পুষ্টি সম্পর্কে কিশোরীদের মত জানা জরুরী
পুষ্টি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে অনেক আলোচনা হয় এবং স্বাস্থ্য খাতে পুষ্টির বিষয় ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু পুষ্টি নিয়ে কিশোরীদের মতামত নেয়া হয়েছে এমনটা খুব দেখা যায় না। এমন কি তাদের মায়েরা কি চিন্তা করেন তাও জানা হয় না। টাঙ্গাইলে এই বিষয়ে নান্দুরিয়া গ্রামের একটি দাইঘরে বসে উবিনীগের পক্ষ থেকে আমরা ছয় জন স্কুল ছাত্রী, তাদের মা এবং চারজন দাইমাকে নিয়ে আলোচনা করি। পুষ্টির সাথে শুধু সুস্থ থাকা নয়, প্রজনন স্বাস্থ্যেরও সম্পর্ক আছে; এই দিকটি দাইমায়েরা ভাল ভাবে বোঝেন এবং বাস্তবতার নিরিখে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়নে গ্রামে দাইঘরগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আলোচনায় শুরুতে পুষ্টি কি এবং কি ভাবে আমরা পুষ্টি বুঝি এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কিশোরীদের পক্ষ থেকে প্রথমে ছাত্রী সুমী আকতার বলে, 'আমরা বেঁচে থাকা থাকা বা জীবন ধারনের জন্য খাই। আর এ খাদ্যের মধ্যে যে গুণ আছে তা শরীরকে সুস্থ্ রাখে। আমরা তিন বেলা খাবারের সাথে তিন রকমের খাবার খেয়ে থাকি। সকালে শুকনা জাতীয় খাবার যেমন ভাজি-ভর্তা, শাক, ভাত রুটি, চিড়া, মুড়ি খাই এতে শরীর হালকা ও টাইট থাকে। আবার দুপুরের খাবার বলতে ভাত থাকতে হবে, এর সাথে শাক-সবজী, মাছ, মাংস, ডিম, ডাল যে কোন একটা আইটেম থাকতে পারে। দিনের বেলায় আমরা বেশী ও ভারী কাজ করি বলে শরীরে শক্তির জন্য এধরনের খাবার দরকার। রাতের বেলায় ভাত এর সাথে সবজী ভর্তা ভাজি থাকতে পারে। এ দু বেলার খাবার রোগ প্রতিরোধ করার সাথে সাথে শরীরের ক্ষয়পূরণ ও শক্তি বৃদ্ধি করে থাকে।
ছাত্রী সনেকা আকতার বলে 'আমরা এসব খাবারের পাশাপাশি সারা দিনে বাড়ির থেকে ফলমূল খাই, এটা আমাদের পুষ্টি দেয়। এর সাথে দোকান থেকে কিছু প্যাকেট খাবার খাই। তবে এটা আমাদের দেহের কোন উপকার করে না এটা আমরা মুখের স্বাদের জন্যে খাই, এটা হলো মুখ রোচক খাবার। এতে ভিটামিন নাই শরীর স্বাস্থ্যও ভাল থাকে না'।
অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী শিল্পি আকতার বলে 'আমরা খাবার খাই পুষ্টি চিন্তা করে খাই না। খিদে লাগে তাই খাই। আমাদের নিরাপদ খাবার খাওয়া উচিত পুষ্টির চিন্তা করে খেতে হবে। এর জন্য আমাদের নিজেদেরকে সার বিষ ছাড়া চাষাবাদ করে খেতে হবে। বাড়ির আশে পাশের জায়গা তরকারী সীম, বেগুন, লাউ, আলু, কুমড়া, ডাটা, লালশাক, পুঁই শাকসহ সব ধরনের আবাদ করে খেতে হবে। এগুলোই আমাদের জন্য নিরাপদ খাবার; বাজার থেকে আমরা যা কিনে খাব তা নিরাপদ কিনা তা আমরা জানি না। খাবার নিরাপদ না হলে আমরা পুষ্টিকর খাবার পাব না আমাদের শরীরে পুষ্টির চিন্তার সাথে সাথে আমাদের খাবার নিরাপদ হতে হবে।
পষ্টি নিয়ে মায়েরাও তাদের মতামত দিয়েছেন। মা বাতাসী বেগম বলেন, 'আমরা যে খাবার খাই সে খাবারের মধ্যে ভিটামিন আছে তবে কোন খাবারে কি ভিটামিন আছে তা বলতে পারি না, শুধু জানি এ ভিটামিন থেকে পুষ্টি পাই। আমাদের খাবারের জন্য তিন বেলায় যে খাবার খাই তা আমাদের জমির আবাদ থেকেপাশপাশি বাজার থেকেও কিনে থাকি। সপ্তাহের সাত দিনের একদিন কি দু’দিন মাছ-মাংস, দুধ-ডিম এর থেকে যে কোন একটা খাদ্য বাড়িতে থাকলে ভাল, না হলে বাড়ির কিনে খেয়ে থাকি। বাকি দিনে বাড়ির আশেপাশের থেকে কুড়ানো শাক সবজী খাই, এতে পুষ্টি আছে তা জানি আর এ পুষ্টির কারনে আমরা সুস্থ্য সবল আছি।
রাশেদা বেগম বলেন 'আমরা বাড়িতে শাক সবজী উৎপাদন করে খাই এতে পুষ্টি বেশী আর বাজার থেকে কিনে আনলে তাতে সার বিষ দেয়া থাকে এতে কোন পুষ্টি নাই। আবার আমরা রান্না করার সময় খাবারের পুষ্টি নষ্ট করে ফেলি যেমন তরকারী কাটার পরে ধুয়ে রান্না করি এতে পুষ্টি নষ্ট হয়ে যায়'।
দাইমা জাহেদা বেগম বলেন ‘খাবার রান্না করে রাখলাম সে খাবার বাসি গন্ধ বানিয়ে খেলে তারও পুষ্টি থাকে না’।
দাই হাজেরা বেগম বলেন, ‘খাবার রান্না করার মধ্যে খাবারের পুষ্টি ঠিক থাকে। পুষ্টিকর খাবার ভাবি না কোন খাদ্য খেলে শরীরে ক্যালসিয়াম হবে সে চিন্তা করে খাবার খাই। শরীরে রক্তের জোর কম সে জন্য আয়রন জাতীয় খাবার -- যা কাটলে পানি কালো হয় -- সে ধরনের খাবার খাওয়া ভাল। মাথা ঘুরালে সে জন্য সব ধরনের শাক মিশিয়ে কয়েক দিন পর পর খেয়ে থাকি। বাড়িতে থাকলে বা পারলে দুধ ডিম জোগাড় করে খাই। আবার পেটে বদ হজম হলে বা পেটে সমস্যা দেখা দিলে কচুশাক রান্না করে খাই। বাড়ির গাছের ফল থাকলে বেল, আতা ,আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, কলা, জাম্বুরা,জাম ও বরই এ সব খাই'।
দাই এবং মায়েরা মনে করেন, এখন ছেলে ও মেয়েদের খাবার সমান ভাবে দেয়া হয়, আগে পার্থক্য করা হোত। বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ে বাবার বাড়ি আসলে তার খাবারের প্রতি খেয়াল বেশী রাখি; মেয়ের জন্য কোন খাবার তুলে রেখে দিয়ে খেতে দেই। কারন সে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে নিজে অনেক সময় ইচ্ছামত কিছু খেতে পারে না । সংকোচ করে। শ্বাশুড়ি দিলে খেতে পারে, না হয় না খেয়ে থাকে। এজন্য মেয়েদের খাবারের দিকে আমাদের নজর রাখা উচিত।
দাইমা খাদিজা পারভীন বলেন, আমরা মেয়ে বড় না হতেই বিয়ে দেই আর সে মেয়ে তাড়াতাড়ি মা হলে তার শরীরে পুষ্টির ঘাটতি ঘটতে পারে, যে বাচ্চা হবে সেও অপুষ্টি নিয়ে জন্ম নেবে। তাই মেয়েদের শরীর গঠনের জন্য পুষ্টি দরকার এ জন্য মায়েদের মেয়ে সন্তানের প্রতি খাবারের খেয়াল রাখতে হয়। একটা মেয়ে বিয়ে দিলে স্বামীর বাড়ি থাকে সেখানে সে তার চাহিদা মত সব খেতে পারে না তাই আমাদেরকে মেয়ে সন্তানের প্রতি ছেলে সন্তানের মতই খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে।