প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ দিয়ে মাতৃমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে তো?
বিশ্বের যে কয়টি দেশ জাতিসংঘ ঘোষিত মাতৃমৃত্যু হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।
এমডিজি অনুযায়ি, বিশ্বের দেশগুলোতে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু হার ২০০০ সালের তুলনায় তিন চতুর্থাংশ কমাতে হবে। কিন্তু ২০১৫ সালে এসেও অনেক দেশ তাদের অগ্রগতি সন্তোষজনক পর্যায়ে আনতে পারেনি। তবে বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলা যায়। ২০১৫ সাল শেষ হওয়ার আগেই সে লক্ষ্যে পৌছানোর কথা বলছে সরকার। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে প্রসবজনিত কারনে মাতৃমৃত্য হার প্রতি লাখে ১৭০ জন। প্রতিবছরই প্রায় ১২ হাজার মা প্রসবজনিত জটিলতার কারণে মারা যায়। ১৯৯০ সালে এই মৃত্যুর হার ছিল লাখে ৫৭৪ জন। ২০০১ সালে কমে দাঁড়ায় লাখে ৩২২ জনে। ২০০৬ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল লাখে ৩২০ জন। ২০১০ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১৯৪ জনে। ২০১৪ সালে মাতৃমৃত্যুর হার তা কমে আসে ১৭০ জনে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল এটা।
প্রসবকালে মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে আনতে তিন হাজার প্রশিক্ষত!মিডওয়াইফ’ বা ধাত্রী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
প্রতিটি উপজেলায় চারজন এবং প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে তিন বছরে ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ধাত্রী নিয়োগ দেয়া হবে।
চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে এ নিয়োগ শুরু হবে। ধাত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ২৬ মে, ২০১৫ তারিখে ইউএনএফপি এর সহযোগিতায় প্রথম আলো আয়োজিত এক গোল টেবিল আয়োজন করা হয় প্রথম আলো কার্যালয়ে। গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নূর হোসেন তালুকদার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউএনএফপি এর মাতৃস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞ শামিনা শারমিন। তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাব মতে দেশে বর্তমানে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭০ জন। ১৯৯০ সালে মৃত্যুর হার ছিল ৫৭৪ জন। সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু হার ১৪৩ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে এ লক্ষ্য অর্জেেনর জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ অর্থাৎ ধাত্রী নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশে বর্তমানে শতকরা প্রায় ৪২ জন গর্ভবতী মা প্রশিক্ষিত ধাত্রীর পরিচর্যায় আওতায় এসেছে। বাকি মায়েরা ঘরেই অপ্রশিক্ষিত ধাত্রীদের সহায়তায় সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। এতে মৃত্যুর ঝুঁকি ছাড়াও মায়েরা প্রসব-পরবর্তী নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন বলে দাবি করেন প্রবন্ধ উপস্থাপক।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নুর হোসেন তালুকদার বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রসূুতিদের জন্য দেওয়া সেবার মান ভাল নয়। সে কারণে অনেকে হাসপাতালে যেতে চান না। আর যাদের সামর্থ আছে, তাঁরা বেসরকারি ক্লিনিকে যান। এখন নতুন যে ধাত্রী নিয়োগ দেয়া হবে, তাঁদের সহমর্মিতার মন নিয়ে গর্ভবতী মায়েদের সেবা দিতে হবে। নিয়োগ পাওয়ার পর যেখানে নিয়োগ দেওয়া হবে, সেখানেই তাঁদের বাধ্যতামূলক ভাবে অবস্থান করতে হবে। তা না হলে কর্মসূচীর উদ্দেশ্য সফল হবে না। অবসট্রেটিক্যাল ও গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বলেন, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সব হাসপাতালে প্রসূতি বিভাগটি সব চেয়ে অবহেলিত। একটি অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে বলেন, চাঁদপুর একবার কাজ করতে লেবার রুমে গিয়ে ছিলেন, সেখানে গিয়ে দেখেন লোবার রুমে কুকুর শুয়ে আছে। তিনি বলেন, সেবিকা দিয়ে হবেনা। তারা অনেক রকম কাজে ব্যস্ত থাকেন। প্রসূতিদের শতভাগ সেবা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত ধাত্রী নিয়োগ করতে হবে। আমাদের কথা হচ্ছে মিডওয়াইফদের প্রশিক্ষত করলেই কি মাতৃমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। নাকি এর পেছনে আরো অন্যান্য বিষয় জড়িত রয়েছে। প্রশিক্ষত হলেই কি এই মিডওয়াইফরা ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে কাজ করবে? আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি ইউনিয়ন পর্যায়ে যারা কাজ করেন তারা ১২ টার পরে আর অফিসে থাকেনা। তারা কখনো রোগীর কাছে যান না। রোগীরা তাদের কাছে আসেন।
গ্রামাঞ্চলে যে দাইমারা কাজ করেন তারা হাতে নাতে কাজ শিখে প্রসব করান। গ্রামাঞ্চলে ৯০ ভাগ মহিলার প্রসব এখনও হয়ে থাকে সনাতনি দাইমা অথবা তাদের নিটক আত্মীয় স্বজনদের সাহায্যে। এই সনাতন দাইমাদের বাদ দিয়ে গ্রামে প্রসব করানোর কথা চিন্তা করা যায় না। এই দাইমাদের কেউ জোর করে কোন গর্ভবতী মাদের বাড়িতে পাঠায় না। তারা নিজের তাগিতে মানুষের উপকার করার জন্য গর্ভবতী মায়ের বাড়িতে যান। তাদের কোন ভুল হয়না তা নয়। তারপরও তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন । গর্ভবতী মায়ের কোন সমস্যার কথা শোনা মাত্র ঝড়, বৃষ্টি অপেক্ষা করে ছুটে যান গর্ভবতী মায়ের বাড়িতে। গর্ভবতী মায়ের বিপদের সময় সহমর্মিতা দিয়ে দিনে রাতে তাদের পাশে থাকেন। দেশের পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। এসব জায়গায় স্বাস্থ্য কেন্দ্র অনেক দূরে। সেখানেও ডাক্তার থাকেনা। তাই এসব এলাকায় ৯০ ভাগ শিশু ধাত্রীদের হাতে ঘরেই জন্ম নেয়। ইউএসএইড ম্যাটারনাল এন্ড চাইল্ড ইমপ্লিমেন্টশনের আওতায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন পৌর এলাকাতে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো সমস্যার জন্য হাসপাতালে যেতে পারছেনা অনেক মা। হাসপাতালে পৌঁছালেও ডাক্তার না থাকার কারণে মিলছেনা চিকিৎসাসেবা। আবার অনেক মা পুরুষ ডাক্তারের হাতে প্রসব করাতে রাজি হয় না। গ্রামীণ জনপদ ও চরাঞ্চলের অবস্থা আরো খারাপ। এসব জায়গায় নেই কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র। থাকলেও সেখানে ডাক্তাররা থাকতে চান না। ফলে কেউ অসুস্থ্য হলে দাইমা এবং স্থানীয় ওষুধের দোকানদারই তাদের এক মাত্র ভরসা।
আর এখানে সরকার বলছে প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফদের যেখানে নিয়োগ দেয়া হবে সেখানে বাধ্যতামূলক কাজ করতে হবে। জোর করে কাউকে দিয়ে কোন কাজ সঠিকভাবে করানো সম্ভব হয় না। “লেবু যত চিপে তত তিতা হয়”। চাপ প্রয়োগ করে কোন কাজের সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এসব মিডওয়াইফরা নিয়োগ পাবেন প্রতিটি উপজেলায় চারজন এবং প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে। ছোট বেলায় পড়েছি কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন। যদি তাই হয় তা হলে একজন মিডওয়াইফের পক্ষে এতগুলি গ্রামের খোঁজ রাখা সম্ভব হবে কি? কিন্ত একটি গ্রামে কম পক্ষে ৩/৪ জন দাইমা থাকেন। তারা সারা গ্রামের মা ও শিশুদের খোঁজ রাখেন। সব সময় গর্ভবতী মায়ের বাড়ি যান এবং তাদের বিপদকালীন সময়ে পাশে থাকেন। যেহেতু এই দাইমারাই গ্রামের মহিলাদের একমাত্র ভরসা। এই দাইমাদের সরকার প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে পারেন। ২০১৫ সালের মধ্যে যে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা উন্নয়ন করার কথা ছিল সেটা অর্জন না করেই আবার নতুন পরিকল্পনা নেয়ার অর্থ কি?