সরিষার তেলে অনেক গুণ
প্রাচীন ভারতীয়, রোমান ও গ্রীক সভ্যতার আমল থেকে সরিষা তেল ব্যবহার হয়ে আসছে। ভারতীয় উপমহাদেশে খৃষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর থেকে সরিষার ব্যবহার চলে আসছে। ইদানীংকালে ভোজ্য তেল হিসাবে সরিষার ব্যবহার বেড়েছে। বহুদেশে সরিষার আবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, ক্রোয়েশিয়া, কলম্বিয়া, এসটোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গোরি, ভারত, ইটালি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোলান্ড, সার্বিয়া, শ্লোভেনিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ভাজি, ভুনি, ডাল, মাছ, মাংস, শাক, সবজি, সালাদ, স্যান্ডইউচ, হ্যাম বার্গার, হটডগ, ইত্যাদি খাবার তৈরীতে সরিষা ব্যবহার হয়। সরিষা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। সরিষার মধ্যে প্রচুর পরিমান ভিটামিন ও খনিজ লবণ রয়েছে। সরিষা শক্তি বধর্ক খাদ্য। প্রতি ১০০ গ্রাম সরিষা বীজে ৫০৮ ক্যালারি শক্তি রয়েছে। এ ছাড়া ও সরিষার মধ্যে আছে পুষ্টিমান সমুদ্ধ আঁশ ও আমিষ। সরিষার মধ্যে আছে নিয়াসিন (ভিটামিন বি-৩ ) যা রক্তে কোলেষ্ট্রোল কমিয়ে রাখতে সহায়তা করে। সরিষার মধ্যে ভিটামিন বি- কমপ্লেক্স যেমন ভিটামিন বি-৬, থায়ামিন, ফোলেট, প্যানটোথেনিক এসিড, রিবোফ্লাভিন ও নিয়াসিন রয়েছে যা শরীরের স্নায়ুতন্ত্র সতেজ রাখতে সহায়তা করে। সরিষার মধ্যে বিদ্যামান ভিটামিন -ই চামড়ার উজ্জল্য বৃদ্ধি করে এবং তারুন্য ধরে রাখে। সরিষার মধ্যে কপার ও আয়রন আছে যা রক্তে হেমেগ্লোবিন উৎপাদনে সহায়তা করে। সরিষার তেল ব্যবহারে ত্বকের কালো দাগ দূর হয়। চুল পড়া বন্ধ করে। চোখের নীচের কালোদাগ মিটিয়ে দেয়। বার্ধক্য প্রতিরোধ করে। খস খসে চুলের জন্য শ্যাম্পুর কাজ করে। সুন্দর এবং আর্কর্ষণীয় ত্বক গঠন করে। সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি এবং অন্যান্য দূষণ থেকে রক্ষা করে ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। ঘাম গ্রন্থি সতেজ করে শরীর থেকে বিষাক্ত দ্রব্য নিঃসরণে সহায়তা করে। ত্বকে ফুসকুরি এবং অন্যান্য সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। শীতের সময় ঠোট ফাটা প্রতিরোধ করে। চুল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। চুলের অকাল পক্কতা প্রতিরোধ করে।
ভোজ্য তেল হিসাবে সরিষা তেল বহুগুণে সমৃদ্ধ। ক্ষুধা বৃদ্ধি করে এবং হজম শক্তি বাড়ায়। সরিষা তেল ওমেগা- ৩, ওমেগা - ৬ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ স্বাস্থ্য কর ভোজ্য তেল। হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। ক্যান্সারের আশংকা কমায়। এজমা উপশম করে। ঠান্ডা কাশি প্রতিরোধ করে। গেটে বাত ব্যথা কমায় । ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
সরিষা একসময় বাংলাদেশের প্রধান ভোজ্য তেল ছিল। এখনও বছরে, ৫. ৩২ লক্ষ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয় এবং ৫.৯৬ মেট্টিক টন সরিষা বীজ উৎপাদিত হয় (ডিত্রই ২০১৩)। বাংলাদেশে বাৎসরিক ১৫ লক্ষ টন ভোজ্য তেল প্রয়োজন। এর প্রায় ৮০% বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত তেলের মধ্যে আছে সয়বিন ও পাম অয়েল।
সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি করে ভোজ্য তেলের চাহিদা নিজস্ব উৎপাদন থেকেই মেটানো সম্ভব। আমন ধান কাটার পরে বোরো ধান রোপনের আগে মধ্যবর্তি সময় সরিষার আবাদ করা যায়। তাছাড়া আশ্বিন কার্তিক মাসে যখন আমন ধান ক্ষেতের পানি শুকিয়ে যায় তখন ‘জো’ বুঝে ধানের মধ্যে সাথী ফসল হিসাবে সরিষা আবাদ করা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৫. ৩০ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয় এবং ৪৭.৯০ লক্ষ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয় (ডিএই ২০১৫ )। আমন ধান কাটার আগে ‘জো’ বুঝে হেক্টর প্রতি ৮-১০ কেজি সরিষা বীজ ছিটায়ে বোনা যায়। পৌষ মাসের মাঝা মাঝি সময় সরিষা তুলে ঐ জমিতে বোরো ধান রোপা করা যায়। আমন ধানের ক্ষেতে সাথী ফসল হিসাবে সরিষার আবাদ করা হলে প্রায় ৫০ লক্ষ টন সরিষা বীজ উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে। সরিষা বীজে ৪০ - ৪২% তেল হয়। এ ভাবে সরিষা উৎপাদন করলে দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা নিজস্ব উৎপাদন থেকেই মেটানো সম্ভব এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো যাবে।