সুস্বাস্থ্যের জন্য ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য অপরিহার্য


মানব দেহ একটি জটিল এবং সুবিন্যস্ত কোষ, পেশী এবং তরলের সমন্বয়ে গঠিত জৈব সত্ত্বা। যা সর্বক্ষণ বৈদ্যতিক শক্তি উৎপাদন করে। শরীরে কোষ, পেশী ও তরল পদার্থ সঞ্জীবনী শক্তিতে ক্রিয়া সম্পাদন করে এবং প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। মানব দেহের এসব কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি আসে ইলেকট্রোলাইটের মাধ্যমে।

ইলেকট্রোলাইট কি?

লবণ যখন তরলের মধ্যে দ্রবীভূত হয় তখন তা সংশ্লিষ্ট ধাতুর অংশ স্বরূপ অণুতে বিভক্ত হয়। বিদ্যুৎ সঞ্চালন শক্তি সম্পন্ন দ্রবণে পরিণত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, সাধারণ লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) যখন পানিতে গলানো হয় তখন তা ধনাত্বক আয়ন (সোডিয়াম+) এবং ঋণাত্বক আয়ন ক্লোরিন-) এ বিভিক্ত হয়। যে কোন তরল পদার্থ যা বিদ্যুৎ সঞ্চালন করে, যেমন লবণ পানিকে “ইলেকট্রোলাইট দ্রবণ” হিসাবে সজ্ঞায়িত করা যায়। যে সব আয়নের সমন্বয় এ দ্রবণটি গঠিত তা এ দ্রবণের “ইলেকট্রোলাইট”।

মানব দেহে কয়েক প্রকারের ইলেকট্রোলাইট প্রয়োজন হয়। প্রতিটি ইলেকট্রোলাইট পৃথক পৃথক এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সব ইলেকট্রোলাইট কোষের ভিতরে এবং কোষের বাহিরের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। এ ভারসাম্য বলে স্নায়ুবিক সংবেদনশীলতা, যোজন, পেশীর কার্যকারীতা, অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন কোন ইলেকট্রোলাইট খুব বেশী অথবা খুব সামান্য, উভয়ই মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে পেশী সংকোচনের জন্য ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, এবং সোডিয়াম প্রয়োজন। ঘাটতি হলে পেশীর দূর্বলতা অথবা পেশীতে মারাত্বক খিল ধরতে পারে। অন্য দিকে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে গেলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে এবং হৃদ রোগের আশঙ্কাও বেড়ে যায়। তবে ইলেকট্রোলাইট সমন্বয় রক্ষার জন্য আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ সঠিক খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের ফলে স্বাভাবিকভাই ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় থাকে।

মানব দেহে প্রধানত: সাত রকমের ইলেকট্রোলাইটের কার্যকারিতা দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ১. সোডিয়াম ২. ক্লোরাইড ৩.পটাশিয়াম ৪. ম্যাগনেশিয়াম ৫. ক্যালশিয়াম ৬. ফসফরাস ও ৭. বাইকার্বনেট।

১. সোডিয়াম:

সোডিয়াম মানব দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ইলেকট্রোলাইট। শরীরে পানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রক্ত, পেশী ও ¯œায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা সমন্বয় করে। একজন মানুষের দৈনিক ২-৩ গ্রাম সাধারণ লবণ প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে দৈনিক ১০ গ্রাম লবণ সেবন করেন। অতিরিক্ত লবণ সেবন হাইপারটেনশন এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

২. ক্লোরাইড

সোডিয়ামের সাথে ঘনিষ্টভাবে শরীরের যাবতীয় তরল পদার্থের ভারসাম্য ও চাপ নিয়ন্ত্রণ করে। সোডিয়ামের মত সাধারণ লবণের মাধ্যমে এর সরবরাহ নিশ্চিত হয়।

৩. পটাশিয়াম

পটাশিয়াম হৃদ ষ্পন্দন এবং পেশী শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। মাংস, দুধ, ফল এবং শাকসবজির মাধ্যমে পটাশিয়ামের সরবরাহ নিশ্চিত হয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য শরীরে পটাশিয়াম এবং সোডিয়ামের ভারসাম্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত ফলমূল, শাক সবজিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পটাশিয়াম পাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ প্রবনতা হচ্ছে প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ করা। যার মধ্যে অত্যাধিক পরিমানে সোডিয়াম থাকে। পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের ভারসাম্য হীনতার কারণে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ষ্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

৪. ম্যাগনেশিয়াম

ম্যাগনেশিয়াম দেহ অভ্যন্তরে শুধু মাত্র তিন শতাধিক প্রাণ রসায়ন প্রতিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে না বরং ডি এন এ এবং আর এন এ সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা প্রতিটি জীবনের জন্য অপরিহার্য। সবুজ শাকসবজি, ডাল, মসলা, কফি এবং চা থেকে ম্যাগনেশিয়াম পাওয়া যায়।

৫. ক্যালশিয়াম

ক্যালশিয়াম হাড়, দাঁত, স্নায়ুতন্ত্র গঠন, পেশী সংকোচন এবং রক্ত জমাট বাধার মত প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্যালশিয়ামের ঘাটতি হলে ওষ্টিওপ্রসিস রোগ, স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া, বিষন্নতা, এবং অস্বাভাবিক হৃদ কম্পনের মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

৬. ফসফরাস

ফসফরাস মানব দেহে ক্যালসিয়ামের পরেই ফসফরাসের অবস্থান। হাড়ের মধ্যে প্রায় ৮৫% ফসফরাস। শরীরে ফসফরাসের আধিক্যের কারণে কিডনি রোগ, হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

৭. বাইকার্বনেট

বাইকার্বনেট মানব দেহে অম্লত্ব ও ক্ষারত্বের ভারসাম্য রক্ষা করে। ফুসফস শরীরের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। যা পানির সাথে মিশে কার্বনিক এসিড সৃষ্টি করে। পরে তা বাইকার্বনেটে রূপান্তরিত হয়।

ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য:

ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন ইলেকট্রোলাইট মাত্রারিক্ত হলে যেমন ক্ষতি হয়। তেমনি ঘাটতি হলেও ক্ষতি হয়। পৃথিবী ব্যাপী আজকে সোডিয়ামের ভারসাম্যহীনতার কারণে উচ্চরক্তচাপ এবং হৃদরোগের প্রার্দূভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম নয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তা হলেই ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা হবে এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে।


Click Here To Print


Comments Must Be Less Than 5,000 Charachter