ক্লিনিকের অব্যস্থাপনা মায়েদের মৃত্যুর জন্য দায়ী


ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর ছয়জন প্রসূতি মারা গেছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায় ক্লিনিকের অব্যবস্থাপনাই এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। ইদানিং সময়ে বেসরকারি ক্লিনিক গুলোতে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ছি। সরকার যেখানে মাতৃমৃত্যু রোধকরার জন্য কাজ করে যাচ্ছে, সেখানে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল গুলো তাদের ব্যবসার জন্য মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। মাতৃমৃত্যু রোধ করার জন্য মায়েদের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। সেখানে যদি এ ধরণের ঘটনা ঘটে তা হলে মায়েদের ভরসা কোথায়? মায়েরা নিজের ও শিশুর জীবন বাঁচাতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরছে। এটা আমাদের কাম্য নয়। এধরণের গটনায় আমরা দেখছি ক্লিনিকগুলোতে স্থায়ীভাবে কোন অবেদন কারী থাকে না বেশির ভাগ ক্লিনিকে দেখা যায় বাহির থেকে ভাড়া করে অবেদন কারী আনা হয়। অবেদন (অ্যানেসথেসিয়া)করার কোনো যন্ত্র ঠিকমত থাকেনা। অস্ত্রোপচারের জন্য যে সব যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয় তা ঠিকমত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় কিনা তা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

অস্ত্রোপচারে যে ছয়জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে সেই অস্ত্রোপচার করা হয় যেসব ক্লিনিকে সেই ক্লিনিকগুলি হচ্ছে ঝিনাইদা জেলার মহেশপুর উপজেলার ভৈরবা বাজারে অবস্থিত জননী ক্লিনিক ও নার্সিং হোম, গাজীপুরের কাপাসিয়ার আমরাইদ আইডিয়াল হাসপাতাল,পাবনার বেড়া পৌর এলাকায় অবস্থিত চৌধুরী ক্লিনিক।

ঘটনার পর জননী ক্লিনিক ও নার্সিং হোম ক্লিনিকটিতে তালা মেরে মালিক মোমিনুর রহমান পলাতক রয়েছেন। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন ক্লিনিক মালিক মোমিনুর রহমান। রোজার ঈদের পর থেকে মাত্র ৪০ দিনের ব্যবধানে এই মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেছে। ১০ শয্যার এই ক্লিনিকে মাসে ১৮ থেকে ২০টি অস্ত্রোপচার হয় বলে জানা যায়,মালিক নিজে কোন ডাক্তার না হলেও নিজেই এটা পরিচালনা করেন। একজন নার্স ও একজন আয়া ক্লিনিকের দায়িত্ব পালন করতেন। সার্বক্ষণিক কোনো চিকিৎসক ছিল না। মোমিনুর রহমান জানান, রোগী এলে চিকিৎসক ডেকে অস্ত্রোপচার করতেন। পরে রোগীর দেখভাল তাঁরাই করতেন।

অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক গোলাম রহমান বলেন, (প্রথম আলো ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫) ‘অপারেশনের যন্ত্রপাতি ঠিকমতো দূষণমুক্ত না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। ওই কারণেই রোগীদের মেনিনজাইটিস দেখা দিচ্ছে এবং মৃত্যু হচ্ছে। তিনি বলেন,আরও যাঁরা আক্রান্ত আছেন, তাঁদের বিষয়ে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না।

উপজেলার বালিনগর গ্রামের মৃত প্রসূতি রূপা খাতুন এর বাবা আবু বক্কর বলেন, ঈদের দিন জননী ক্লিনিকে রূপার অস্ত্রোপচার হয়। ক্লিনিকে এক সপ্তাহ থাকার পর বাড়িতে ফিরেই তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হন। রূপা কোনোভাবেই জ্বর ভালো হচ্ছিল না। তাঁরা রূপাকে আবার ওই ক্লিনিকে নিয়ে যান। ভালো না হওয়ায় সেখান থেকে তাঁকে নেওয়া হয় যশোর ২৫০ শয্যার হাসপাতালে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই ১৯ আগস্ট মারা যান রূপা।

ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন মো আবদুস সালাম বলেন, (প্রথম আলো ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫) খবর পেয়ে তিনি ক্লিনিকটি পরিদর্শন করেছেন। তিনি ধারণা করছেন, সংক্রমণ থেকে প্রসূতিদের মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর এঁদের মধ্যে চার জন প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রত্যেককেই আবার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু কাউকেই বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

যে ছয় জন প্রসূতি মারা গেছেন তাঁরা হলেন মহেশপুর উপজেলার জাগুসা গ্রামের আক্তার আলীর স্ত্রী রূপা খাতুন (২০), অনন্তপুর গ্রামের আবদুস সামাদের স্ত্রী আরিফা খাতুন (১৮), কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামের নাজমুল ইসলামের স্ত্রী বিথি খাতুন (২০)ও জীবননগর উপজেলার বারান্দী গ্রামের ইউনুচ আলীর স্ত্রী সালেহা বেগম (২৬)। কাপাসিয়ার (গাজীপুর ) দেওয়ান গ্রামের সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী নিহত প্রসূতি শামসুন্নাহার (২৬)

রোগীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩০ আগস্ট পাবনার বেড়া পৌর এলাকায় অবস্থিত চৌধুরী ক্লিনিক ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্লিনিকটি অনুমোদনহীন অবস্থায় চলছিল বলে উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে।

রোগীর স্বজনরা জানান ২৯ আগস্ট সকালে বেড়া পৌর এলাকার চৌধুরী ক্লিনিকে সাঁথিয়া উপজেলার করমজা গ্রামের নাসিমা বেগম (২১)নামের সন্তানসম্ভবা এক মা ভর্তি হন। ওই দিন বেলা তিনটার দিকে তাঁকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পুত্রসন্তান প্রসব করানো হয়। একপর্যায়ে প্রসূতির অবস্থার অবনতি ঘটলে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রসূতিকে ঢাকা অথবা রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বজনদের পরামর্শ দেয়। বিকেল চারটার দিকে স্বজনরা রোগীকে পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়।

ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে শামসুন্নাহার (২৬) নামে এ প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে গাজীপুরের কাপাসিয়ার আমরাইদ আইডিয়াল হাসপাতালে। নিহত প্রসূতি কাপাসিয়া (গাজীপুর) দেওনা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী। গত ২৪ আগস্ট শামসুন্নাহারের প্রসব ব্যথা শুরু হলে বিকেলের দিকে তাকে আমরাইদ আইডিয়াল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক জানান, রোগীর গর্ভের সন্তানের অবস্থা ভালো নয়। মা ও সন্তানকে বাঁচাতে হলে জরুরি অপারেশন প্রয়োজন। পরে অপারেশনের মাধ্যমে শামসুন্নাহার কন্যাসন্তান জন্ম দেন। কিন্তু অপারেশনের সময় অচেতন করার পর প্রসূতির আর জ্ঞান ফিরে আসেনি। দুই দিন চেষ্টার পর আমরাইদ আইডিয়াল হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ শামসুন্নাহারকে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন। ২৭ আগস্ট রোগীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। ডাক্তার দিয়ে অপারেশন না করে নার্স দিয়ে অপারেশন করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। (নয়া দিগন্ত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫)

আরো ৫ জন মা মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন। মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা প্রসূতিরা হলেন মহেশপুর উপজেলার গাড়াপোতা গ্রামের আলী কদর মোল্লার মেয়ে উম্মে সালমা, মাইলবাড়িয়া গ্রামের জহুরুল ইসলামের স্ত্রী পারভিনা খাতুন (২৫), বাগানমাঠ গ্রামের আবদুল আজিজের মেয়ে জেসমিন আক্তার (২৩), হুদাপাড়া গ্রামের আনিসুর রহমানের স্ত্রী নার্গিস খাতুন (২১), কাজিরবেড় ইউনিয়নের কোলা গ্রামের আবদুল আজিজের স্ত্রী পারুল খাতুন (২২)। মায়েদের এই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে জরুরী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

তথ্য সূত্র: (প্রথম আলো ও নয়া দিগন্ত)


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter