সত্যেন্দ্রনাথ বসু: একজন বিজ্ঞানী, একজন দেশব্রতী
ছোটবেলায় স্কুলে অংক পরীক্ষা দিয়ে ফিরলে অনেকেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘অংকে ১০০-র মধ্যে ১১০ পাবে তো?’ কথাটির মানে তেমন বুঝতাম না। এখনও বিজ্ঞাপনে বলতে দেখি, ‘ ১০০-র মধ্যে ১০০ পেয়েছি আর কি করে বেশী নম্বর পবো’? তবে সত্যিই এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি কথাটি সত্যি প্রমাণ করেছিলেন। অথবা বলা যায় তাঁর জন্যই কথাটি প্রচলিত হয়েছে। আর তিনি-ই সত্যেন্দ্রনাথ বসু। হিন্দু স্কুলে এন্ট্রান্সের টেষ্ট পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথ অঙ্কের সব প্রশ্নগুলির উত্তর তো করেছিলেনই, উপরন্ত জ্যামেতির প্রশ্নগুলি একাধিক উপায়ে সমাধান করে দেন। অংকের শিক্ষক শ্রী উপেন্দ্রনাথ বকসী খুশি হয়ে তাঁকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছিলেন।
আজ তাঁরই কিছু কথা এখানে তুলে ধরছি।
আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রথম ও প্রধান পরিচয় তিনি বিজ্ঞানী। বিদেশীদের কাছে তিনি ছিলেন শুধু ‘বোস’। তাঁরই নামে বহু মৌলিক কণার নাম ‘বোসন’ (Boson)। বিজ্ঞান কলেজের ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন পরম প্রিয় ‘মাস্টারমশাই’। তাঁর কাজের আংশিক তালিকা হলো- সংখ্যায়ন, কণাবিদ্যা, আপেক্ষিকবাদ, বর্ণালী, এক্স রশ্মি, বলবিদ্যা, জৈবরসায়ন, অখন্ড ক্ষেত্রতত্ত্ব, উচ্চবায়ুমন্ডল। আধুনিক বিজ্ঞানের নানা শাখার জটিলতা তিনি আয়ত্ব করেছিলেন। তাঁর গবেষণা শুধু তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যায় নয়। পঞ্চম দশকে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে বসে তিনি নিজের হাতে ও নিজের তত্ত্বাবধানে একটি যন্ত্র তৈরী করেন। যন্ত্রটির নাম-“ স্ক্যানিং স্পেক্ট্রো ফটোমিটার (Scanning Spectro Photometer। যা আমাদের কাজের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ব্যবহার হচ্ছে।
এ ছাড়া তাঁর আরও একটি বিশেষ পরিচয় আছে তিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে দেশের সর্বসাধারণের কাছে বিজ্ঞানের কথা প্রচার ও প্রসার করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য তাঁর ঐকান্তিক ও নিরলস প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। স্নতকোত্তর শ্রেণীতে, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে, দুঃসাহসের সঙ্গে তিনি উচ্চতম ও জটিলতম বৈজ্ঞানিক বিষয়ের বক্তৃতা দিয়েছেন বাংলায়। নিজের সারা জীবন ধরে তিনি নিজেই প্রমাণ করে গেছেন নিজের কথা-“ যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান হয় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না”।
ছাত্রাবস্থা থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের গভীর অনুরাগী এবং সাহিত্য-চর্চায় আগ্রহী। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথের রচনা শুধু যে প্রকাশভঙ্গীতে সহজ ও প্রাঞ্জল তা নয়, তাঁর লেখার মধ্যে যথেষ্ট সাহিত্যিক মুনশীয়ানার পরিচয়ও পাওয়া যায়। কিশোর বয়সেই তাঁর বাংলা ভাষায় যথেষ্ট দখল ছিল। সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত বাংলা বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ “ বিজ্ঞানের সংকট” (পরিচয়, শ্রাবণ ১৩৩৮)।
১৮৯৪ খৃস্টাব্দের ১ জানুয়ারি উত্তর কলিকাতার গোয়াবাগান অঞ্চলে স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলের পাশে ২২ নং ঈশ্বর মিল লেনে সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন রেলওয়ের হিসাব রক্ষক এবং মা আমোদিনী দেবী ছিলেন আলিপুরের খ্যাতনামা ব্যবহারজীবী (আইনজীবী) মতিলাল রায়চৌধুরীর কন্যা।
সত্যেন্দ্রনাথের শিক্ষাজীবন শুরু হয় নর্মাল স্কুলে। পরে সত্যেন্দ্রনাথ বাড়ির একেবারেই কাছে নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে ভর্তি হন। সেই স্কুলে মেধাবী ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কোন উপযুক্ত সহপাঠী না থাকায় এন্ট্রান্স ক্লাশে সত্যেন্দ্রনাথকে হিন্দুস্কুলে ভর্তি করে দেন তাঁর পিতা। ১৯০৮ খৃস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষার দুই দিন আগে সত্যেন্দ্রনাথ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সে বছর তিনি পরীক্ষা দিতে পারেন নি। পরের বছর ১৯০৯ খৃস্টাব্দে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন এবং পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে আই. এস. সি ক্লাসে ভর্তি হন। বিজ্ঞানের ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথের সাহিত্যেও যে অসাধারণ আগ্রহ ছিল তার একটি বিবরণ পাওয়া যায়। ঐ সময় ইংরেজির অধ্যাপক হিসাবে পার্শিভালের খুব সুনাম ছিল। তিনি আই. এস. সি’র টেষ্ট পরীক্ষায় ইংরেজি রচনা বিষয়ে উত্তরগুলি পরীক্ষা করেন এবং সত্যেন্দ্রনাথের খাতায় ৬০+১০ লিখে অতিরিক্ত দশ নম্বর দেওয়ার কারণ হিসাবে মন্তব্য করেন যে, ছাত্রটি অসাধারণ, এর নিজস্ব কিছু বলার আছে।
১৯১১ খৃস্টাব্দে আই. এস. সি, ১৯১৩ খৃস্টাব্দে বি. এস. সি (গণিতে অনার্স) এবং ১৯১৫ খৃস্টাব্দে এম. এস. সি (মিশ্র গণিতে) এই তিনটি পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৯২১ খৃস্টাব্দে তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ব’বিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার রীডার হিসাবে যোগদান করেন। ১৯২৫ খৃস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ব’বিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে তিনি দু’বছরের জন্য ইউরোপ যান। ১৯২৭ খৃস্টাব্দে ইউরোপ থেকে ফিরে এসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন এবং পরে বিজ্ঞান বিভাগের ডীন হন। তিনি বিশ্ব’বিদ্যালয় সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘কেবলমাত্র বিদ্যা অর্জন ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে সহায়তা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, মতবাদ, ধনী, দরিদ্র এবং সামাজিক ও বংশমর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ যে মূলত এক, এই শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রচার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানুষই যে পরম সত্য আমাদের সেই জ্ঞান হোক’। ঢাকায় অবস্থানকালীন ১৯২৯ খৃস্টাব্দে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের পদার্থবিদ্যা শাখার সভাপতিত্ব করেন এবং ১৯৪৪ খৃস্টাব্দে মূল সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।
দীর্ঘ ২৫ বছর ঢাকায় অধ্যাপনার পর তিনি পুনরায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন এবং পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন হন। ১৯৫৬ খৃস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘এমেরিটাস প্রফেসর’ হিসাবে নিয়োগ করেন। এর মধ্যেই ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি বিশ্বভারতীর উপাচার্য পদ গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ থেকে প্রায় তিন বছর সত্যেন্দ্রনাথ এই পদে থাকার পর ভারতসরকার ১৯৫৯ খৃস্টাব্দে তাঁকে পদার্থবিদ্যার জাতীয় অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ঐ পদেই আসীন ছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথের আর এক পরিচয় ছিল, দেশব্রতী সত্যেন্দ্রনাথ। ইংরেজ শাসনের সেই প্রচন্ড দাপটের কালেই অনুশীলন সমিতির সঙ্গে ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। বিপ্লবীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ এবং এই উদ্দেশ্যেই সমাজ সেবার নানা ক্ষেত্রের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় সংযোগ। তিনি বলেছিলেন,‘আমাদের জাতীয় পতাকা জীবনের সর্বক্ষেত্রে উচ্চে তুলে ধরার জন্য যদি আমরা মিলিতভাবে চেষ্টা করি তাহলে ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝি ও নির্বোধ ঈর্ষা নিশ্চিতই সহজে দূর করা যাবে’।
১৯৭৪ খৃস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঈশ্বর মিল লেনের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তথ্য সূত্র: সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ।