আদার উপকারিতা
আদা সুপরিচিত একটি মসলা। পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে গ্রীক সভ্যতার বিভিন্ন দলিলে আদার ওষুধী ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে জানা যায়। এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দলিলে আদার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীনকাল থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে আদা একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মধ্যযুগে ইউরোপে এক পাউন্ড আদার দাম ছিল এক শিলিং সাত পেন্স্। যা সে সময় একটি ভেড়ার দামের সমান ছিল। বিশ্ব বিখ্যাত ভ্রমণকারী মার্কোপলো এবং ভাসকোদাগামা গুরুত্বের সাথে আদা চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ লিখে গেছেন।
আদা অবশ্যই স্বাস্থ্যকর মসলা। আদা (Gingiber officinale) প্রায় পাঁচ হাজার বছর থেকে মূল্যবান মসলা হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাচীন চীনা এবং ভারতীয় সভ্যতায় সাধারণ রোগ চিকিৎসায় টনিক হিসাবে আদার ব্যবহার হয়েছে। ওষুধী গুণাগুণ এবং হজমে সহায়তাকারী ওষুধ হিসাবেও আদা ব্যবহার হয়ে আসছে। ঐতিহ্যগত চীনা এবং ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে আদা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ঈশ্বরীক উপহার হিসাবে গণ্য হয়েছে। চীনা ওষুধ শাস্ত্রমতে দীর্ঘদিন নিয়মিত কাঁচা আদা সেবনে মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তি উজ্জজীবিত হয়। কোরান শরীফে আদার রস উৎকৃষ্ট পবিত্র উদ্দীপক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন আরব, চীনা, ভারতীয়, গ্রীক এবং রোমান দলিলেও উদ্দীপক হিসাবে আদার উল্লেখ দেখা যায়। প্রাচীন রোমান মেডিকেল স্কুলের এক বিবরণে বয়স্ক ব্যক্তিদের সুখী জীবনের জন্য আদা সেবন করার কথা বলা হয়েছে। আদা উজ্জীবনী শক্তির উৎস মূলে রয়েছে এর বলবর্ধক গুণ যা হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে শক্তি উৎপাদন করে। ক্ষুধা বৃদ্ধি করে এবং দেহের স্নায়ুতন্ত্রের সঞ্চালন ক্রিয়া সজীব করে।
খৃষ্টপূর্ব পাঁচশত বছর আগে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস লিখে গেছেন যে, তিনি যখনই কিছু খেয়েছেন সঙ্গে অবশ্যই আদা খেয়েছেন। সকল সভ্যতার ইতিহাসে হজমে সহায়তাকারী উপাদান হিসাবে আদার ব্যবহার দেখা যায়। ডি ম্যাটেরিয়া মেডিয়ায় (৭৭ এডি) উল্লেখ করা হয়েছে যে, আদা পাকস্থলী সতেজ করে এবং তাপ বাড়ায়। হাজার হাজার বছর ধরে আদা এককভাবে অথবা অন্য লতা গুল্মের সাথে পছন্দের ওষুধ হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ঐতিহ্যগত ওষুধের প্রায় ৫০% এর মধ্যে আদার ব্যবহার চলে আসছে। জাপানীরা মেরুদন্ডের এবং গীটের ব্যথা নিবারণের জন্য আদা সেবন করেন। চীনারা দাঁতের ব্যথা, ঠান্ডা ও সর্দির চিকিৎসায় আদা ব্যবহার করেন।
বহুকাল থেকে বিভিন্ন রকম পেটের পীড়া এবং কারমিনাটিভ (গ্যাস মুক্তি) ভেষজ হিসাবে আদার ব্যবহার চলে আসছে। মাথা ঘোরা, গা বমি বমি করা, অস্বাভাবিক ঘাম হওয়া, যানবাহনে ভ্রমণে শারীরিক অস্বস্তি এবং বমি বন্ধে আদা কার্যকর ভাবে ব্যবহার হয়। গর্ভকালীন অবস্থায় মায়েদের মাথা ঘোরা এবং বমি বন্ধে আদা ব্যবহার করা হয়। সর্দি ও কাশির মত যন্ত্রনাদায়ক শারীরিক সমস্যা নিরাময়ের জন্য আদার রস সেবন করলে আরাম পাওয়া যায়।
তৈরি খাবার দীর্ঘ সময় ব্যবহার ও পচন রোধের জন্য আদার ব্যবহার চলে আসছে। তবে ইদানিংকালে রিফ্র্রিজারেশন উদ্ভাবনের ফলে এক্ষেত্রে আদার ব্যবহার কমেছে। তবে এখনও যারা রিফ্র্রিজারেশন ব্যবস্থার বাইরে আছেন তারা দীর্ঘ সময় খাদ্যের গুণমান সংরক্ষণের জন্য আদা ব্যবহার করতে পারেন।
আদা একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ মসলা। আদার মধ্যে আছে পটাশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রণ, কপার এবং সেলেনিয়াম। আরো আছে ওমেগা -৬ ফ্যাটিএসিড, লাইনোলিকএসিড, এসপারটিকএসিড ও গ্লুটামিকএসিড।
আদায় আছে ১-৩% উদ্বায়ী(বাতাসে উড়ে) টারপেন তেল এবং অলিওরেসিন যার মধ্যে আছে এন্টিঅক্সিডেন্ট, এন্টিটিউমার, এন্টিইনফ্লামেটরি, এন্টিমাইক্রোবিয়াল, এন্টিডায়াবেটিক, এন্টিআর্থরাইটিক, এন্টিএমেটিক, এন্টিমাইগ্রেন সমৃদ্ধ গুণাগুণ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি, চক্ষু এবং বিভিন্ন স্না্য়ু রোগ নিরাময় আদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
কৃত্রিম ওষুধ নির্ভর চিকিৎসা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল তেমনি অন্যদিকে রয়েছে এর বহুবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এক্ষেত্রে আদা ব্যবহারের মাধ্যমে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকি কমাবার সুযোগ রয়েছে। আদার উপর নীবিড় গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব, পাশ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকিমুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা উদ্ভাবনের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে।