আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি


প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই শিশু হত্যাসহ শিশু নির্যাতনের খবর দেখা যাচ্ছে ,যা ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক। এমন নৃশংস পদ্ধতিতে মানুষকে শাস্তি দেয়া যায়,মেরে ফেলা যায়-একথা কল্পনা করলেই গা শিউরে ওঠে। এই ভয়াবহ সব তথ্য দেখে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। টেলিভিশনে রাকিবের মৃত্যুর বর্ণনার সংবাদে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সন্দেহ নেই,সংবাদপত্রের বর্ণনাও অনেককে মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ করছে।

নারী ও শিশু অধিকার এত নিম্ন পর্যায়ে গেছে যে,এখন মায়ের গর্ভের শিশুও নিরাপদ নয়। শিশু নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধির এই প্রবণতা ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে,যা সমাজের জন্য আশঙ্কাজনক। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত মানুষের পক্ষেই শুধু শিশুর প্রতি এ ধরণের বর্বরতা করা সম্ভব। বিকৃত মানসিকতা দূর করতে হলে,আমাদের কি করা প্রয়োজন সমাজের সবাইকে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে দেখা গেছে গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে ৭৭৭ শিশু নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও একটি ঘটনারও আজ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি।

শিশু নির্যাতন ও খুনের ঘটনার কোন বিচার হচ্ছে না। সাজা পাচ্ছে না অপরাধীরা।এ ধরনের অপরাধে অভিযুক্তদের সাজা না হওয়ায় অপরাধের প্রবণতা আজ এই পর্যায়ে এসেছে। এতে উৎসাহিত হচ্ছে হত্যাকারীরা। ফলে পুনরাবৃত্তি ঘটছে একই ঘটনার। অপরাধীদের কঠোর সাজা না দেয়ায় বাড়ছে শিশু নির্যাতন ও খুনের ঘটনা।

শিশু নির্যাতনের ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায়ই বারবার শিশু নির্যাতনের নৃশংস ঘটনা ঘটছে।

অনেক সময় পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য দুএকজন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু মূল হোতারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। রহস্যজনক কারণে তদন্ত পর্যায়েই থেমে যাচ্ছে অনেক ঘটনা। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হচ্ছে না আদালতে। বেশির ভাগ ঘটনায় আসামি গ্রেফতার হচ্ছে না । ফলে প্রকৃত আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। পৈশাচিকতার মূল কারণগুলো বের করে পদক্ষেপ নেয়ার এখন খুব জরুরী হয়ে পড়ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে নার্সিং কলেজের সামনে থেকে ৫ আগস্ট দিবাগত আনুমানিক রাত দুইটার দিকে পুলিশ একটি সুটকেসের ভেতর থেকে সাত-আট বছরের এক ছেলে শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে । তার পরনে ছিল বড় হাফপ্যান্ট । তার বিভিন্ন জায়গায় আগাতে চিহ্ন রয়েছে । ধারণা করা হচ্ছে নির্যাতন করে হত্যার পর তার লাশ সুটকেসে ভরে ফেলে রাখা হয়েছে ।এখনও মেলেনি তার পরিচয়।

ঢাকার শাহজাহানপুরে শিশু সামিউলের মৃত্যুর ঘটনায় সাত মাসেও কোনো বিচার হয়নি।তদন্ত নিয়ে চলছে গরিমশি । সিলেটে শিশু রাজন হত্যার ঘটনায় এক মাসেও চার্জশিট হয়নি। এখনও তদন্তই শেষ হয়নি রাজশাহীর আঁখি ও লতিফা হত্যা,বরিশালের সাবিনা,আসাদুল হত্যাসহ আরও অনেক ঘটনার। ফলে বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হচ্ছে। বিচারে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে থাকে। ফলে স্থানীয়ভাবে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না। এ সুযোগে অপরাধী গা ঢাকা দেয়। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো ধরনের ভূমিকা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

পৈশাচিক নির্যাতন করে শিশু হত্যা থামছেই না। চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার তারাপুর কামারবাড়ি গ্রামেসিরাজ মেম্বারের বাড়িতে ৪ আগষ্ট কবিরাজি চিকিৎসার নামে বাবা এমরান হোসেন ও মা আমেনা বেগমের পিটুনিতে মারা গেছে তাদেরই শিশু সন্তান সুমাইয়া। জিনে ধরেছে বলে কবিরাজের পরামর্শে শিশুটিকে বেধড়ক পিটুনি দিলে রক্তক্ষরণে মারা যায় শিশুটি।

৩ আগষ্ট, ২০১৫ খুলনার টুটপাড়ায় মোটর গ্যারেজে শিশু মো:রাকিবুল ইসলাম রাকিব (১৩) নামের এক শিশুকে কমপ্রেসার মেশিন দিয়ে মলদ্বারে বাতাস ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এবার বরগুনার তালতলীতে ১১ বছরের এক শিশুকে চোখ উপড়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মাছ চুরির অভিযোগে তাকে এম নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়।

এর আগে ২৩ জুলাই মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধ চলাকালে গুলিতে মাতৃগর্ভেই গুলিবিদ্ধ হয় এক শিশু। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় সুরাইয়া। ১৪ দিন পর ৬ আগষ্ট সে মায়ের কোলে ফিরে এসেছে। ১৪ দিন বয়সী শিশুটি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।

৮ জুলাই চুরির অপবাদ দিয়ে সিলেটের শহরতলির কুমারগাঁওয়ে শিশু শেখ সামিউল আলম রাজনকে চার ঘণ্টা নির্যাতন করে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৮ মিনিট ধরে এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চিত্র ধারণ করে ফেসবুকে আফলোড করা হয়। একইভাবে ১৩ এপ্রিল রাজধানীর খিলক্ষেতের মস্তুল এলাকার ২০-২২ জনের একটি দল কবুতর চুরির অপবাদ দিয়ে ১৬ বছরের কিশোর নাজিমের ওপর বর্বর নির্যাতন করে। রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে বেধড়ক পেটানোর পর অচেতন অবস্থায় লাথি দিয়ে তাকে ফেলে দেয়া হয় বালু নদীতে। পানিতে রাজন ডুবে গেলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ঘাতকরা। মর্মান্তিক এই নির্যাতনের ভিডিও আপলোড ফেসবুকে দেয়া হয়।

বিভিন্ন বেরসকারি সংস্থার প্রতিবেদনেও শিশু নির্যাতন ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে।

(এর মধ্যে চলতি বছরের সাত মাসে ১৯১ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। একই সময় হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে আরও ১১ জনকে। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৫০,২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯। শিশু অধিকার ফোরামের রেকর্ডে আরও দেখা গেছে,মোট ৬১টি ক্যাটাগরিতে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে মোট ২ হাজার ৮০১ শিশু নামামুখী নির্যাতন,হয়রানি ও আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে ৬ মাসে মোট ১৭৫ শিশু ও তরুণ।)( তথ্যসুত্র: যুগান্তর ৬ আগষ্ট, ২০১৫)

গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর ,২০০১৪ রাজধানীর শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনির শিশু জিহাদ রেলওয়ে কলোনির পানির পাম্প পড়ে জিহাদের মৃত্যু হয় । ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৪ শিশু জিহাদের বাবা নাসির ফকির

শাহজাহানপুর থানার একটি হত্যা মামলা দয়ের করেন। হত্যা মামলার পুনঃতদন্ত এখনও শেষ হয় নি ।

রাজন হত্যার চার্জশিট হয়নি :গাফিলতিতে পালিয়ে যাওয়া সৌদি আরবে আটক শেখ সামিউল আলম রাজন খুনের প্রধান আসামি কামরুলকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ২৭ দিন অতিবাহিত হলেও চার্জশিট দেয় হয়নি। রাজনের অন্যতম ঘাতক কামরুল সৌদিতে আটক রয়েছে।

রাজন,রাকিবসহ যে কোনো শিশু হত্যার ঘটনায় বিচারের আওতায় এনে দায়ীদের শাস্তি দিতে হবে।

প্রকৃত অপরাধী যত প্রভাবশালীই হোক না কেন,তার সঠিক বিচার করতে হবে। তাই এসব নৃশংসতা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী। সমাজের কাছে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

তথ্য সুত্র: প্রথম আলো, যুগান্তর, নয়া দিগন্ত।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter