মা ও শিশুর রক্তাল্পতা


রক্তে হিমোগ্লোবিন বা লোহিত কনিকার স্বল্পতাকে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিঅ্যা বলা হয়। এ ঘাটতি মারাক্তক পরিণাম বহন করে। স্কুলগামী ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ার প্রতি অনীহা, অবসাদ, বিষন্নতা, শারীরিক ও মানষিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। রক্তাল্পতার কারণে মাতৃ ও শিশুর মৃত্যুর হার বেড়ে যেতে পারে।

বিশ্বব্যাপী রক্তাল্পতা একটি মারাত্মক সমস্যা। দুই বিলিয়নের অধিক মানুষ রক্তাল্পতার শিকার। বাংলাদেশেও রক্তাল্পতা মা ও শিশুর একাটি মারাতœক স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৪৬% গর্ভবতী মা, ৬-২৩ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে ৬৪%, ২৪-৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে ৪২%, কিশোরীদের মধ্যে ৩০% এবং যুবতীদের মধ্যে যারা এখনও গর্ভবতী হননি তাদের মধ্যে ৩০% রক্তাল্পতায় ভুগছেন (বিবিত্রস / ইউনিসেফ, ২০০৪)।

রক্তাল্পতার লক্ষণ:

রক্তাল্পতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা কোন রকম শারীরিক পরিশ্রম ছাড়াই ক্লান্ত বা অবসাদগ্রস্ত হন। কোন কাজে মন বসে না। বুক ধড়ফড় করে। হাত পা জড়িয়ে আসে। শ্বাস নিতে কষ্ঠ হয়। পায়ে ঘা হয়। বুকে ব্যথা হয়। প্রচন্ড মাথা ব্যথা হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। শরীর ফ্যাকাশে হয় এবং জন্ডিস হয়।

স্নায়ুবিক বিকাশ বিঘ্নিত শিশুদের দীর্ঘস্থায়ী রক্তাল্পতা দেখা যায়। রক্তাল্পতায় আক্রান্ত শিশুরা লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে পাড়ে না। অধিকাংশ সময় এ সব শিশুরা পা ফোলা, বুক ব্যথা, অস্বাভাবিক ঘাম, বমি বমি ভাব ইত্যাদি সমস্যায় ভোগে। পুরুষদের চেয়ে মহিলারা বেশি রক্তাল্পতায় ভোগেন। জটিল রক্তালপতায় বুক ধরফর করে এবং হৃদপিন্ড বেড়ে যায়।

রক্তাল্পতার কারণ:

শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ রক্তে লোহিত কনিকা উৎপাদন করে। তবে এর বেশীর ভাগ কাজ শরীরের বড় হাড়ের মধ্যে সংগঠিত হয়। লোহিত কনিকা ৯০-১২০ দিন কার্যকর থাকে। এর পরে বর্জ হিসাবে শরীর থেকে বেড়িয় যায়। হাড়ের মধ্যে আবার নতুন লোহিত কনিকা উৎপাদন হয়। হেমোগ্লোবিন রক্তের লোহিত কনিকার মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করে। রক্তাল্পতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে হেমোগ্লোবিন কম থাকে। এর লক্ষণ তাদের বির্বণ চেহারা দেখেই বুঝা যায়।

নিম্ন লিখিত কারণে রক্তাল্পতা হতে পারে:

১. খাদ্যে পুষ্টির আভাব, বিশেষ করে মায়েদের গর্ভকালীন অবস্থায়

২. দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ক্যান্সার, আলসার ইত্যাদি

৩. শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া

৪. লিউকমিঅ্যা রোগে আক্রান্ত হওয়া

৫. বংশগত রোগ যেমন থ্যালাসেমিয়া

৬. শরীরে ফলিক এসিড, ভিটামিন বি-১২ এবং আয়রনের ঘাটতি

৭. কিডনি অকেজো হওয়া

৮. কঠিন রোগে লোহিত কনিকা ধ্বংস হওয়া

৯. অপর্যাপ্ত লোহিত কনিকা উৎপাদন 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের নাগরিকদের পুষ্টি ঘাটতির প্রধান কারণ অধিকাংশ নাগরিকের পুষ্টিজ্ঞানের অভাব। খাদ্যে আয়রণ, ভিটামিন-এ, ভিটামিন বি-১২, ফলিক এসিড, ভিটামিন বি-৬, রিবোফ্লাভিন এবং তামার অভাব। মারাত্মক রোগ যেমন যক্ষা, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব। খাদ্য ও পুষ্টি বিষয় জ্ঞানের স্বল্পতা ও সামাজিক কুসংস্কার যেমন পরিবারের সকল পুরুষ সদস্যদের আহার গ্রহণের পরে মহিলারা খান। সাধারণ সেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া যেমন ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য মশারী কিনতে না পারা। দারিদ্রের কারণে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সম্পন্ন খাদ্য কিনতে না পারা। ক্রিমির আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য জুতা কিনতে না পারা।

প্রতিকার:

নিশ্চিত ভাবে রক্তাল্পতা নিরাময়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা প্রয়োজন। এ সব পরীক্ষায় রক্তের ভিটামিন বি-১২, ফলিক এসিড, খনিজ লবন, লোহিত কনিকা, হেমোগ্লোবিন এবং রক্তে আয়রণের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। রক্তাল্পতার প্রতিকার হিসাবে ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন ফলমূল, শাক-সবজি ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আয়রণযুক্ত খাবারের সাথে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করলে আয়রণ শোসণ সহজ হয়। অধিক তাপে ভিটামিন সি নষ্ট হয়। তাই কম তাপে ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার রান্না করা প্রয়োজন। সালাদ হিসাবে গ্রহণ করলে ভিটামিন সি এর কার্যকারিতা আরো বৃদ্ধি পায়। খোলা বাতাসে ভিটামিন সি এর কার্যকারিতা দ্রুত নষ্ট হয়। সে কারণে খাদ্য প্রস্তুতের সঙ্গে সঙ্গে যথাশীঘ্র সম্ভব খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।

প্রাণীজ উৎসের আয়রণ যেমন মাছ মাংসের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ প্রাণীজ উৎসের আয়রণ শোসণ ক্ষমতা ২০-৩০%। পক্ষান্তরে উদ্ভিজ উৎসের আয়রণ এর শোষণ ক্ষমতা ৫% এর ও কম। প্রাণীজ উৎসের খাবারই ভিটামিন বি-১২ এর এক মাত্র সহায় যা রক্তাল্পতা নিরাময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সীম ও ডাল জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে যা ফলিক এসিড এর সমৃদ্ধ উৎস। ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কারণ ভিটামিন এ ঘাটতি হলে রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে।

ভিটামিন এ-এর প্রধান উৎস:

গাজর, মিষ্ঠিকুমড়া, মিষ্ঠিআলু, পালনশাক, আপেল, আনারস, রসুন, সামুদ্রিক মাছ, কমলালেবু, গরুর গোশত, দুধ, সরিষা শাক, পুদিনা, মটর শুটি, শালগম, টমেটো, পেঁপে, ইত্যাদি।

খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস:

প্রধান খাবারের অন্তত এক ঘটার মধ্যে ( আগে বা পরে ) চা বা কফি সেবন থেকে বিরত থাকা ভাল। কারণ ফ্যাফেইন আয়রন শোসনে বাঁধা সৃষ্টি করে। কম বয়সের ছেলে মেয়েদের চা কফি সেবন করা উচিত নয়। দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং দুধ প্রধান খাবারের মধ্যবর্তবতী সময় গ্রহণ করা উচিত। কারণ প্রধান খাবারে সঙ্গে গ্রহণ করলে দুধের মধ্যে বিদ্যমান ক্যালশিয়াম আয়রণ শোসনে বাঁধা সৃষ্টি করে।

আয়রণ সমৃদ্ধ খাদ্য:

ডিমের কুসুম, গাঢ় সবুজ শাক, কিসমিস, মুরগির মাংস, সিম, মুসুর ডাল, ছোলা, কলিজা, মাছ, চিংড়ি মাছ, লাল আটা, লাল চাল, ঝোলা গুড়, টমেটো, মুগডাল, যবের ছাতু, সামুদ্রিক মাছ, ইতাদি।

প্রতি দিনের অভ্যাস:

১. প্রতিদিন সকালে চিনি ছাড়া বড় এক পেয়ালা বিটের রস পান করা

২. স্বল্প সময় সূর্যস্নায়ু

৩. রাতের খাবারের পরে চা চামচের এক চামচ মধুর সাথে একটি পাকা কলা খাওয়া

৪. দিনে তিনবার তিন গ্লাস টমোটোর রস পান করা

৫. প্রতিদিন সকালে এক পেয়ালা আপেলের রস পান করা

৬. প্রতি বেলা মূল খাবারের সাথে লেবু ও কাঁচা মরিচ খাওয়া। এ ছাড়া খাদ্য তালিকায় নিয়মিত মাছ, মাংস ডাল, দানাদার শস্য, ফল, মূল, ডিম, শাক সবজি ইত্যাদি থাকা বাঞ্চনীয়।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter