মাতৃত্বজনিত মৃত্যুরোধ করা সম্ভব
প্রসবের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হলেও বাংলাদেশে বেশির ভাগ মহিলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন না। এ হার বাংলাদেশের দুর্গম অঞ্চলে আরো বেশি। বাংলাদেশে ৭১ শতাংশ সন্তান প্রসব হয়ে থাকে বাড়িতে দাইয়ের হাতে। বাংলাদেশে প্রতি এক লাখে ১৯৪ জন মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। প্রসব পূর্ববর্তী সেবা (এএনসি) নেন মাত্র ৫৫ শতাংশ মা। সন্তান জন্ম দেয়ার সময়, গর্ভাবস্থায় ও প্রসব পরবর্তী ছয় সপ্তাহের মধ্যেও বিভিন্ন জটিলতায় মায়েরা মারা যান। বাংলাদেশ ম্যাটার্নাল মর্টালিটি সার্ভে ২০১০ অনুযায়ী, মাতৃত্বজনিত কারণে মৃত্যুর মধ্যে ৭ শতাংশ মারা যায় দীর্ঘ প্রসব জটিলতায়, ২০ শতাংশ মারা যায় একলাম্পশিয়ায়, রক্তক্ষরণে মারা যায় ৩১ শতাংশ, গর্ভপাতে মারা যায় ১ শতাংশ। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয় গর্ভজনিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানান জটিল কারণে। এক শতাংশ মৃত্যু কেন হয় তা নির্ণয় করা যায় নি।
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা আগে থেকে নির্ণয় করা সম্ভব হলে মাতৃমৃত্যূ রোধ করা সম্ভব। সে জন্য প্রয়োজন নিয়মিত চেকআপ বা ডাক্তারি পরীক্ষা করা। বেশির ভাগ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা চেকআপের মাধ্যমে শনাক্ত করা গেলে সময় মত ব্যবস্থা নেয়া যায়। তাই গর্ভাবস্থায় কমপক্ষে চার বার চেকআপ করা, প্রসব পরবর্তী সময়েও চার বার চেকআপ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভ নির্ণয়ের জন্য আগের গর্ভের এবং আগের প্রসবের ইতিহাস জানা জরুরী। বিশেষ করে প্রথম গর্ভবতী মা সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ বলে নিয়মিত চেকআপের প্রয়োজন হয়।
প্রসূতির মুত্যু হলে আমরা ভাবি হয় ডাক্তার অবহেলা করেছেন অথবা ভুল চিকিৎসা দিয়েছেন যার কারণে প্রসব কালীন সময়ে মায়ের মৃত্যু হয়। অথচ আমরা চিন্তা করি না এই মা গর্ভকালীন সময়ে কি কি স্বাস্থ্য সেবা পেয়েছেন। গর্ভকালীন সময়ে তার প্রতি তার পরিবার কোন অবহেলা করেছেন কিনা। ম্যাটারনাল মর্টালিটি সার্ভের তথ্য থেকে দেখা যায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায় ৩১ শতাংশ মা। এই দেশের সব পরিবার তো একরকম নয়। গরিব পরিবারে একটি মেয়ে জন্ম হলে জন্মলগ্ন থেকেই তাকে অবহেলার চোখে দেখা হয় ।
আর্থিক অবস্থা খারাপ বলে আবার অল্প বয়সে মেয়েটিকে বাবা মা বিয়ে দিতে বাধ্য হন । অল্প বয়সে বিয়ে করে জন্ম দেন একটি অপুষ্ট শিশুর । এ সময়ে মা ও শিশু দুজনেই থাকেন মৃত্যু ঝুঁকিতে। ছেলের আশায় বার বার মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন । মায়েদের ভাগ্যে ভাল পুষ্টিকর খাবার জোটেনা। তারা পায় না ভাল স্বাস্থ্য সেবা । অবশেষে অপুষ্টিতে ভুগে দেখা দেয় রক্তশূন্যতা । গর্ভাবস্থায় কোন মায়ের রক্তক্ষরণ হলে সেই মা রক্তশূন্য হয়ে পড়েন। যে সব মায়েরা গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতায় ভোগেন প্রসবের সময়ে তাদের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ মায়ের মৃত্যু একটি কারণ। এ ছাড়াও বাধাগ্রস্থ প্রসব, গর্ভফুল আটকে থাকা, একলাম্পসিয়া, প্রসবের আগে বা পরে রক্তক্ষরণ মায়ের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। চিকিৎসার অবহেলায় জনিত কারণে ও মায়ের মুত্যু হতে পারে।
অনেক সময় দেখা যায় মা পর পর দুটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছেন। কিন্তু তার পরিবার চেয়েছিল একটি পুত্র সন্তান। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি ছেলে সন্তানের আশায় বার বার গর্ভধারণ করেছে কিন্তু মেয়ে সন্তানই জন্ম দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা থেকে কথাটি বলছি। আমার এক আত্মীয় ছিল এল এম এফ ডাক্তার তিনি ছেলের আশায় পর পর ছয়টি মেয়ে জন্ম দিয়েছেন । অবশ্য তার বেলায় এমন ছিল না যে তিনি স্ত্রীকে অযত্ন করেছেন। যেহেতু তার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল সেজন্য তার স্ত্রী ভাল খাবারই খেতে পারতেন । তার স্ত্রীকে তিনি ভালই বাসতেন। ৬টি মেয়েকেই তিনি শিক্ষিত করেছেন। কথায় বলে না আম নষ্ট করে কাকে। মানুষ নষ্ট করে পাশের লোক । তার এক কম্পাউন্ডার তাকে ফুসলিয়ে ফুসলিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করান ছেলে জন্ম দেয়ার আশায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সেই স্ত্রী ও পর পর তিনটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। অবশ্য অবশেষে তার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। ছেলেটিও বেশ শিক্ষিত হয়েছে। এই দেশের সব পরিবার তো একরকম নয়। গরিব পরিবারে একটি মেয়ে জন্ম হলে জন্ম থেকেই তাকে অবহেলার চোখে দেখা হয় ।
একবার বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে গিয়ে ছিলাম। সেখানে দেখতে পেলাম একজন মাকে সেলাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। তার আত্মীয়ের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সেই মা একজন কৃষক পরিবারের গৃহবধু। পর পর তার কয়েকটি মেয়ে হওয়ার জন্য স্বামী তাকে অনেক নির্যাতন করেছেন। আবার ঐ সময়ে তিনি তিন মাসের গর্ভবতী ছিলেন। স্বামীর নির্যাতনের ভয়ে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি তা পারেননি। আত্মীয়স্বজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের সমাজের কোথাও কোথাও এই ঘটনাও ঘটছে।