যমুনা নদীর চর: কিশোরীদের কথা
বিশেষ করে স্কুলে যাবার সময় সামনে ছেলেদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে তখন ঐ পথে যেতে আমাদের ভয় করে। জানি ওরা হাসাহাসি করবে, খারাপ কথা শুনাবে। তাই আমরা একা স্কুলে যাই না। আমরা কয়েকজন মেয়ে একত্রে স্কুলে যাই। কয়েকজন মেয়েকে একত্রে দেখলে ওরা বেশী খারাপ কথা বলতে সাহস পায় না। আর যে মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় সে মেয়েদের ছেলেরা বিরক্ত করে না।’ কথাগুলো বলছিল বানতিয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী রিয়া। বয়স ১৬ বছর। দশম শ্রেণীর ছাত্রী।
শুধু রিয়া নয় ঐ স্কুলের আরও ছাত্রী রয়েছে - শারমীন আক্তার, মাজিয়া খাতুন, ঝর্ণা আক্তার, তানজিলা খাতুন, স্বপ্না আক্তার সাথী, আজমিনা পারভীন, দিলরুবা খাতুন, শিউলী খাতুন, রিজিয়া খাতুন, নাসিমা আক্তার ও শম্পা সকলেরই এক কথা।
শম্পা বলে, এ কথা বাবা-মাকে বললে বখাটে ছেলেরা আরো ক্ষেপে যায় তখন আরো বিরক্ত করে। ঐ ভয়ে বাবা-মাকেও বলা যায় না। এই খারাপ ছেলেদের ভয়ে বাবা-মায়েরা অনেক সময় আমাদের পড়াশুনা বন্ধ করে দেয়। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়েও দিয়ে দেয়।
খারাপ ছেলেরা বাবার ফোনে ফোন করে সেই বাড়ির মেয়েকে চায়। খারাপ ভাষা ব্যবহার করে। এর কারনে বাবা-মা মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। মেয়েদের কোন কথা শোনা দরকার মনে করে না। আমাদের সাথে পড়তো, আমাদের বন্ধু-বুলবুল, সাথী ও কুলসুম তিনজনার-ই ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গেছে। সাথী ও বুলবুলের স্বামী ঢাকা গার্মেন্টে কাজ করে। এখন ওরাও ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করে। আবার এমন আছে মেয়ে ছোট কিন্তু বয়সে অনেক বড় লোকদের সাথেও বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেয়। সেটাও আমাদের চরের একটা সমস্যা- দশম শ্রেণীর ছাত্রী নাসিমা এভাবেই তার কথা তুলে ধরে।
শাহাজাতপুর উপজেলার সোনাতনী ইউনিয়নের একটি গ্রাম বানতিয়ার। যমুনা নদীর চরে এই গ্রাম। নদী, বালি আর মাঠ। চর এলাকা। এর মধ্যেই ঘর-বাড়ি আর জনবসতি। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলে পায়ে হাঁটা পথ এবং নৌকা ছাড়া যানবাহন তেমন নাই বললেই চলে। তবে মালামাল টানার জন্য ব্যবহার হয় ঘোড়া দিয়ে গরুর গাড়ি। আর এলাকার লোকেরা ব্যবহার করে বাই-সাইকেল। এই ইউনিয়নে মোট গ্রাম ছিল ২২টি। ইতোমধ্যে নদী গর্ভে চলে গেছে ৬টি আর চরে জেগে রয়েছে ১৬টি গ্রাম। তারই মধ্যে একটি গ্রাম বানতিয়ার। এই গ্রামেই রয়েছে বানতিয়ার উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল। ছয়টি চরের মেয়েরা এই স্কুলে পড়াশুনা করছে। চরের গ্রামগুলো হাল-হাট ঘোরজান, বড় ঘোরজান, বড় চামতারা, কৈরট, শ্রীপুর ও বানতিয়ার।
এই চর এলাকায় বর্তমানে কিশোরী মেয়েদের প্রধান সমস্যাগুলো কি? কি কি বিষয় তাদের চিন্তিত করে এবং সমস্যাগুলি সমাধানের উপায় তারা ভাবে কি না? কিশোরীদের সাথে এ সব বিষয়ে জানার জন্য একটু আলোচনার উদ্যোগ নেই। তাই আলোচনা সভাটি প্রাণবন্ত করার জন্য ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ ৮ই মার্চ এর উত্থান দিয়ে শুরু করি। ৮ই মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস। ৮ই মার্চ পালন করা হয় কিন্তু তার ইতিহাস জানে না। কেন, কি কারণে এ দিবস পালন করা হচ্ছে তাও জানে না এই কিশোরীরা। তাই সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরলাম ৮ই মার্চ এর ইতিহাস-
আন্তর্জাতিক নারী দিবস জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি দিন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে দিনটি উদযাপন করা হয় ১৯১০ সাল থেকে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পৃথিবীর সকল নারীদের তথা সকল মানুষের সংগ্রামকে একসূত্রে গাঁথবার দিন, সংহতি স্থাপনের দিন। এই দিবসের উৎপত্তি নারী শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা, বেতনের বৈষম্য এবং অমানবিক কাজের পরিবেশসহ নানা ধরণের নির্যাতন নারী শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে সহায়তা করেছিল। নিউইয়র্কের পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকেরা ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ অমানবিক শোষণের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ জানাবার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিল। এই সংগ্রাম স্মরণ করবার জন্য জার্মান সমাজতন্ত্রী নেত্রী ক্লারা জেৎকিন ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রী নারীদের সম্মেলনে ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে ঘোষণা দেবার প্রস্তাব করেন। ১৯১০ সালে জাতিসংঘ কতৃক ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
আলোচনার এক পর্যায়ে কিশোরীদের কাছে জানতে চাই, কোন বয়সে মেয়েদের বিয়ের ঠিক সময় বলে তোমরা মনে কর? উত্তরে মেয়েরা বলে, এস. এস. সি পাশ করার পরে, কলেজে পড়লে মেয়েদের বিয়ে হওয়া সঠিক।
বিয়েতে যৌতুক:
৬ষ্ঠ শ্রেণীর মেয়ে লিমাকে দশম ক্লাসের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে। রেজিষ্ট্র করে রেখেছে। মেয়ের পক্ষ থেকে ১ লক্ষ টাকা ছেলের বাবাকে দিতে হয়েছে। কিশোরীরা বলে, আমাদের চরে যৌতুকের পরিমাণ সর্বনি¤œ ৫০ হাজার টাকা আর সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা। গরীব দিন মজুরের কাজ করে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দিলে ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দিতে হয়। কোম্পানীর চাকরী করে এমন ছেলেকে দেড় লক্ষ টাকা থেকে ২ লক্ষ টাকা যৌতুক দিতে হয়।
সরকারী চাকুরী ছেলের কাছে মেয়ে দিলে ৩ লক্ষ টাকার উপরেও যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হয়। এটা আমাদের চরের মেয়েদের জন্য সমস্যা। বিয়ের পরেও যৌতুকের টাকা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত মেয়েকে বাবার বাড়িতে রেখে দেয়। আবার অনেক ছেলে পছন্দ করে বিয়ে করে পরে যৌতুকের জন্য মেয়েকে চাপ দেয়।
মোবাইল ফোনের ব্যবহার:
খারাপ ছেলেরা সেল ফোনে মেয়েদের ছবি তুলে। তারপর শহরে যেয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে মেয়ের ছবির গলা কেটে অন্য খারাপ ছবির সাথে লাগায়। সেই ছবি সবাইকে দেখিয়ে বেড়ায়। মেয়েদেরকে অপমান করে। মেয়েরা ভয়ে ভয়ে থাকে। বাবা-মায়েরাও ভয়ে থাকে।
চরে কিশোরীদের প্রধান সমস্যাগুলো-
১. খারাপ ছেলেদের জন্য স্কুলে যেতে অসুবিধা।
২. মেয়েদের মতামত না নিয়েই বিয়ে।
৩. কম বয়সে বিয়ে।
৪. যৌতুক ছাড়া বিয়ে হয় না।
৫. মোবাইল ফোনে মেয়েদের বিরক্ত করা।
৬. কম্পিউটারের মাধ্যমে খারাপ ছবির সাথে মেয়েদের ছবি যুক্ত করা।
৭. কম বয়সের মেয়েদের বেশি বয়সের ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া।
সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে কিশোরীরা বলে-
১. সেল ফোন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
২. আমাদের জন্য (নারীদের) সরকারের যে আইন আছে সেই আইনগুলোর ব্যবহার করতে হবে।
৩. আমাদের জন্য যে আইন আছে তা আমরা যাতে জানতে পারি তার ব্যবস্থা থাকলে আমাদের সাহস বাড়বে।