আর্সেনিকঃ কৃষিতে হুমকি
আর্সেনিক একটি মৌলিক পদার্থ। পানি, মাটি, বায়ূসহ সকল অজৈব এবং জৈব সত্তায় আর্সেনিক বিদ্যমান। ভূ-উপরিভাগের ২০তম, সমুদ্রে ১৪ তম এবং মানব দেহে ১২ তম পদার্থ আর্সেনিক।
আর্সেনিক আবিষ্কারের (১২৫০ খৃ:) পর থেকে মানব ইতিহাসে আর্সেনিক তর্ক বিতর্কের কেন্দ্র জুড়ে আছে। ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। শুধু ওষুধ কেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন কৃষি, পশু সম্পদ, ইলেকট্রোনিক্স, শিল্প, ধাতব শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে এর ব্যবহার চলে আসছে। তবে বিষ হিসাবেই আর্সেনিকের সর্বাধিক পরিচিতি। স্বল্প মাত্রায় ও অজৈব আর্সেনিক ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের মাটি আর্সেনিকে ভারী হয়ে উঠছে। মাটির তলার পানি তুলে সেচের ফলে দিনে দিনে মাটিতে আর্সেনিকের মাত্রা বাড়ছে। প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ১০ কেজি আর্সেনিক মাটির তলা থেকে উপরে উঠে আসছে।
আর্সেনিক একটি বিষাক্ত পদার্থ। সেচের পানি অথবা বালাই নাশকের সাথে আর্সেনিক ফসলে প্রবেশ করে। গাছ পালার দেহে আর্সেনিকের কোন উপকারিতা আছে বলে জানা যায় না। তবে এর মাত্রাতিরিক্ত অজৈব আর্সেনিকের উপস্থিতিতে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। প্রথমে গাছের শিকড় আক্রান্ত হয়। শিকড়ের বৃদ্ধি ও প্রসার কমে যায়। কান্ডে প্রবেশের পর গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, ফুল ও ফল ধরা কমে যায়। উচ্চ মাত্রার বিষক্রিয়ার ফলে গাছ মারা যায়। সাধারণ ভাবে গাছ পালা প্রতি কেজি মাটিতে ৪০ গ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক সহ্য করতে পারে। আর্সেনিকের উপস্থিতি এবং ঘনত্বের সাথে মাটিতে অণুজীবের উপস্থিতির বিপরীত মুখি সম্পর্ক রয়েছে। বলা বাহুল্য অণুজীব মাটির উর্বরতা বাড়াতে সহায়তা করে। তদুপরি আর্সেনিকের উপস্থিতি এবং ঘনত্ব মাটিতে জারক রসের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত করে।
বাংলাদেশের মাটিতে আর্সেনিক দূষণের ফলে ফসলের উৎপাদন কমছে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় ধানের সালোক-সংশ্লেষণ, বৃদ্ধি এবং ফলন কমছে (রহমান ২০০৭)। ধানে “ষ্ট্রেইট হেড” রোগ দেখা দিচ্ছে। ফলে ধানের বদলে চিটা হচ্ছে। মাশকালাই এর ফলন কমছে। পানি এবং মাটিতে সঞ্চিত আর্সেনিক কৃষি, পরিবেশ, উৎপাদিত শস্য, গৃহপালিত পাখী এবং মৎস্য সম্পদের উপর মারাত্বক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
মানব জাতির অবস্থান খাদ্য শৃঙ্খলের চূড়ায়। আর্সেনিকের শেষ ঠিকানা মানুষের শরীর। দীর্ঘদিন ধরে মানব দেহে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতির কারণে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগসহ আরো অনেক জটিল রোগ সৃষ্টি করতে পারে। চীন দেশে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে মানব দেহে আর্সেনিক সমস্যার মূল উৎস ৬০% চাউলের সাথে সম্পৃক্ত (সোহন,২০১৪)।
বর্তমানে বাংলাদেশে মাটি ও পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতির কারণে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদতা উভয়ই হুমকির সম্মুখীন ।
প্রতিকার: হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতির কোন ক্ষতি না করে প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি কাজ করে আসছেন। এ দেশে বার মাসে ছয় ঋতু। পরিবেশের সাথে সমন্বয় করে ঋতু বান্ধব জাত বাছাই করে ফল ফসলের আবাদ হচ্ছে। তবে গত শতাব্দির ষাটের দশক থেকে সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে ইরি ধান চাষ প্রবর্তনের পর থেকে পরিবেশের উপর জবরদস্তি শুরু হয়েছে। পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষা, কৃষি উৎপাদন সচল রাখা, খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপদতার স্বার্থে এ অবস্থার পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। মাটির তলার পানি তুলে সেচ নির্ভর বোরো ধানের আবাদ কমিয়ে বৃষ্টি নির্ভর আউশ ধানের আবাদ বাড়াতে হবে। রবি মৌসুমে মশুর ডাল, মুগডাল, খেশারি, ছোলা, গোলআলু, মিষ্টিআলু, পেঁয়াজ, রসুন, শাক সবজি, তরমুজ, বাঙ্গি, গম, ভুট্রা, পায়রা, জব ইত্যাদির আবাদ বাড়াতে হবে। রবি ফসল তোলার পর চৈত্র- বৈশাখ মাসে বৃষ্টি নির্ভর আউশ ধান/পাট/গ্রীষ্ম কালীন শাক-সবজি ইত্যাদিও আবাদ করতে হবে।
আউশ ধান বোনা এবং রোপা উভয় পদ্ধতিতেই করা যায়। মাটিতে বিদ্যমান আর্দ্রতায় আউশ ধানের বীজ ছিটিয়ে বোনা যায়। মাটিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে সেচের সাহায্যে বীজতলায় বীজ বুনে চারা তুলে বৃষ্টির পরে মাঠে রোপন করা যায়।
প্রচলিত ক্ষেত্রে বোরো ধান কাটার পর এবং আমন ধান রোপন করার মধ্যবর্তী সময় (বৈশাখ-শ্রাবণ) বৃষ্টি নির্ভর আউশ ধান আবাদ করা যায়। এ ক্ষেত্রেও মাটিতে পর্যাপ্ত আদ্রতা থাকলে বোনা আউশ ধানের আবাদ করা যায়। আর যদি বোরা ধান কাটার পর মাটিতে যথেষ্ট আর্দ্রতা না থাকে তা হলে সেচের সাহায্যে বীজতলায় চারা তুলে বৃষ্টির পর রোপা করা যায়।
জৈব সার, ফসফেট সার, ডাল জাতীয় ফসল, নীল সবুজ শেওলা ও সবুজ শেওলা, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি মাটিতে আর্সেনিকের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে।
তথ্যসূত্র:
1. Brammer H and Peter Ravens Croft. 2009. Arsenic in ground water: A threat to sustainable agriculture in South and South East Asia, Environment International, 35 (3); 647-854.
2. Haque A. A. M, H. M. Thwe H.P.W, Jayasuriya, M. Z. Hossain, M. Rahman
M. Harun-ur- Rashid and K. Matsumura, 2007.
C.MU.J. Nat Sci: 6 (2) 321
3. Mandal, B.K. KaruoT. Suzuki, 2002. Arsenic round the world: a review, Talanta 58: 2001-2035,
4. Rahman Azizur M ;Hasegawa H, Rahman MH, Islam NM, Mia NMA, Tasmen A. 2007.
Chemosphere 67 (6): 1072-9
5. Sohn E, 2014. Contamination: the toxic side of rice, Nature 514,S62-S63 doi:1038/514-S62a
6. Wang Xin & Lena Qiying Ma. 2014, In situ Remediation of Arsenic Contaminated sites, books.google.com.bd/books