বীজসম্পদের সামাজিক ব্যবস্থাপনায় নয়াকৃষি গ্রাম


নয়াকৃষি (প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা) আন্দোলনের কৃষকরা গত দুই দশক ধরে এলাকার উপযোগী ফসলের নানান বৈশিষ্ট্য বাছাই করে বৈচিত্রময় ফসলের চাষাবাদ ও একইসাথে তা সামাজিক ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণ করেছেন। তাদের হাতে –নাতে অনুশীলন ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ব এসব ফসল বন্যা, খরা, লবনাক্ততা ইত্যাকার আবহাওয়া ও জলবায়ুর নানান খামখেয়ালের সংগে খাপ খাইয়ে কৃষকরা চাষাবাদ করছেন। নয়াকৃষি অনুশীলনে কৃষকদের প্রাণসম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সমৃদ্বির পাশাপাশি জীবন জীবিকারও উন্নতি হচ্ছে।

টাংগাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার বাবুপরৃ, স্বল্পনাড়– ও মামুদপুর গ্রামে কৃষকদের নয়াকৃষি চর্চার নিদর্শন সত্যিই মনকে প্রফুল্লিত করে ও আনন্দ যোগায়। উবিনীগ এর সহায়তায় প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় সামাজিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আওতায় এরই মধ্যে গ্রামগুলোর চাষিরা প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় বহুবিধ সফল নজির স্থাপন করেছেন। নদীবিধৌত সমতল এলাকা অধ্যুষিত স্বল্পনাড়–, মামুদপুর ও বাবুপুর গ্রামের চাষাবাদ ব্যবস্থা ও জীবন জিবিকা এলাকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের আলোকেই গড়ে উঠেছে।

নয়াকৃষি বীজ আখড়া ও বীজ ব্যবস্থাপনা

নয়াকৃষি কৃষকদের বীজ ব্যবস্থাপনায় নিজেদের ঘরে বীজ সংরক্ষনের পাশাপাশি তারা নয়াকৃষি বীজ আখড়া ও নয়াকৃষি বীজ সম্পদ কেন্দ্রে বীজ সংরক্ষণ করছেন। নয়াকৃষি কৃষকদের এই বীজ ব্যবস্থানার অনুশীলন এলাকায় নয়াকৃষি বীজ সংঘ হিসেবে বহুল পরিচিত ও সমাদৃত। বীজ সংরক্ষনে চিরায়িত হাজার বছরের এতিহ্য ও সংস্কৃতির বাহক নারী কৃষকদের নেতৃত্বে নয়াকৃষি বীজ সংঘের মাধ্যমে বীজের বৈচিত্র্য বৃদ্বির ক্রমাগত সমৃদ্বি ঘটছে।

টাংগাইলের বাবুপুর, স্বল্পনাড়– ও মামুদপুর গ্রাম ঘুরে দেখা গেল নয়াকৃষি বীজ সংঘের নেতুত্বে এলাকার উপযোগী স্থানীয় জাতের বীজ ব্যবস্থাপনার প্রাচুর্য, ব্যাপ্তি ও সমৃদ্বি। বাবুপুর গ্রামে ৫৬, স্বল্পনাড়– গ্রামে ৫১ এবং মামুদপুর গ্রামে ৭৬ জাতের শস্য বীজ কৃষকরা নিয়মিতভাবে চাষাবাদ ও একইসাথে বীজ সংরক্ষণ করছেন। এসব শস্য বীজের মধ্যে প্রধানত রয়েছে ধান, গম, যব, কাওন, শাকসব্জি, ডাল, মসল্লা ও তৈলবীজ। নয়াকৃষির কৃষকরা নিজ নিজ ক্ষেতে ফসল চাষাবাদ ও বীজ উৎপাদন করছেন এবং উৎপাদিত বীজ পরবর্তী মৌসুমে চাষাবাদের জন্য ঘরে বীজ সংরক্ষণ করছেন। কৃষকদের সংগৃহীত বীজের একটি অংশ বীজ নিরাপত্তার স্বার্থে বীজ আখড়ায় সংরক্ষণ করছেন।

 পরিবেশ ও প্রতিবেশ উপযোগী ফসল উৎপাদন

পানি ও বন্যার সাথে সহবস্থানের মধ্য দিয়ে গ্রামগুলোতে প্রধান খাদ্য ফসল স্থানীয় জাতের ধান উৎপন্ন হয় বর্ষা মৌসুমে। পানিসহিষ্ণু ধানের জাতগুলোর মধ্যে প্রধানত রয়েছে চামারাদীঘা, হরিংগাদীঘা, ভাওয়াইলাদীঘা, পানিশাইল, কার্তিকঝোল, লতাশাইল, ঢেপা, বকঝোল, পাটজাগ ইত্যাদি। বন্যার পানির সাথে মিতালি করে এসব জাতের ধানগুলো পানির সাথে সাথে বেড়ে উঠে। পানির সাথে ধানগাছের এই বৃদ্বির মাত্রা কখনো ১০ -১২ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এমনকি কখনো কখনো বন্যার পানির প্রবল স্রোতে চামারাদীঘা ও পানিশাইল ধানের গাছের উপরের অংশ ছিড়ে গেলেও মূল ধানগাছের গীট থেকে আবার নতুন পাতার অংকুারোদগম হয়। স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকার ক্ষেত্রে বকঝোল জাতের আমন ধানের অবস্থান আরো প্রতিরোধী, সুদৃড় ও মজবুত। একটু ঘন গীটসমৃদ্ব এই ধান জোর বাতাসে হেলে পড়ে না, প্রবল স্রোতেও দন্ডয়মান থাকে স্বাভাবিক অবস্থার মতোই।

খরা সমৃদ্ব ধানের মধ্যে গ্রামগুলোতে আউশ ধানের আধিক্য বিদ্যমান। বর্তমানে চাষাবাদ করা আউশ ধানের জাতগুলো হচ্ছে কালামানিক, ষাইটা, ভাতুরী, শংকপটি, খাড়াজামরী, কালাবকরী ইত্যাদি। খরাসহিষ্ণু চাষাবাদ করা অন্যান্য ফসলগুলোর মধ্যে প্রধানত রয়েছে তিল, পাট (মেঘনাল), তিসি, কাওন ইত্যাদি।


dhandhan


কুয়াশা সহিষ্ণু ফসল হিসেবে কৃষকরা চাষ করছেন লাল মূলা, দেশী গম, মিষ্টি আলু, যব ইত্যাদি ফসল। রবি ও শীতকালীন ফসলের মধ্যে প্রধানত রয়েছে পায়রা, গম, ডাল, মসল্লা ও নানা রকমের শাকসব্জি।

গ্রামগুলোতে আবাদী ফসলের পাশাপাশি অনাবাদী ফসলের সমারোহও ব্যাপক। প্রায় ৩৯ জাতের অনাবাদী শাকের বিস্তৃতি এই গ্রামগুলোতে বিদ্যমান। গরীব ও প্রান্তিক চাষিরা বিশেষ করে নারীরা অতি যন্তে এসব কুড়িয়ে পাওয়া শাক সংগ্রহ করেন। মাঠে গরু, ছাগল চরানোর সময় শাড়ির আঁচলে করে শাক তুলে আসার সাথে হাসাহাসি ও গল্প করা তাদের এতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে তারা চর্চা করেন।

বীজ ও প্রাণসম্পদ ব্যবস্থানায় গ্রামগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ খাদ্য স্বার্বভৌমত্ব ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের একটি অনুপ্রাণিত নিদর্শন।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter