আমাদের দাইঘর যাতে স্থায়ী হতে পারে তার জন্য আপনার সহায়তা চাই। সবাই দেশীয় বীজ হাতে রাখবেন। বাড়ির আঙ্গিনায় শাক সবজি ও ফলের চাষ করে মাদের পুষ্টির নিশ্চয়তা দেবেন।