হাসছি মোরা আহ্লাদী
হাসির কারণ নির্ণয় করা কঠিন। আমরা কেন হাসি? প্রশ্নটা যত সহজ, জবাবটা ততো সহজ নয়। কারণ সারা জীবন আমরা কেউ সব সময় একই কারণে হাসি না। কেউ আছে হাসির কথা শুনলেই হাসে। কেউ অকারণে হাসে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী রবার্ট পুবিনের মতে, শুধু হাসির কথাতেই আমরা হাসি না। যেমন- নার্ভাস থাকলে, অতি উল্লসিত হয়ে উঠলে, চিন্তায় পড়লে, নিজেকে সুখী ভাবলে- এমন কি কারো কাছে কোন কারণে ধরা পড়ে গেলেও আমরা হাসি। তবে অকারণে যে কেউ হাসে না তা কিন্তু নয়। শিশুরা অকারণেই হাসে। আর বুড়োদের হাসির পিছনে কোন না কোন কারণ অবশ্যই আছে। প্রতিদিন ৪০০ বার হাসা তো চারটিখানি কথা নয়। আমরা কেন হাসি এ নিয়ে গবেষকরা যতই গবেষণা করুন সুকুমার রায় বলেছেন-
“হাসছি মোরা হাসছি দেখ, হাসছি মোরা আহ্লাদী
তিনজনেতে জটলা করে ফোকলা হাসির পাল্লা দি
হাসতে হাসতে আসছে দাদা আসছি আমি আসছে ভাই
হাসছি কেন কেউ জানে না, পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই”।
কে বেশী হাসে
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন গড়ে হাসে ১৫ বার। আর একজন শিশু প্রতিদিন গড়ে হাসে ৪০০ বার। তার মানে যত বয়স হবে, ততোই আমরা হাসতে ভুলে যাব কিংবা আমাদের হাসতে ভাল লাগবে না।
হাসিতে যা আছে
হাসিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। হাসির ফলে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীর আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে। হাসির ফলে শরীরে এনডোরফিন নামের একটি হরমোন তৈরী হয়। ছোটখাটো ব্যথা কমিয়ে দিতে এই হরমোন খুব কাজে লাগে।
হৃৎপিন্ড সুস্থ রাখতে হাসির জুড়ি নাই। হাসির ফলে হৃৎপিন্ডে রক্ত সরবরাহের গতি বাড়ে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও কমে যায়। হাসিতে বাড়তি মেদও কমে। নিয়মিত হাসিতে স্মৃতিশক্তি ও সৃজনশীলতাও বাড়ে।
১৯৯৫ সালে ভারতের এক ডাক্তার মদন কাটারিয়া আবিস্কার করেন, আমাদের মস্তিষ্ক নকল হাসি ও সত্যিকার হাসির মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। ডা. কাটারিয়া এটাও বের করেছেন যে নিজে নিজে হাসার চেয়ে দলবদ্ধ হয়ে হাসাটা অনেক সহজ। দুনিয়া জুড়ে হাসির ক্লাব আছে হাজার হাজার। আর এসব ক্লাবের সদস্য সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের প্রথম হাসির ক্লাবের নাম-হিলারস্ লাফিং ক্লাব। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে।
আর হাসির জন্য “ হাসি দিবস” ও আছে। মে মাসের প্রথম রবিবার।
হাস্যরসে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন ইতিহাসের তিন হাসিয়ে বাঙালী। রাজা বীরবল, গোপাল ভাঁড় ও দাদাঠাকুর। তাঁদেরই কিছু কথা তুলে ধরছি-
রাজা বীরবল:
কেউ বলেন তাঁর আসল নাম মহেশ দাস। কারও মতে, ব্রক্ষ্ম দাস। জন্ম বানারসে। বাবা আমীর-ওমরাহদের গান, শ্লোক, কবিতা ও চুটকি শুনিয়ে দু-চার পয়সা রোজগার করতেন। বাবার কাছ থেকেই চাটুকী বিদ্যা শিখেছিলেন। উপস্থিত বুদ্ধি ছিল অসাধারণ। ১৫ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর বিদ্যার্জনের জন্য হাজির হন লাহোরে এক পন্ডিতের কাছে। নিজেকে খাস ব্রাক্ষ্মণ পরিচয় দিয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। কিন্তু ধরা পরার পর তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। চলে যান দিল্লী স¤্রাট আকবরের দরবারে। গুণগ্রাহী আকবর বিশেষ এক দপ্তরে চাকুরী দিলেন তাঁকে। চাকুরীর পাশাপাশি বীরবল সুযোগ পেলেই স¤্রাটকে কবিতা, শ্লোক ও চুটকি শোনাতে লাগলেন। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিতেও মুগ্ধ হলেন আকবর। এইভাবে এক সময় আকবরের প্রিয় পাত্রে পরিণত হন। মন খারাপ হলেই আকবর বীরবলের কাছে চুটকি শুনতে চাইতেন। বীরবলের সেই গল্পগুলিই এখন সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে।
গোপাল ভাঁড়:
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজধানী কৃষ্ণনগরের উত্তরে ঘূর্ণি নামের এক গ্রামে গোপাল ভাঁরের জন্ম। গোপাল ছিলেন নাপিত। এমনিতে নাপিতরা বেশ চালাক-চতুর হয়ে তাকে। তার উপরে গোপালের ছিল সামান্য বিদ্যা ও প্রচন্ড উপস্থিত বুদ্ধি। এ কারণে কেউ তাঁকে কখন ঠকাতে পারে নি। গোপালের কান্ডকারখানা যতই হাস্যকর হোক, স্বভাবে ছিলেন ভীষণ গম্ভীর। তাঁর চেহারাটাই এমন ছিল, দেখা মাত্রই হেসে ফেলতেন সবাই। সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি হাসতেন না তবে অন্য মানুষকে হাসিয়ে মারতেন।
১৮৭৪ সালে বঙ্গভূষণ নামের একটি বই লিখেছিলেন কবি রাজকৃষ্ণ রায়। সেখানে রসিকরাজ গোপাল ভাঁরের নাম পাওয়া যায়। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা হাস্যরসে ভরিয়ে রাখতেন গোপাল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও গোপালকে খুব পছন্দ করতেন। রাজার অনুগ্রহে গোপালকে নাপিতগিরি করতে হয়নি। রাজাকে হাসিয়েই গোপাল নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ- সবই অর্জন করেছিলেন।
দাদাঠাকুর:
এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দাদাঠাকুর বললেন, বুঝলি সরোজ, তোদের বাড়িঅলা খুবই বৈষয়িক। বেশ বুদ্ধি। তারপর বাড়ির সামনের পেঁপেগাছ দেখিয়ে বললেন, ওই পেঁপেগাছটা সে কথাই বলছে। সরোজবাবু জানতে চাইলেন, এর সঙ্গে পেঁপেগাছের কি সম্পর্ক? দাদাঠাকুরের জবাব, ভাড়ার জন্য যাতে ভাড়াটেদের তাগাদা দিতে না হয়, সে জন্যই তো পেঁপেগাছ লাগিয়েছে তোদের চোখের সামনে। পেঁপেগাছটি অনবরত তোদের মনে করিয়ে দিচ্ছে পে, পে (Pay, Pay)।
কথার মারপ্যাঁচে এমন মজা করতে পারতেন দাদাঠাকুর। আসল নাম শ্রী শরৎচন্দ্র ঠাকুর। বীরভূম জেলায় তাঁর জন্ম। ছোটবেলায় ছিলেন ভীষণ চঞ্চল। স্মরণশক্তি ছিল তুখোড়। সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল অল্প বয়সেই। তাঁর কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল, আপনার জন্মদিন হয় না?
স্বভাবরসিক দাদাঠাকুর রসিকতা করেই নির্মম সত্যটা তখন জানিয়ে দিলেন, আমি এক জন্মদীন, তার আবার জন্মদিন কিরে?